বাড়ি12th Issue, September 2015উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধকতা

উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধকতা

 

২০১৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে ফলাফলও প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। আমি এবার রাজশাহী বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়েছি এবং মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছি। পরীক্ষার ফলাফল যতটা ভালো হয়েছে, আমার পরীক্ষার দেয়ার অভিজ্ঞতা বা কলেজে পড়ার অভিজ্ঞতা তারচেয়েও বেশি তিক্ততাময় ছিলো প্রথম দিকে।

 

আমি এসএসসি পরীক্ষায় যখন গোল্ডেন এ পেলাম, স্বাভাবিকভাবেই স্বপ্নটাও বড় হয়ে যায় আমার। ইচ্ছে ছিলো নামী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার। বগুড়ার তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করলাম। প্রথমটা ছিলো বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ। উল্লেখ্য, শারীরিক এই প্রতিবন্ধিতাকে আমি শুধু আমার জীবনের বেদনাদায়ক একটি অধ্যায় ভেবেছিলাম। সমাজ বা অন্য কারো জন্য সমস্যার কারণ হবো তা ভাবি নি। যখন ক্যান্ট পাবলিক কলেজে আমার ছোট ভাইকে পাঠালাম আমার রেজাল্ট শিটসহ, কলেজ অধ্যক্ষ রেজাল্ট শিট দেখেই আমাকে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখনই শুনলেন আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং হুইলচেয়ার ব্যবহার করি, তখন তার চেহারায় কিছুটা চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। খানিকক্ষণ নীরব থেকে ছোট ভাইয়ের কাছে আমার প্রশংসা করলেন এবং আমার জন্য দোয়াও করেছিলেন যেন আমি অন্য কোন ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারি। সেই সাথে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলেন, আসলে ক্যান্ট পাবলিক কলেজে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তির কোন নিয়ম নেই (!)। তাই তিনি আমার ভালো ফলাফল সত্ত্বেও আমাকে ভর্তি করাতে অপারগ। আজো আমি এই অদ্ভুত নিয়মটি সম্পর্কে স্পষ্ট অবগত নই। এরপর সরকারি আজিজুল হক কলেজে সুযোগ পেলাম। কিন্তু কলেজের নিকটবর্তী কোন ভাল বাসা বা মেস পেলাম না থাকার জন্য। কলেজের নিজস্ব হোস্টেল ছিলো। কিন্তু আবাসন ব্যবস্থা সবই দোতলা থেকে শুরু হয়ে আরও ওপরতলাগুলোতে। নিচ তলায় শুধু প্রশাসনিক কার্যক্রম চলে। এই কলেজও বাদ দিয়ে অবশেষে গভঃ শাহ সুলতান কলেজে ভর্তি হতে পারলাম।

 

আমার প্রথম বর্ষের ক্লাসগুলো নিচ তলাতেই হতো। শুধু একটা ক্লাস ওপর তলায় নেয়া হতো। পরবর্তীতে কলেজের প্রভাষক সাইফুল স্যারের অনুরোধে অধ্যক্ষ স্যার নিচ তলায় ক্লাস নেবার অনুমতি দেন। প্রথম বর্ষ ভালই ছিলাম। সমস্যা হয়েছিলো দ্বিতীয় বর্ষে। কেননা দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসগুলো যে ভবনে হতো তার বারান্দায় উঠতে পাঁচটি সিঁড়ির ধাপ পার হতে হতো। সমস্যাটা অধ্যক্ষ স্যারকে জানিয়ে ছিলাম এবং এখানে র‌্যাম্প তৈরির অনুরোধ করেছিলাম। বলেছিলাম প্রয়োজনে আমার পরিবারই এর সমস্ত খরচ বহন করবেন। কিন্তু যেহেতু এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান তাই তিনি আমাদের অনুমতি দেন নি। বলেছিলেন তিনি বিষয়টা দেখবেন। আমি যেন নিশ্চিন্তে থাকি।

 

এরপর আমার চোখের সামনেই দোতলা কলেজ ভবন তিনতলা হয়েছে। তিনতলার ভবনকে পাঁচতলাও হতে দেখেছি। কিন্তু আমার ক্লাসে যাবার পথের সেই পাঁচ ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে একটা র‌্যাম্পই শুধু তৈরি করা সম্ভব হয় নি কর্তৃপক্ষের। আর এর কারণ সম্ভবত, কলেজ মিটিংগুলোতে সব বিষয়ে আলোচনা হলেও আমার সমস্যার কথা বেমালুম ভুলে যায় সবাই। হয়তো সিঁড়ি দিয়ে আমার এই কষ্ট করে উঠা নামা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে আমাকে দেখলে ঐ মূহুর্তের জন্যেই শুধু তাদের মনে পড়ত। স্যারেরা মাথায় হাত দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেন এবং অনুপ্রেরণা দিতেন। প্রাপ্তি বলতে শুধু এটুকুই। প্রথম দিকে বন্ধুরাই সিঁড়ি দিয়ে তুলে নিত। কিছু দিন এভাবেই ক্লাস করেছিলাম। তারপর স্থানীয় একটা কোচিংয়ে ভর্তি হই যেখানে কলেজের কিছু স্যারেরাই ক্লাস নিতেন। তাই সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামার ঝামেলা থাকায় কলেজে আর খুব একটা ক্লাস না করলেও চলছিলো। আমার আর কিছু করারও ছিলো না।

 

