কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন অনেক ফোনকল রিসিভ করি। কলগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এবং কখনো কখনো দেশের বাইরে থেকেও আসে। প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ফোন রাখার পরে ঐ প্রান্তে যার সাথে কথা বলি তাকে আর মনে থাকে না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে কথা বলে ফোন রাখার পরেও রেশ রয়ে যায়। তাদের সর্ম্পকেও জানতে ইচ্ছে করে।
তেমনি একজনের কথা আজ আপনাদের বলব। তিনি ফোন করেছিলেন আজ থেকে বেশ ক’বছর আগে। পরিচিত একজনের কাছ থেকে আমাদের নাম্বার পেয়ে রিং দিলেন।
উনি হুইলচেয়ার ঠিক করাবেন। আমি সবিস্তারে সব তথ্য দেবার পর ফোন রেখে দিলাম যথারীতি। কিন্তু ফোন রাখার পরে মনে হতে লাগল ঐ কন্ঠে কি যেন ছিল! কাজের ফাঁকে বসে বসে ভাবতে লাগলাম আবার যেন উনি ফোন করেন। কেন যেন উনার সর্ম্পকে জানতে ইচ্ছে করছে। হ্যাঁ ক’দিন পর আবার সেই ফোন এলো। আমি প্রবল উৎসাহে কথা শুরু করলাম।
এইবার আমি উনার সর্ম্পকে জানতে চাইলাম। নাম ঠিকানা জানার পর জিজ্ঞেস করলাম হুইলচেয়ার কার জন্য? উনি বললেন,“আমার নিজের জন্য”। উত্তরটা শুনে অবাক হলাম। কারণ আমি যে সব কল রিসিভ করি সে গুলোতে সাধারণত কোন প্রতিষ্ঠান থেকে অথবা কোন অভিভাবক হুইলচেয়ার সর্ম্পকে খোঁজখবর নেন। কখনো কোন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নিজে তার হুইলচেয়ার সর্ম্পকে জানার জন্য ফোন করেননি।
যাই হোক আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। উনি কি করেন জানতে চাইলাম।
বললেন, ‘কিছু করি না’। কিন্তু আমার কাছে উনার সাথে কথা বলে উনাকে খুব ম্যাচিউরড একজন মানুষ বলেই মনে হয়েছে।
আমি বলি ওহ্ আচ্ছা, তাহলে পড়াশোনা করেন বুঝি? উনি বললেন, ‘নাহ পড়াশোনাও করি না’। উনার নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর আমাকে আরো আগ্রহী করে তোলে। আমি বলি- পড়াশোনাও করেন না, চাকরীও করেন না তাহলে সারাদিন কি করেন?
উনি ঠান্ডাস্বরে বললেন, ‘টিভি দেখি, খাই আর ঘুমাই’।
প্রথম পরিচয় তবুও ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি – বয়স কত আপনার? উনি অকপটে বললেন, ‘ছত্রিশ বছর’। উনার উত্তর শুনে মাথাটা গরম হয়ে উঠে। আমার কন্ঠ থেকে কেমন যেন উষ্মা ঝরে পড়ে। ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি এই কথা মনে রাখতে ইচ্ছে করে না। বলি- ছত্রিশ বছর হয়ে গেল! কিছুতো শুরুই করেননি আর কবে করবেন?
