বাড়ি6th Issue, March 2014এভারেস্টের চূড়ায় ভিক্টোরিয়া

এভারেস্টের চূড়ায় ভিক্টোরিয়া

শারমিন রহমান (নিয়ন)

মিসেস ডায়ানা ওয়েব্স্টার তার মেয়ে ভিক্টোরিয়াকে শিশুকাল থেকে বুঝিয়েছেন যে সেরিব্রাল পালসি তার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে কোন বাধা  সৃষ্টি করতে পারবে না। মায়ের অক্লান্ত চেষ্টা আর উৎসাহের মধ্যে বেড়ে উঠা ভিক্টোরিয়া ১০ বছরে পদার্পনের পর ডাক্তার হবার ইচ্ছার কথা মাকে জানালেন। ডায়ানা অবাক হলেও বুঝতে পারলেন ভিক্টোরিয়াকে তার দৃঢ় সংকল্প থেকে দূরে সরানো যাবেনা, যদিও ডাক্তার হতে চাওয়ার ইচ্ছাটি ভিক্টোরিয়ার জন্য অনেক কঠিন পদক্ষেপ মনে হলো ডায়ানার কাছে।

 

ডায়ানা শীঘ্রই বুঝতে পারলেন হাঁটা ও কথা বলার প্রতিবন্ধিতা ভিক্টোরিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেনা। স্কুল ও কলেজের পরীক্ষাগুলো কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার আবেদন করলেন। বেশীর ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিবন্ধিতার অজুহাতে আবেদন গ্রহণে অপারগতা জানায়। ভিক্টোরিয়া হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে সুইডেনের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হন। অক্লান্ত চেষ্টা ও দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে ভিক্টোরিয়া শুধু একজন নামকরা ডাক্তারই হয়নি ৪৭ বছর বয়সে বর্তমানে তিনি একজন নামকরা কনসালটেন্ট। শুধু এই নয় তিনি  ফিনল্যান্ডের একটি  হাসপাতালে দূর্ঘটনা এবং জরুরী বিভাগে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন।

ভিক্টোরিয়ার জন্ম  ফিনল্যান্ডে, ১৯৬৫ সালে। সেই সময় তার বাবা মাইকেল ওয়েবস্টার ও মা ডায়ানা ওয়েবস্টার হেলসিংকি  ইউনিভার্সিটিতে  শিক্ষকতা করতেন। যদিও ডায়ানার মাতৃত্বকালীন সময় কোন জটিলতা হয়নি কিন্তু প্রসবের সময়টি ছিল দীর্ঘ। গুড ফ্রাইডের ছুটি থাকাতে হাসপাতালে কোন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন না। এখন কার দিন হলে দেরি না করে সিজার করা হত কিন্তু তখনকার সময়ে সেটি সম্ভব ছিল না। জন্মের পর ভিক্টোরিয়া কান্না করেন নি ফলে সবাই তার মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলেন। তাই তাকে ইমার্জেন্সি ব্যাবটিজম দিয়ে ভিক্টোরিয়া নাম রাখা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি অকাল মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে মনে হল যেন তার জন্মের প্রতিকূল পরিস্থিতি তার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে যখন তিনি হাঁটতে শুরু করেন তখন দেখা গেল যে অন্য শিশুদের তুলনায় তিনি ঘন ঘন পড়ে যাচ্ছেন এবং বাবা মাকে চুমু দেওয়ার সময় ঠোঁট দুটি একত্রিত হচ্ছে না। এইসব লক্ষণ দেখে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তার স্প্যাস্টিসিটি ধরা পরে। সেই সময় সেরিব্রাল পালসিকে স্প্যাসটিসিটি বলা হত। ডাক্তার জানালেন প্রসবকালীন সময় ভিক্টোরিয়ার অক্সিজেনের ঘাটতি হবার ফলে তার কথা অস্পষ্ট হবে। দৈনন্দিন কাজ ধীর গতির হবে এবং হাঁটার সমস্যাসহ অন্যান্য কাজ কর্ম করতে অক্ষমতা দেখা যাবে। ডাক্তারের কথা শুনে তার বাবা মা নিরাশ হননি। মা ডায়ানা বলেন,“আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে ভিক্টোরিয়া অন্য শিশুদের মত সবকিছু করতে পারবে আমরা তার জীবনে বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বাধা দেব না।”

 

১৯৭৯ সালে ভিক্টোরিয়ার বাবা ডঃ মাইকেল ওয়েবস্টার হঠাৎ ব্রেইন হেমারেজে মারা গেলে কিছু দিনের জন্য মিসেস ডায়ানা ওয়েবস্টার মেয়ে ভিক্টোরিয়া ও ছেলে জন কে নিয়ে স্বদেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যান, পরবর্তীতে ফিনল্যান্ডেই আবার স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই সময় চৌদ্দ বছরের কিশোরী ভিক্টোরিয়া তাদের পারিবারিক বন্ধু একজন ডাক্তারের দ্বারা উৎসাহিত হন। তিনি বলেন, “ডাক্তার বন্ধুটি সব সময় বলতেন, নার্স হবার চেয়ে ডাক্তার হিসেবে আমি ভাল করব, কারণ নার্সিং এর জন্য সম্পূর্ন শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন। আমি জানতাম মেডিকেলে ভর্তির আগে আমার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। তাই আমি একটি হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রমে অল্প দিন চাকরি করি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আমি নিশ্চিত হলাম মেডিসিনে পড়লে ভাল করব।”

