বাড়ি18th issue, March 2017সিআরপিডির দশ বছর

সিআরপিডির দশ বছর

 

অপরাজেয় প্রতিবেদক 

 

জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ সিআরপিডি প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্তি হয়েছে। যদিও এই সনদের মূল চেতনা বাস্তবায়নে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছেন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। এমনকি সনদ অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্রের নিজ নিজ পরিস্থিতির আলোকে দুই বছর পরপর একটি প্রতিবেদন পাঠানোর কথা থাকলেও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদন পাঠাতে ব্যর্থ হয়।

 

সিআরপিডির মূল চেতনা, প্রতিবন্ধী মানুষকে মানববৈচিত্র্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রতিবন্ধিতা নয়, ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষায় প্রণীত হয় এই সনদ। মেডিকেল মডেল নয়, সামাজিক মডেলে কাজ করার তাগিদ দেয় সিআরপিডি। এখানে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধের বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। আলাদা বিদ্যালয়ে আলাদা শিক্ষা গ্রহণের বিষয়েও বলা হয়নি। বরঞ্চ সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের সম-অংশগ্রহণ অর্থাৎ শিক্ষা, চাকরি, যাতায়াত ও প্রবেশগম্যতা এবং বিনোদন এই সব অধিকার সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে সিআরপিডি অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের জন্য।

কিন্তু এসবেরই উল্টোপথে হাঁটছে এ দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্র। এখনো প্রতিবন্ধী মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না এ দেশে। যদিও বিশ্বের অনুন্নত অনেক দেশেও এই প্রবণতা অতি মাত্রায় বিরাজমান। কিন্তু এ দেশে শতকরা ৯৯ ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষই রাষ্ট্র-সমাজ এবং পরিবার দ্বারা এহেন আচরণ বা প্রচলিত ধারণার শিকার হচ্ছে।

 

প্রতিবন্ধী মানুষ অক্ষম, দুর্বল। প্রতিবন্ধী মানুষ কিছুই পারবে না। প্রতিবন্ধিতা অসুস্থতা। প্রতিবন্ধী মানুষ অসুস্থ। রোগী। চিকিৎসা করে তাদের সুস্থ করতে হবে। প্রতিবন্ধিতা পাপ। প্রতিবন্ধিতা অভিশাপ। প্রতিবন্ধী মানুষ অসহায়। তাই তাদের কল্যাণ করতে হবে। দান-দাক্ষিণ্যমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে তাদের জন্য। সমাজে এসব প্রচলিত ধারণাকেই মনের অজান্তে লালন করা হয়। সাধারণ বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হয় না। সরকার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয় তৈরি করে যায়। প্রবেশগম্যতা সামান্য থাকলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। স্বনির্ভর করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেই। বেসরকারি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর উদ্যোগসমূহের মধ্যেও কল্যাণকর ভাবনা কাঠামোই বেশি প্রতীয়মান। যা ধীরে ধীরে পরনির্ভরশীল করে তুলেছে দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষকেই।

 

অথচ কল্যাণের কাঠামোর পরিবর্তন এবং পরনির্ভরশীলতার জঠর থেকে বের করে এনে প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যক্তি মর্যাদা প্রতিষ্ঠার তাগিদে আজ থেকে দশ বছর আগে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় প্রণীত হয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ বা Convention on the Rights of Persons with Disabilities (CRPD)| যা অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক চুক্তির চেয়েও দ্রুততম সময়ে নানা অঙ্গনে অনুসমর্থিত হয়। ইতোমধ্যে ১৬৪টি দেশ অনুসমর্থন করেছে এটি। প্রথম দিককার অনুসমর্থনকারী অর্থাৎ অষ্টম সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ৩০ নভেম্বর, ২০০৭-এ এই সনদে স্বাক্ষর করে।

 

