৪০তম বিসিএস বর্জন শ্রুতিলেখক নিয়োগসহ ৬ দফা দাবিতে জোরালো আন্দোলন

ডেক/ইনসেট: সংসদ ভবনের সামনের রাস্তা অবরোধ করে আমরণ অনশনে চাকরিপ্রত্যাশী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। ৪০তম বিসিএস বর্জন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি এবং সমাজসেবা অধিদফতর ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ঘেরাও।

অপরাজেয় প্রতিবেদক

চাহিদা অনুযায়ী শ্রুতিলেখক নিয়োগসহ ছয় দফা দাবিতে তিন মাস ধরে স্নাতকোত্তর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পরিষদের আন্দোলন চলছে। সর্বশেষ সরকারের সাড়া না পেয়ে সংসদ ভবনের ১২ নং প্রবেশদ্বারের সামনের রাস্তা অবরোধ করে আমরণ অনশনে বসেছে চাকরিপ্রত্যাশী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। এর আগে গত ৫ মে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিলে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যালয়ের পরিচালক প্রশাসন-৩ অতুল সরকার তাদের ডেকে ১৪ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পিএসসি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হলেও ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এদিকে রিসোর্স শিক্ষক নিয়োগের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী পরিষদ গত ২৮ মে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেয় এবং ছয় দফা দাবি মেনে না নিলে ২২ জুনের পর কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। এ ছাড়া বিসিএস পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক নিয়োগের ব্যাপারে পিএসসির দায়সারা মনোভাবের কারণে গত ৩ মে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা বর্জন এবং একই দিনে পিএসসি কার্যালয়ের সামনে প্রতীকী অনশন করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।

উল্লেখ্য, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) রিসোর্স শিক্ষক পদ-সংক্রান্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিলসহ সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি চাকরি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শ্রুতিলেখক নীতিমালার ধারা ২৫ এর বি উপধারা অনুযায়ী শ্রুতিলেখক নিয়োগের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ¯স্নাতকোত্তর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা চাকরিপ্রত্যাশী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ গঠন করে ছয় দফা দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদের আহবায়ক আলী হোসেন জানান, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ১০ম গ্রেডভুক্ত ৩৮ নং রিসোর্স শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় গত ১৭ এপ্রিল, ২০১৯। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক দিলেই তা ফলপ্রসূ হয়, এ কারণে ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে উক্ত পদে শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলে পরিষদ। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ এপ্রিল শাহবাগে পিএসসির রিসোর্স শিক্ষক নিয়োগ বাতিল এবং বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বাধা দূরীকরণের জন্য অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এরপর প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি জমা দিতে গেলে পুলিশি হামলার সম্মুখীন হন তারা। এরপর থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদারভাবে শুরু হয়। পিএসসির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও শাহবাগে ঘটে যাওয়া পুলিশি হামলার নিন্দা জানিয়ে গত ৩০ এপ্রিল রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেন তারা। এর দুদিন পর সমাজসেবা অধিদফতরের প্রধান ফটকের সামনে দিনব্যাপী অবস্থান নেন এবং পরবর্তীকালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনও অবরুদ্ধ করেন।

ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জানালে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সভায় পিএসসির রিসোর্স শিক্ষক-সংক্রান্ত নিয়োগ বাতিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রুতিলেখক নীতিমালার ধারা ২৫ এর বি অনুযায়ী শ্রুতিলেখক নিয়োগ প্রচলনের সুপারিশ করেন। এ ধারাবাহিকতায় গত ১৬ মে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে পিএসসির নীতিমালা অনুযায়ী শ্রুতিলেখক বিষয়ক সিদ্ধান্ত হবে এই মর্মে পিএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত দিতে চাইলে সমাধান ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়। উল্লেখ্য, শ্রুতিলেখক পরীক্ষার্থীর চেয়ে নিচের শ্রেণির হতে হবে এবং একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারবে না এমন নিয়ম থাকলেও পিএসসি শ্রুতিলেখক নিয়োগের সময় ভুল ব্যাখ্যায় নিয়োগ দিচ্ছে এমন অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

এ প্রসঙ্গে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, মনগড়াভাবে পিএসসি শ্রুতিলেখক নিয়োগ দিচ্ছে। এতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। স্বল্প দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মিলন হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, পরীক্ষায় কেন্দ্রের দারোয়ান বা অফিস সহকারীকে শ্রুতিলেখক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যিনি আমাদের প্রশ্নপত্রই পড়ে শোনাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক সময় এমন শিক্ষার্থীকেও তারা নিয়োগ দেন যে ইংরেজি ও বাংলা কোনো প্রশ্নই সঠিক উচ্চারণে পড়তে অপারগ। অন্যদিকে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাতেও একই সমস্যায় পড়তে হয় শ্রুতিলেখক নিয়ে। সরকার যেন একধরনের প্রবঞ্চনাই করছে আমাদের সঙ্গে।

