বাড়ি10th Issue, March 2015ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশগম্যতা প্রসঙ্গ; আমার এবং প্রতিবন্ধী মানুষের অপ্রাপ্তিগুলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশগম্যতা প্রসঙ্গ; আমার এবং প্রতিবন্ধী মানুষের অপ্রাপ্তিগুলো

 

সগীর হোসাইন খান

 

এইচএসসি পাশ করার পর “কোথায় ভর্তি হব” এই চিন্তাটি যতবার মাথায় এসেছে ততবারই “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে হবে” চিন্তাটাও মাথায় এসেছে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবা চাকুরী করতেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বড় হয়েছি, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়েছি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার চিন্তায় বুকটা কেঁপে উঠত সেই ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকেই।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমত শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমি ভর্তি হতে পেরেছি। পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজীবনের জন্য “আমার ক্যা¤পাস” বলার সুযোগ। এখানে পড়তে গিয়ে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। যা বলে শেষ করার নয়।

ঢাবি এমন এক উচ্চ শিক্ষার বিদ্যাপিঠ যেখানে অধ্যায়ন করার সুযোগ পাওয়াটাই নিজের একটি যোগ্যতা। আপনি ঢাবিতে পড়ছেন শোনা মাত্রই মানুষের অন্যরকম একটি উচ্চ ধারণা এসে যাবে আপনার প্রতি।

 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নানা স্থানেই নানান ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু যে স্থানগুলোতে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা ঢাবি থেকে পাশ করেছি বলতে পারি সেখানে ঠিকই সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছি আমি। কিন্তু সব পাওয়ার মাঝেও রয়ে গিয়েছে কিছু না পাওয়ার যন্ত্রণা। আর সেই যন্ত্রণাগুলো এমন যে সব সুখের মাঝেই তার সুর বাজতে থাকে। এখনো যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডা দেয়াসহ বিভিন্ন কাজে যাই এবং অনুভব করি আজও সেই যন্ত্রণাগুলো রয়ে গিয়েছে তখন নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। সেই যন্ত্রণার নাম “হুইলচেয়ার প্রবেশগম্যতার অভাব”। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে থেকেই আমি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচিত হতে শুরু করি। এবং ভর্তি হবার পর তাদের অনেকের সাথেই আমি কাজ করা শুরু করি। তখন থেকেই আমার ভেতর প্রতিবন্ধী মানুষের বিভিন্ন অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা তৈরী হতে শুরু করে। আমরা যারা একসাথে কাজ করতাম তাদের সবারই একই কষ্ট, “সর্বত্র প্রবেশগম্যতার অভাব”।

 

ঢাবির একজন শিক্ষার্থী তিনি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হোন কিংবা অ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তাদের সবাইকেই কম বেশী তিনটি স্থানে যেতেই হয়। ঢাবির প্রশাসনিক ভবন বা রেজিস্টার বিল্ডিং, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি এবং কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এই তিনটি ভবনের সাথে শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ভবন হল;  শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেখানে বেশি যেতে হয় সেই কলা ভবন।

বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার ভিত্তিক দাবি দাওয়া নিয়ে অনেকবারই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু দাবি দাওয়া ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন হলের সিট বরাদ্দ সহজ করা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ বিশেষ করে ব্রেইল বই বানানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের যানবাহনে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সিট বরাদ্দ করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরোক্ত চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ধীরে ধীরে অন্যান্য ভবনকেও প্রবেশগম্য করা।

 

প্রশাসনিক ভবনে যেতে হয় না এমন কোন শিক্ষার্থী নেই। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহুবার এই ভবনে গিয়েছি বিভিন্ন কাজে। কিন্তু এই ভবনটি মোটেও আমাদের জন্য প্রবেশগম্য নয়। মূল প্রবেশদ্বারের দুটোতেই রয়েছে সিড়ি যা পার করা আমার মত প্রতিবন্ধী মানুষের, বিশেষত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের জন্য হিমালয় পাড়ি দেয়ার সমতুল্য কষ্টের।

শিক্ষার্থীদের জন্য আড্ডার তীর্থস্থান হল ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি। টিএসসিতে যে শিক্ষার্থী আড্ডা দেয় নি তার শিক্ষা জীবন অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে বলতে হবে। এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নয় বাইরে থেকে আগত শিক্ষার্থী বা সাধারণ নাগরিকদের বিনোদনের একটি স্থানও বটে। কিন্তু সেই টিএসসিতে ঢুকতে হলে আমাদের বাধার পর বাধা পেরোতে হয়।

 