উনার নির্লিপ্ত জবাব-‘করব’।
আমি অবাক হয়ে বলি আর কবে করবেন! ঘড় সংসারও করেন না তাহলে সারাদিন সময় কাটানতো মুশকিল।
বাইরে ঘুরে বেড়ান নিশ্চয়। উনি বললেন, ‘নাহ্ কোথ্ওা যাই না সারাদিন ইট পাথরের চার দেয়ালের ভিতরে বসে থাকি। বাইরে যেতে ইচ্ছে করলেও যেতে পারি না। হাঁটতে না পারলে কে নিয়ে যাবে? হুইলচেয়ার নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়া অনেক ঝামেলা’।
জানতে চাই কি হয়েছিল? হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন কেন? বললেন, “পোলিও। তিন/চার মাস বয়সে অসুখ ধরা পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ডাক্তারৃ কোথায় বৈদ্য তবুও চিকিৎসার কোন ত্রুটি করেননি বাবা মা কিন্তু এই জীবনে আমি দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেই পারলাম না। তাই হাঁটতেও শিখিনি। আমার চারপাশে এতো মানুষ হেঁটে বেড়ায় অথচ আমি? আমি জানতেই পারলাম না হাঁটার অনুভূতি কেমন। তবে দু’বছর হল আমার একটা হুইলচেয়ার কেনা হয়েছে”।
জিজ্ঞেস করলাম- কেন এত বছরে কেনেননি? উনি বললেন, “আগে ভাড়াবাসায় থাকতাম ওখানে এতো ছোট ছোট রুম ছিল যে হুইলচেয়ার নিয়ে চলাফেরা করার মত জায়গা ছিল না। এখনতো নিজেদের বাড়ীতে উঠে এসেছি। হুইলচেয়ার নিয়ে এই রুম ঐ রুমে ঘুরতে পারি। আগে সারাটাদিন এক জায়গায় বসে থাকতে হত। বিছানা বা সোফা যেখানে বসিয়ে রাখত মা সেখান থেকে আরেকবার সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত পাথরের মত বসেই থাকতাম”।
আমি এই প্রথম কারো কন্ঠে এতোটা আত্মতৃপ্তির স্বর শুনতে পেলাম; যে কিনা হুইলচেয়ার পেয়ে কিছুটা হলেও স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে।
উনার কথা শুনে আমার মন কেমন কেমন করে। মাথা থেকে বিরক্তিভাবটা আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। আমি বলি, আচ্ছা তাহলেতো আপনি ঘরে বসে গল্প উপন্যাস লিখতে পারেন। উনি বললেন, “গল্পের বই পড়ি কিন্তু লিখতে ভাল লাগে না”।
আমি বলি, ‘ঠিক আছে গল্প লিখতে ভাল না লাগলে সারাদিন যে ভাবে সময় কাটান সেটাই না হয় লিখতে শুরু করেন। এ্যানাফ্রাঙ্কের ডায়রীর মত আপনার লেখাও বিখ্যাত হয়ে উঠবে’।
উনি বলেন, “আমার লেখার মত কোন বিষয়ই নাই। কি নিয়ে লিখব শুধু শুধু! তাছাড়া বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখব সেই ক্ষমতাও আমার নেই”।
আমি তবুও হাল ছাড়ি না। নাছোড়বান্দার মত বলতেই থাকিৃ…
উনি বলেন, “কি হবে এইসব ছাইপাশ লিখে?”
আমি বলি, “মানুষ জানবে দিনের পর দিন চারদেয়ালের ভিতর বসে থাকতে কেমন লাগে। এই যুগেও কেউ এই ভাবে থাকে?”
উনি বলেন, “করব… করব… আমিও কিছু করব সময়তো চলে যায়নি”।
উনার আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর শুনে আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। মনে মনে ভাবি এতোটা বছর পার হয়ে গেল কিছু শুরুই করেননি; আর কবে যে করবেন!
এই ছিল উনার সাথে আমার প্রথম দিককার ফোনালাপ। এরপর প্রায়ই আমাদের দু’জনের কথা হয়। আমাদের সম্পর্ক এখন আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। উনি উনার সারাদিনের গল্প করেন।
আমিও আমার অফিসে কেউ আমার সাথে হেসে হেসে কিংবা রেগে রেগে অথবা ভালবেসে কথা বলল এই সব ইতং বিতং শেয়ার করি। তবে এর মধ্যেও মাঝেমাঝে মিনমিন করে জানতে চাই লেখালেখির কি অবস্থা!
উনি টেনেটেনে বলেন, “হবে… হবে… ”
আমি “হাল ছেড়ো না বন্ধু আমার” এই পুরোনো বাক্যে নতুন করে উজ্জ্বিবিত হয়ে আশায় থাকতে থাকতে অপেক্ষার প্রহরকে দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘায়িত করতে থাকি।
এই ভাবে দিন যায় মাস যায় আমাদের বন্ধ্ত্বু গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে।
তারপর হঠাৎ একদিন একটি ফোন এলো; ও লাজুক লাজুক স্বরে আমাকে জানাল অবশেষে ও লিখতে শুরু করেছে। প্রথম পাঠক হচ্ছি আমি। অবশ্য পাঠক না বলে শ্রোতা বলাই ভাল। যেহেতু ওর কাছ থেকে দূরে থাকি তাই লেখাটা ও আমাকে ফোনে পড়ে শোনাল। আমি ওর লেখা শুনে যতটা আনন্দিত হলাম তার চেয়ে বেশী পুলকিত হলাম এই ভেবে যে, ও শুরু করেছে! তারও চেয়ে বেশী অবাক হলাম এই কথাটা চিন্তা করে যে, চাইলে ছত্রিশবছরেও শুরু করা যায়। এখন শুধু লেগে থাকার পালা।