গ্র্যাজুয়েট পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মাহবুব মোরশেদ ও জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ মিলনায়তনে গত ২০ মে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে প্রধান অতিথি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান এবং ডাকসুর সহসাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের উপস্থিতিতে গ্র্যাজুয়েট পরিষদের উপদেষ্টা হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পক্ষে কমপক্ষে দশ হাজার টাকা মাসিক বেকার ভাতা, প্রতিবছর ন্যূনতম এক শ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চাকরির নিশ্চয়তা প্রদানসহ ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

তবে চলতি জুন মাসের মধ্যবর্তী এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেবে নতুবা অব্যাহতি

প্রতিবন্ধী মানুষেরাও যে ‘মানুষ’, এ কথা সম্ভবত মানতে নারাজ সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বাংলাদেশের অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে আমিও একজন। দুর্ঘটনায় বাম পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ১০টি সার্জারির পর আমার পরিচয় এখন আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তারা আমাকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন।

সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কোটা বিদ্যমান। পরীক্ষায় অংশ নিতে গেলে প্রতিবন্ধিতা সনদ দেখাতে হয়। আগে সমাজসেবা কার্যালয় বিনামূল্যে এই সনদ দিত। বর্তমানে সুবর্ণ নাগরিকের নামে নতুন একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। দেওয়ার সময় সমাজসেবা থেকে বলা হয়, দেশের নাগরিক হিসেবে সব কার্যক্রমের অংশীদার হতে সর্বত্র এর ব্যবহার করা যাবে।

তা ছাড়া আমরা জানি, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’-এর ধারা ৩১ এর উপধারা (৬) এ পরিচয়পত্রের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও পরিচয়পত্র ব্যবহার-সংক্রান্ত জটিলতা বিরাজমান সর্বক্ষেত্রেই। প্রতিবন্ধী মানুষকে ভোগান্তি দিতে দুর্নীতির কপাট খুলে বসে রয়েছে অমানুষের দল। আমার জানা ছিল না সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে প্রদত্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পরিচয়পত্রটি পেতে অর্থ ব্যয় করতে হয়! আমার নিজের পরিচয়পত্রটি পেতে সমাজসেবা কার্যালয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ উৎকোচ দিতে হয়। আরও নানা ভোগান্তির পর পরিচয়পত্রটি হাতে আসে।

অর্থের বিনিময় না হলে দেশের অনেক সমাজসেবা কার্যালয়ই আমাদের ভাতা তুলতে এবং যেকোনো কাজ করাতে হয়রানি করে। এই সমস্যা বেশি হয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে।

আমার প্রশ্ন, প্রতিনিয়ত আমাদের এসব ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কি দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবে?

আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের ফোকাল এই মন্ত্রণালয়ের উচিত যেকোনো ধরনের হয়রানি থেকে আমাদের মুক্ত রাখা। আমি আশা করতে চাই, সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পরিচয়পত্রসহ যেসব জটিলতায় আমরা ভুগি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে তার যথাযথ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেবে, নতুবা প্রতিবন্ধী মানুষের ফোকাল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়াই কাম্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধি
বাংলাদেশ।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব পোশাকশিল্প কারখানায় অর্থনৈতিক মুক্তি

অপরাজেয় প্রতিবেদক

পোশাকশিল্পে প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিক মুন্নি আক্তারের অর্থনৈতিক মুক্তির ফলে পরিবার ও সন্তানের ভরণপোষণ তিনি একাই চালিয়ে নিতে পারেন। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং ইন্টাফ্যাবশার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডে কাটিং সহকারী পদে কাজের সুযোগ মুন্নির জীবনে এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন।

কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মুন্নিকে চৌদ্দ বছর বয়সে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় জয়পুরহাটের হিলিতে। শ্বশুরবাড়িতে রান্নাঘরের মাটির দেয়াল ভেঙে মুন্নি প্রতিবন্ধিতা বরণ করেন। মেরুদন্ডে আঘাত পাওয়ার ফলে হুইলচেয়ার ব্যবহার শুরু করেন ২০০৬ সাল থেকে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রথম দিকে দারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন তিনি। নিজে নিজে টয়লেট, গোসল, রান্না ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজ করতে পারতেন না। এ সময় কাছের মানুষেরাও তাকে এড়িয়ে চলছিল। অর্থাভাবে চিকিৎসাও হয়নি ঠিকমতো। দুই সন্তান ও বেকার স্বামী নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে পড়ে থাকতেন ঘরের কোণে। অবশেষে কাপড় সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মব্যস্ত জীবনে প্রবেশ করেন তিনি। বর্তমানে মুন্নির মাসিক আয় নয় থেকে দশ হাজার টাকা।