প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সুরক্ষায় ২০০১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি বিষয়ে প্রথম আলোচনা ওঠে। এরপর একটি অ্যাডহক কমিটি গঠনের মাধ্যমে ২০০২ সাল থেকে টানা ৪ বছর ধরে এই সনদ চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়া চলে। বিভিন্ন দেশের প্রতিবন্ধী মানুষ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত হয় এই সনদ। বাংলাদেশ এই সনদ তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় ২০০৪ সাল থেকে। পৃথিবীব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে এই সনদ প্রণীত হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন হিসেবে ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয় এই সনদ।

 

অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্রগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে রয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক কমিটি। সনদ বাস্তবায়নে করণীয় এবং সনদের লঙ্ঘন মোকাবিলায় উদ্যোগ গ্রহণ বা বৈষম্য রোধে এবং অধিকারগুলো সুরক্ষায় বাস্তবসম্মত সুপারিশও প্রদান করে এই কমিটি। এই লক্ষ্যে প্রতিটি দেশ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের অভিভাবক সংগঠন, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট সরকারি ফোকাল কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে জাতীয় পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করবে। এ কমিটি সিআরপিডি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অগ্রগতি জানিয়ে প্রতি দুই বছর অন্তর প্রতিবেদন পাঠাবে জাতিসংঘের কমিটিকে।

 

এই সনদের লক্ষ্য, সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের পরিপূর্ণ-সমভাবে সকল মানবাধিকার ও পূর্ণ স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে, তাদের সম্মান করতে উৎসাহিত করা। জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমাজের অন্য সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষের পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে এই সনদ অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্রের। এ ছাড়া জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যে চলার পথের বাধাগুলো যেমন প্রতিবন্ধী মানুষকে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা, কুসংস্কার বা একই রকমের নেতিবাচক ধারণার বশবর্তী হয়ে নির্যাতন বা বন্দি বানিয়ে রাখার মতো কার্যক্রমসমূহকে আমূলে উপড়ে ফেলতে দিকনির্দেশনা দিয়েছে সিআরপিডি।

 

যদিও বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে মনো-সামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বছরের পর বছর একই স্থানে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের ওপর। পরিবার ও সমাজে সম্মানের জীবন তাদের জন্য নেই। এমনকি রাষ্ট্র তাদের ভোটের অধিকার দেয় না। শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষসহ অন্যান্য বহুমুখী প্রতিবন্ধী মানুষ এবং গুরুতর প্রতিবন্ধী মানুষেরা সকল নাগরিক ও মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে চার দেয়ালের আঁধারে অসহনীয় এক যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করে। তাদের শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকার নেই, কিন্তু তার চেয়ে জটিল বিষয় হলো প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিয়ে বা পরিবার গঠনের অধিকারকে সমাজ মেনে নিতেই পারে না।

বিশেষজ্ঞ অনেকেই মনে করেন, সনদ একটি আইনি গঠনতন্ত্রের চেয়ে একটু বেশি কার্যকর। শিক্ষার সম-অধিকার, বৈষম্য ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি এবং সমাজে সমমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকারকে সুনিশ্চিত করলেও তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে তাদের নিজেদের এবং সমাজের সাধারণ মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সনদ শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।

 

জাতিসংঘ সিআরপিডি প্রতিষ্ঠার এক দশক উদ্যাপন করে। এর সঙ্গে সক্রিয় প্রতিবন্ধী মানুষের নেতারা স্বীকার করেন, পৃথিবীর কোটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের বাধাসমূহ এখনো বিদ্যমান। কারণ, এখনো প্রতিবন্ধী মানুষেরা ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি। বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষকে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিনোদন ক্ষেত্রসহ নিজ অধিকার অর্জনের আন্দোলনে নেতৃত্বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ভূমিকায় দেখা যায় না। তারা বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনসমূহকে তাদের জন্য গঠিত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স¤পৃক্ত থাকতে হবে প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যদিও তা অচিরেই সম্ভব নয়, কিন্তু অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রতিবন্ধী মানুষদের নিজেদেরই চেষ্টা করতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। লড়তে শিখতে হবে। চাইতে শুরু করতে হবে। তাহলে পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