সুইডেনের মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রদূত স্টকহোমে অবস্থিত ক্যারোলিন্সকা ইন্সটিটিউট তাকে ভর্তি করে নেয়। নতুন ভর্তি  হওয়া ১৪৬ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ভিক্টোরিয়া একমাত্র প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। কোন ইন্টারভিউ ছাড়া কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতায় ভর্তিতে সক্ষম হন তিনি। প্রথম কয়দিন সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখতেন। এছাড়া কোর্স লিডারের কথায় ভিক্টোরিয়া প্রচন্ড আঘাত পান। কোর্স লিডার তাকে একদিন বলেন, ভিক্টোরিয়ার কাছে তিনি কৃতজ্ঞ কারণ তার আগমনে তিনি বুঝতে পেরেছেন তাদের ভর্তি পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যতে তার মত প্রতিবন্ধী মানুষ যেন মেডিসিনে পড়ার সুযোগ না পান। তিনি আরও বললেন, রোগীরা ভিক্টোরিয়াকে দেখে ভয় পাবে এবং ডাক্তার হিসেবে তার উপর আস্থা রাখতে পারবে না। পরামর্শ দিলেন কলেজ ছেড়ে দিতে এবং চেষ্টা করলেন তার পরিবর্তে অপেক্ষমান শিক্ষার্থীদের তালিকা থেকে একজনকে ভর্তি করানোর জন্য।

 

সেই মুহুর্তে ভিক্টোরিয়ার মনে হল তার এত বছরের স্বপ্ন সংগ্রাম বিফলে যাবে। ভিক্টোরিয়া কোর্স লিডারকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন তিনি কিছুতেই যাবেন না। বললেন, “আমি প্রস্তুত আছি এটা মেনে নিতে যে ডাক্তারি পেশা চালিয়ে যেতে আমার জন্য সম্ভব হবে না। তার আগে আমাকে নিজে সেটা চেষ্টা করে দেখতে হবে।” ভিক্টোরিয়া দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যথাসাধ্য চেষ্ঠা করে লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য।

পরবর্তী বছরগুলোতে, ভিক্টোরিয়া নিষ্ঠার সাথে পড়াশুনা করেন। মেডিসিনের বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে অবশেষে গ্র্যাজুয়েসন লাভ করেন। এরপর যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের  বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ হয়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে দুই বছরের জন্য ডেরিফোর্ডে এক্সিডেন্ট ও জরুরি বিভাগে কাজ করার সময়ে সিদ্ধান্ত নেন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার।

ইতিমধ্যে, ভিক্টোরিয়া তার রোগী ও তাদের পরিবারবর্গের সঙ্গে নিজেকে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য একটি ভাল কৌশল বের করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সাথে যার পরিচয় হবে তাদের তার সম্পর্কে অবশ্যই জানা দরকার যে তার জন্ম থেকেই কথা বলা ও হাঁটার সমস্যা আছে। এটা জানা তাদের জন্য জরুরী কারণ তারা বুঝতে পারবে যে প্রতিবন্ধিতা থাকা সত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি দিয়েছে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তার কাজ করার সক্ষমতা আছে। দীর্ঘ  আঠারো বছরের মেডিকেল প্র্যাকটিসের সময় মাত্র দুই একজন বলেছেন তারা প্রতিবন্ধী চিকিৎসকের চিকিৎসা নিতে ইচ্ছুক নন।

 

বর্তমানে তিনি হেলসিংকির ‘হার্টম্যান হসপিট্যালে’ এক্সিডেন্ট ও জরুরী বিভাগে কন্সালটান্ট হিসাবে কাজে নিয়োজিত আছেন। প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় তিনি ষাট থেকে নব্বই জন রোগী দেখেন। ভিক্টোরিয়া ফিনল্যান্ডে কাজ করতে ও বসবাস করতে পছন্দ করলেও ভবিষতে ইংল্যান্ডে ফিরে সেখানে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে তাদের বাড়ি থাকা সত্যেও ভিক্টোরিয়ার মা ও ছোট ভাই জন ও তার পরিবারবর্গ ফিনল্যান্ডে বসবাস করছেন।

মা ডায়ানা আশা করেন যে তার মেয়ের জীবনের সাফল্যের গল্প প্রত্যেক প্রতিবন্ধী সন্তানের বাবা-মাকে অনুপ্রেরনা  দেবে এবং মনে বিশ্বাস আনতে সাহাষ্য করবে যে সব কিছুই সম্ভব। তিনি বলেন,“বেশির ভাগ সময় দেখা গিয়েছে যে প্রথম থেকেই ‘পারবে না’ কথাটির উপর জোর দেওয়া হয়, কিন্তু কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কি করতে সক্ষম বা ভবিষ্যতে সে কি করতে পারবে।”

 

(ইন্টারনেট থেকে সংকলিত)

লেখকঃ ফ্রিল্যান্স রাইটার ও অনুবাদিকা

স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক, উইলিয়াম এন্ড মেরি টেইলর (ইনক্লুসিভ) স্কুল, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, সিআরপি-সাভার।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