মুন্নি বলেন, প্রতিটি কারখানা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করে গড়ে তোলা হলে আমার মতো অনেকেই মুক্তি পাবে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসবে। তিনি আরও বলেন, হুইলচেয়ার চালিয়ে কারখানায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের দেশের রাস্তাগুলো হুইলচেয়ার উপযোগী করা দরকার। রাস্তায় পানি জমে থাকে, অনেক সময় উঁচুনিচু থাকে, যার ওপর দিয়ে হুইলচেয়ার চালিয়ে যেতে কষ্ট হয়। মুন্নি জানান, তার স্বামী প্রতিদিন কারখানায় যাওয়ার আগে গোসল, রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে এবং কারখানায় যাতায়াতেও যথেষ্ট সহযোগিতা করেন তাকে। স্বামী ও সন্তানের অনুপ্রেরণা তাকে শক্তি যোগায় প্রতিনিয়ত।

জয়ের ‘জয়’ করার গল্প

তামজিদ বিন ইসলাম জয়। সদ্য বিশে পা দেওয়া ভারী কাচের চশমা পরা গোলগাল মুখের টসবগে এক তরুণ। গাপ্পু-গুপ্পু শরীর ও আলা-ভোলা চেহারা নিয়ে এমনভাবে ঘুরে বেড়ায়, মনে হবে পৃথিবীর কিছুই বোঝেনা সে। একটু চোখের আড়াল হলেই আপনার মোবাইলটি বেজে উঠবে। ফোন ধরামাত্রই ওপ্রান্তে আধো আধো বুলিতে- ‘কি? ভালো আছ? হা…হা…হা… জয়… ভালো আছ? তারপর দুষ্টু কণ্ঠে বিশাল হাসির আওয়াজ। আপনি কিছু বলার আগেই ফোনের লাইনটি কেটে যাবে। সামনে এলে আবার সেই বোকা বোকা চেহারা। ফোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই ভ্রু কুঁচকে চোখ বড় বড় করে নিজেই নিজেকে বকে দেবে, জয়, ফোন একবার… একবার। বারবার না; বলতে বলতেই ভোঁ-দৌড়। বকবেন কি!!! আপনি হেসেই কূল পাবেন না ওর এই কান্ডে। -এই হলো জয়।
জয় ও তার মা হাসিবা হাসান জয়ার ছোট্ট পৃথিবীতে নানা ঝড়ঝাপটা গেছে। তিল তিল পরিশ্রমে জয়কে বড় করে তোলার পাশাপাশি নিজেকেও তৈরি করে চলেছেন তার যোগ্য শিক্ষক ও বন্ধু হয়ে উঠতে। মায়ের এখন স্বপ্ন একটাই- জয় একদিন নিজেকে জয় করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। বর্তমানে জয় প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএসএসপি) সহযোগী কর্মসূচি কর্মকর্তা হিসেবে সমাজে স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের দীক্ষা নিচ্ছে। জয়ের মা হ্যাবিলিটেশন স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ও সোসাইটি অব দ্য ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স (এসডিএসএল) –এর নির্বাহী সদস্য। জয়ের জয় করার গল্প তার মায়ের লেখনীতেই তুলে ধরা হলো অপরাজেয় পাঠকের জন্য।

হাসিব হাসান জয়া

জয় অন্য শিশুদের মতো নয়, এ সত্য প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছি আমি। তাই শুরু থেকেই ওকে আর দশজনের মতো গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করি। আমাকে প্রচুর পড়তে হয়েছে, তেমনি শিখতেও হয়েছে। জয় একেবারেই শুনতে পায় না তা আমরা প্রথম বুঝতে পারি ওর চার বছর বয়সে। আরেকটু বয়স বাড়লে নানা পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, জয় বয়সের তুলনায় ৪/৫ বছর পিছিয়ে রয়েছে। গুরুতর উুংষবীরধ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অনেকখানি পেছানো। এ ছাড়া চোখের দৃষ্টি কমে আসছে ধীরে ধীরে। এককথায় বলা যায়, সদ্য কৈশোর পেরোনো জয় একজন বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী তরুণ।