এরপর আমার পরীক্ষার সময় এসে গেলো। পরীক্ষা কেন্দ্র পড়েছিলো বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে। আমার মেস থেকে ৪০ মিনিটের পথ। পরীক্ষার আগে সাধারণত পরীক্ষার্থীরা দুঃশ্চিন্তায় থাকে পড়ালেখা নিয়ে। আর আমার এই দুঃশ্চিন্তার ওপর আরও একটি বাড়তি দুঃশ্চিন্তা হয়ে যায় নিত্যসঙ্গী হুইলচেয়ারটি নিয়ে আমি কিভাবে পথ চলবো! পরীক্ষা কেন্দ্রে আমার সিট ঠিক কত তলায় পড়তে পারে! দোতলা বা তিনতলা এমনকি চার তলায়ও যদি সিট পড়ে তা আমার জন্য কতটা অসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়।

তাই আমি একজন প্রভাষক স্যারকে বিষয়টা জানালাম। তিনি উপলব্ধিও করলেন বিষয়টা। আমাকে পরামর্শ দিলেন অধ্যক্ষ স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে। আর এও আশ্বাস দিলেন উক্ত কলেজ কমিটিকে তিনি ফোন করলেই বিষয়টা সমাধান হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, আমাদের কলেজও সরকারি।

 

আমি যথারীতি অধ্যক্ষ স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আমার সমস্যা শুনলেন। এবং ততোধিক বিনয়ের সাথে বললেন তুমি তোমার পরীক্ষা কেন্দ্রের ঐ কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের সাথে দেখা কর ও তাদের পরীক্ষা কমিটির কাছে তুলে ধরো বিষয়টা। অর্থাৎ আমার কলেজ কমিটি বা অধ্যক্ষ স্যারের তার নিজ কলেজের ছাত্রের এত বড় সমস্যা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই!

 

অনেক দুঃশ্চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম প্রথমদিন। প্রথম দুটি পরীক্ষার সিট নিচ তলাতেই ছিল। কিন্তু তৃতীয় পরীক্ষা থেকে সেটা হয়ে গেলো তিন তলায়। আমার পরীক্ষা কেন্দ্র যে কলেজে সেখানকার একজন কেরানি গোছের কর্মচারী আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন আমার হুইলচেয়ারের সুবিধার্থে নিচতলায় সিটের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন এবং তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সব কিছু করেছেন। এমন একজন দুজন করে মানুষকে যদি প্রতিটা পদক্ষেপে, সমাজের প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা পেতাম তাহলে সত্যিই আমাদের জন্য সমাজব্যবস্থাটা সহায়ক হতো। আমরা সহজেই সব কাজ করতে পারতাম! সেদিন ঐ কর্মচারীর আন্তরিক সহযোগিতায় আমি অন্য বিভাগের পরীক্ষার্থীদের সাথে নিচতলায় পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং আমার সৌভাগ্য বলতে হবে সেখানকার অন্যান্য স্যারেরা এবং কর্মচারীরাও অনেক সহযোগি মনোভাবাপন্ন ছিল।

 

বিষয়টা অপরাজেয় পাঠকের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্য, এই পত্রিকাটি প্রতিবন্ধী মানুষের কন্ঠস্বর। যারা পড়ছেন তারা ভালো ভাবেই উপলব্ধি করবেন আমার সে মূহুর্তে কেমন শোচনীয় অবস্থা হয়েছিলো। একটা সরকারি কলেজেই প্রতিবন্ধী মানুষ বিশেষত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের জন্য কোন আলাদা নির্দেশনা নেই! থাকলেও তার যে পালন নেই আমার অভিজ্ঞতাই তা প্রমাণ করেছে! দেশের অন্যান্য স্থানে আমাদের চিত্রটা তবে কেমন?

আমাদের সরকারি শাহ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক যগেন্দ্র কুমার মন্ডল, বাংলাদেশের মনোবিজ্ঞানের অন্যতম লেখক। যাকে উত্তরবঙ্গের মনোবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। এতো বড় মাপের শিক্ষিত এবং বিজ্ঞ একজন ব্যক্তি হয়েও তিনি আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার তথা তাদের ব্যবস্থাগুলো এবং সরকারি আদেশের প্রতি কতটা সচেতন তা আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে। অবশ্য শুধু এটুকুর জন্যই তার প্রতি আমার এই মূল্যায়ন তা কিন্তু নয়। আরও কিছু বিষয় আছে যা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যই প্রযোজ্য।

 

আমি বরাবরই কলেজ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। এরপরও শেষ পর্যায়ে আমার কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের আমার প্রতি এমন নিষ্ক্রিয় মনোভাব খারাপ লেগেছে। আমার প্রশ্ন, আমরা আর কতোটা করলে সমাজ বদলাবে, যা এখনো আমরা অর্জন করি নি? যা অর্জন করলে আমরা মনোযোগ বা দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হতে পারবো?

আমাদের আলাদা করেই বা এভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে কেন? যেখানে সরকার আমাদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বড় বড় কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন। সেই সরকার অধীনস্থ কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই যদি আমাদের অধিকার, আমাদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত না হয়, অন্যান্য জায়গায় আমাদের অধিকার তবে কিভাবে নিশ্চিত হতে পারে?

 

সরকারের ঘোষণার মূল্যটা তাহলে কোথায়! আগে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই আমাদের শিক্ষার সম অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দেখাক! তবেই না ঘোষণা বা নির্দেশনার মূল্যায়ন করতে পারবো আমরা সাধারণ জনগণ! প্রতিবন্ধী কোটা দিয়ে কি করবো? যদি সেই কোটা পূরণের যোগ্যতা অর্জন করতে না পারি। তাই সবার আগে আমাদের কোটার জন্য যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষিত করে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই পরিবেশ তৈরি হতে হবে।

 

পরবর্তী জীবনেও হয়তো বাধা আসবে। কিন্তু আশা করছি বাধা ভেঙ্গে চলার পথ তৈরিতে সক্ষম হবো।

 

আদিল মাহবুব,

সরকারি শাহ সুলতান কলেজ, বগুড়া।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