টিএসসির প্রবেশ মুখেই পার হতে হয় উঁচু ফুটপাত। এরপর রয়েছে ভবনের উঁচু অংশ। দুই ধাপ পার করে উঠা একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যও দুটি বাধাই বিপদজনক। কারণ একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব খুব বেশী নয়। তাই একটি উঠে গিয়ে আরেকটিতে পা রাখতে রাখতেই তাদের পা হড়কে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। টিএসসির মূল বারান্দা থেকে সবুজ ঘাসের মাঠে নেমে যেতেও পার হতে হবে বারান্দার উঁচু অংশ। এর ফলে চলার পথের হুইলচেয়ারটি সহায়ক হওয়ার বদলে হয়ে উঠে আমাদের যন্ত্রণার কারণ। কিন্তু এটাও ভাবি, আমি নাহয় হুইলচেয়ার থেকে নেমে কোনভাবে গড়িয়ে নিজেকে টেনে নিচ্ছি, যিনি গুরুতর মাত্রার হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী তার কি দশা হবে এই সমস্ত স্থানে এসে! টিএসসির শৌচালয়গুলো কোনভাবেই সব ধরণের প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য উপযুক্ত নয়। ঢোকার পথে হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশ করা গেলেও টয়লেট ব্যবহার করতে গেলে হুইলচেয়ার রেখে যেতে হবে।

 

এবার আসি ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রসঙ্গে। বেশ সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে পুরনো বই যেমন রয়েছে তেমনি আছে নতুন লেখকদের বই। গ্রন্থাগার প্রশাসন নিয়মিত বই হালনাগাদ করে থাকেন। যদিও সব বিষয়ের হালনাগাদ বই পাওয়া যায় না এরপরও পড়ার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান শিক্ষার্থীদের জন্য। এর প্রধান কারণ মূলত এর শান্তশিষ্ট পরিবেশ। শিক্ষা জীবনে আমিও বহুবারই গিয়েছি সেখানে। আমাদের সময়ে শিক্ষা বিজ্ঞানের উপর প্রয়োজনীয় এবং হালনাগাদ বই পাওয়া না গেলেও বেশ কিছু বই ছিল যেগুলো বেশ কাজের। তার উপর পরীক্ষার আগে নিরিবিলি পড়ার জন্য আমাদের বন্ধুদের সেটি ছিল পছন্দের স্থান। কিন্তু প্রবেশ মুখ থেকেই শুরু হয় বাধা। মূল প্রবেশ দরজাটি যেভাবে বসানো হয়েছে সেভাবে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রথমে হুইলচেয়ার থেকে নেমে সেটি ভাজ করে ঢুকিয়ে পরে আমার নিজের ঢুকতে বেশ সমস্যা হয় বৈকি। এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যও এটি সহজগম্য নয়।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় সব শিক্ষার্থীরাই কলা ভবনে পড়ালেখা করে থাকে। সৌভাগ্যের বিষয় হল এই ভবনটিতে রয়েছে লিফট। আর হাস্যকর দূর্ভাগ্যের বিষয় হল সেই লিফটে উঠতে হলে আগে সিড়ি পার হতে হবে। আবার সেই হুইলচেয়ারের বিড়ম্বনা।

আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে তখন কলা ভবনে জাহিদ নামের এক হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ভর্তি হয়েছিল। লিফটের সামনে সেই সিড়ি বিড়ম্বনার কারণে তার পক্ষে আর সেখানে অধ্যয়ন করা সম্ভব হয় নি। কারণ লিফটগুলো সব তলায় থামে না। কোন তলায় যেতে হলে এক তলা নেমে আসতে হয় আবার কোন লেভেলে যেতে হলে এক তলা উঠে আসতে হয়। আমি যে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়া লেখা করেছি সেখানে একজন ক্রাচ ব্যবহারকারী ভর্তি হয়েছিল। তার পক্ষে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। কারণ প্রতিনিয়ত সিঁড়ি বেয়ে দুইতলা কিংবা তিন তলায় গিয়ে ক্লাশ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দুইজনই পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। আর এমন স্বপ্নের ঢাবি থেকে প্রবেশগম্যতার অভাবের কারণে বেড়িয়ে যেতে বাধ্য হওয়া বা বেসরকারিতেও পড়ার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে অকালে কতো শিক্ষার্থীর শিক্ষা প্রদীপ নিভে গেছে আমি ঠিক গুণে মনে করতে পারছি না।

 

শেষ কথা:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে গিয়েছি তাও প্রায় চার বছর হতে চলছে। এর আগে পাঁচ বছর পড়ালেখা করেছি। যদি আট বছর সময় ধরে নেই তাহলে বলতে হবে শুধু মাত্র চারটি ভবনে ছয়টির মত র‌্যাম্প তৈরি করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে। বিগত উপাচার্য ফয়েজ স্যার এবং বর্তমান উপাচার্য আরিফিন স্যার আমাদের কথা দিলেও সেই ছয়টি র‌্যা¤প তারা এখনো করে উঠার সময় করে উঠতে পারেন নি। অথচ এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও চারটির মত নতুন ভবন তৈরী হয়েছে। তৈরী হচ্ছে কোটি টাকা খরচ করে প্রবেশ দ্বার। সেখানেও প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা বিষয়টি অবহেলিত দেখে অবাক বিস্ময়ে ভাবি আমাদের আর কত ধৈর্য্য পরীক্ষা নেয়া হবে!!

 

উপাচার্য স্যারের কাছে দুটি প্রশ্ন থাকলো,

“যদি আমি প্রবেশ করে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে না পারি তাহলে প্রবেশ দ্বার দিয়ে কি করব? আর বিষয়টি কি এমন আমাদের প্রবেশগম্যতা ব্যবস্থা অ-প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশের ক্ষতি করছে?”

 

 

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