তবে প্রখর স্মরণশক্তি ও অনুকরণপ্রিয় হওয়ার কারণে জয় খুব সহজে আয়ত্তে আনতে পারে যেকোনো কিছু। অনুকরণ ও অনুশীলন দুটোর সুন্দর সমন্বয় ওর মধ্যে। পরিস্থিতি অনুধাবনের তীক্ষ্ণতা প্রখর। পরিবেশের সঙ্গেও দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। জয় নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। কারণ তার শিখনক্ষমতা ও শারীরিক গঠনগত দিক মিলিয়ে সাধারণ শ্রেণিকক্ষে তার চেয়ে অনেক ছোট বয়সী শিশুদের সঙ্গে বসতে সে নারাজ। আবার অন্যান্য বিকাশগত দিকে সাধারণ শিশুদের মতোই এগিয়ে থাকার কারণে বিশেষ বিদ্যালয়ে দেওয়া সম্ভব নয় তাকে। আমাদের দেশে শিখন প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কোনো বিশেষ বিদ্যালয় নেই। ফলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জয়ের একাকিত্ব বাড়ছে। বন্ধুর অভাববোধটাই ইদানীং বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

জয়ের ছেলেবেলা অনেক বড় একটা যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু নয়। ওর পাঁচ বছর বয়সে ২০০২-এর জুলাইতে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করাতে। যার মাধ্যমে হিয়ারিং এইড দিয়ে শুনতে পায় না, এমন শিশুও শুনতে পাবে। জয় শুনতে পাবে এই আশায় যেকোনো যুদ্ধই আমি লড়তে রাজি। ককলিয়ারের পর তারা সাধারণ বিদ্যালয়ে জয়কে দিতে বলেছিল। অনেক ঝক্কির পরে একটি সাধারণ বিদ্যালয় জয়কে ভর্তি নিল। কিন্তু বিপত্তি বাধল, জয় শিক্ষককে ফলো করতে পারে না, আর শিক্ষকও ওকে বুঝতে পারে না। আমি তখনো জানতাম না এটা ওর জন্য কত বড় ক্ষতিকর! আমাকে কেউ বলেনি মানিয়ে নিতে না পারাটা আর স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে একটা শিশুর মানসিক বিকাশ কী ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। টিভির কার্টুন, ভায়োলেন্স, বাড়ির অশান্তি, অসহযোগিতা একটা শিশুকে কতটা পিছিয়ে দিতে পারে!

শুরু হলো জয়কে নিয়ে এক নতুন পরীক্ষা। অরণি বিদ্যালয়ে ভর্তিতে কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে বেগ গেতে হলেও আমি সফল হই। তত দিনে আমি ব্যাচেলর অব ¯স্পেশাল এডুকেশন পড়ছি। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নতুন সমস্যা জয় কানে মেশিন পরতে চায় না। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে যোগাযোগ করি। তারা জানায়, আচরণগত সমস্যার কারণে হয়তো ও বারে বারে মেশিন খুলে ফেলছে। জোর করে মেশিন ব্যবহার করাতে হবে। শুরু হলো কঠোর শাসন। ওর কষ্ট আমরা কেউ বুঝতে চাইছি না। ওর কানের উন্নতির সঙ্গে আচরণগত উন্নতি, স্বাধীনভাবে মনের ভাব প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি আমরা ভুলতে বসেছিলাম। জয়ের সঙ্গে আরেকটা শিশু ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করেছিল। ওর বেশ উন্নতি হয়েছে, লেখাপড়াও শিখছে কিন্তু জয় কেন পারছে না! জয়কে নিয়ে আমার অঘোষিত আরেক যুদ্ধ।

ইতিমধ্যে অরণি বিদ্যালয়ে অরকিড একটা কর্মশালা করে পরিবারে শিশুদের সঙ্গে আচরণবিধির ওপর। সেখানে মনোবিজ্ঞানী কলি আপার সঙ্গে পরিচয়। ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না বাংলাদেশে শিশু মনোবিজ্ঞানী রয়েছে। কলি আপাই প্রথম আমাকে বোঝালেন, সে কানে কিছুই শুনছে না, তাই মেশিন পরতে চায় না। আমরা আকাশ থেকে পড়লাম। আপার কাছেই জানলাম বয়স অনুযায়ী ওর মানসিক বিকাশ যথাযথ নয়।