ইতিমধ্যে ওর হাতের নাগালে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ চলে এসেছে। গাড়িও কেনা হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবী চলে এসেছে হাতের মুঠোতে।
ফেসবুক, টুইটার, মাইস্পেস, ইয়াহুম্যাসেঞ্জারে একাউন্ট খুলল ও। তৈরী হল অনেক দেশী বিদেশী বন্ধু। এমনি করে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হল সমমনা আরো ক’জনের সাথে।
স্বপ্ন দেখতে শুরু করল আমার বন্ধুটি। যেহেতু সে নিজে নিজে বাইরে যেতে পারে না তাই অনলাইনের মাধ্যমেই একটি গ্রুপ খোলার চেষ্টা করল। যারা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের বঞ্চনা, চাহিদা, সুযোগ সুবিধা আর অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে জনসচেতনতা তৈরী করার লক্ষ্যে কাজ করবে।
অনলাইনে কাজ করতে করতে গ্রুপে মেম্বার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। গ্রুপের লোগো, ওয়েবসাইট তৈরী হল। এই ভাবে কাজে কাজে একটি বছর পেরিয়ে গেল।
প্রথম বছরপূর্তীতে সিদ্ধান্ত হল অনলাইনে যে সব সদস্যদের সহযোগীতায় আমার বন্ধুটি গ্রুপের কাজ এগিয়ে নিয়েছে; তাদের সবাইকে নিয়ে গেটটুগেদারের আয়োজন করা হবে। নির্দিষ্ট দিনে দূরদুরান্ত থেকে সবাই এলো। একজন আরেক জনের সাথে পরিচিত হল। এবং সেখানেই সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হল শুধু মাত্র অনলাইনে গ্রুপের কাজ সীমাবদ্ধ না রেখে মাঠ পর্যায়েও কাজ করতে হবে। তাহলেই অনেক বেশী করে উপকৃত হবে সুবিধা বঞ্চিত মানুষ গুলো। যেই ভাবা সেই কাজ।
সদস্যদের ভিতর থেকে অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মাঠ পর্যায়েও কাজ করতে এগিয়ে এলো।
তাদের নিয়ে আমার বন্ধুটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজন করল রচনা, বির্তক প্রতিযোগিতা, র্যালী, মানববন্ধন, মুক্তালোচনা, জনমত গঠনে স্বাক্ষরতা সংগ্রহের কাজ।
বিতরণ করা হল লিফলেট ছাপা হল স্বরণিকা, পোস্টার। তৈরী করল তথ্যচিত্র।
সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রেডিও টিভিতে বিভিন্ন টকশোতে অংশগ্রহন করে জনমত গঠনে সোচ্চার ভূমিকা রাখল।
আর এই সব কাজের উদ্দেশ্য ছিল একটাই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলো যেন তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার সমাজের আর দশ জন মানুষের মতই পূরণ করতে পারে। তাদের জীবনের “না” গুলো যেন “হ্যাঁ” তে রূপান্তরিত হয়।
এতো পরিশ্রমের ফলাফলও পাওয়া যেতে লাগল আস্তে আস্তে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসস্থান, কর্মস্থল, শপিংমল, যাদুঘর, স্টেডিয়ামে চলছে সিঁড়ির পাশাপাশি ঢালুরাস্তা বা র্যাম্প তৈরীর কাজ। যাতে যে কোনো ধরণের সহায়কদ্রব্য নিয়েও সহজে চলাচল করা যায়।
বাসগুলোতে কি করে র্যাম্প বসানো যায় সে ব্যাপারেও চলছে পরীক্ষা নিরীক্ষা।
আমাদের দেশে বিশেষচাহিদা সম্পন্ন মানুষদের জন্য ব্যবহারোপযোগী টয়লেট নেই; সে দিকেও মনোনিবেশ করা হচ্ছে।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে আইটি সেক্টরে কি করে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রবেশোপযোগী করে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়েও দেয়া হচ্ছে ওরিয়েন্টেসন, ট্রেনিং।
আর এই সব কিছুর পিছনে আমার বন্ধুটি অনলাইনে তৈরী হওয়া তার স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের নিয়ে টুকটুক করে এগিয়ে চলছে। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য গড়ে তুলছে একটি সুন্দর আগামী।
যে মানুষটি কখনো চারদেয়ালের বাইরে পা বাড়ায়নি; বাড়ীর বাইরে কখনো কথা বলেনি – সে আজ কিনা করছে! দেশে বিদেশে আজ অনেকেই তাকে চেনে। ভাবা যায়? আমি আর কি বলব! নিজের চোখেই তো দেখছি!! চাইলে ছত্রিশ বছরেও শুরু করা যায়!
প্রয়োজন? প্রয়োজন শুধু একটু অনুপ্রেরণা আর সহযোগীতা…
সেলিমা শারমীন ফারজানা রুমা
পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)।