আপাকে যত দেখছি তত জানছি ও শিখছি। জয় ওর নিজের মতো এই বিশ্বাসটা আমি অর্জন করেছি আপার মাধ্যমে। প্রত্যেকটা শিশুই আলাদা ব্যক্তিসত্তার অধিকারী এই জানাটা একটা বিশাল মহাদেশ আবিষ্কার করার মতোই ব্যাপার। যা আমি প্রতিদিনই জয় আর অন্য সব শিশুর মাধ্যমে উপলব্ধি করছি। আমাকে তিনি জয়ের মা হিসেবে গড়ে তুলতে লাগলেন। জয়কে সে সময় ভর্তি করা হলো অরকিড আইসিইউ শ্রেণিতে। সপ্তাহে ৩ দিন এখানে, বাকি দুই দিন অরণি। ছয় মাস পর আপাই বললেন, দুই দিকে দু রকম পরিবেশ ওর মনের চাপ বাড়াচ্ছে। যেকোনো একটা বেছে নিন। অবশ্যই অরকিডকে বেছে নিলাম। আমি আপার কাছে কৃতজ্ঞ এ কারণে যে জয়কে পরিচালনা করার পদ্ধতি শিখতে তিনি আমাকে বরাদ্দের চেয়েও অতিরিক্ত সময় দিয়েছেন। আপার সঙ্গে জয়কে নিয়ে কাজ করছি হাসির সময় হাসি, কান্নার সময় কান্না, ভদ্রতা, অনুতপ্ত হওয়া, কাউকে না মারা, মন দিয়ে কোনো কিছু রং করা, তৈরি করা মোট কথা, ওর মস্তিষ্কের কম্পিউটারে একটা একটা করে সফটওয়্যার লোড করে দেওয়া হচ্ছিল। জয়কে জয় করার দলে আপা হলেন ক্যাপ্টেন আর আমরা সবাই সহযোগী। আপার দিকনির্দেশনায় এগিয়ে চলল জয়ের অগ্রযাত্রা। জয় একটু একটু করে নিজে খাবার খেতে শিখল, রাগ-জেদ কমলো, বন্ধ হলো কাগজ ছেঁড়াও। জয় শিখল নতুন কিছু তৈরি করা। কাগজ আর স্কচটেপ হলে যেকোনো কিছুই দেখে বানিয়ে ফেলতে শিখল। মোবাইল, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ, বিল্ডিং মডেল নানা কিছু। এসব দেখে ওর বন্ধুরা, আপা, আমরা সবাই অবাক! আপা ওর ভেতরের লুকিয়ে থাকা অনেক প্রতিভা বের করে আনলেন। এখন সে এঁকে ফেলতে পারে মুহূর্তেই। এর মাঝে জয় আমার সহযোদ্ধা হয়ে গেছে। আমার পৃথিবী বলতেই জয়। হাসি-কান্না, আড্ডা, পড়াশোনা, কাজ সবকিছুই আমাদের দুজনের। আপা বলত, জয় যদি একটু কম বুঝত তবেই ভালো হতো। ওর বয়সের তুলনায় ও একটু বেশিই বোঝে, খুব অনুভূতিপ্রবণ শিশু।

তার ভাব প্রকাশে এবং আচার-আচরণে ম্যাচিউরিটি এসেছে। একটি সুন্দর মূর্তিকে যেমন কাদামাটি থেকে একটু একটু করে ছেঁচে গড়ে তোলা হয়, তেমনি জয়কেও গড়ে তোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে।

আবার সিঙ্গাপুর গেলাম ২০০৬ এ। জানা গেল, ওর ২২টা চ্যানেলের মধ্যে দুটো কাজ করছে না। ডাক্তার সে দুটো চ্যানেলে সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ করে নতুন ম্যাপিং সেট করে দিল। ¯স্পিচ থেরাপি সেশন নেওয়া হলো। এরপর একটু একটু করে জয়ের আগ্রহ বাড়ল মেশিন পরার, কথা বলার। জয়ের শ্রবণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু হলো সে বছর থেকে। সে বছরেরই জুলাইতে আমি ‘ডেফ চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ডেক ওয়াব) এ প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। কলি আপা জয়কে ২০০৭ এর জানুয়ারিতে ডেক ওয়াবে ভর্তি করাতে বলেছিলেন। ২০০৮-এ এসে আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করলাম, আমার দশ বছরের ছেলে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে ‘¯স্লো লার্নার’। ডিসলেক্সিয়ার কারণে লেখাপড়া শিখছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। প্রতিবছর নতুন শ্রেণিতে উঠতে পারছিল না। এ সময়টায় ওর দলের আমরা সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সে পড়তে শিখবে। লিখতে শিখবে। তার মাকে, বাবাকে, বন্ধুদের ই-মেইল করবে, টেক্সট পাঠাবে, পৃথিবীকে জানাবে, আমরাও পারি, আমরা করব জয় একদিন।

এখন আমার সংগ্রাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি স্বাধীন জীবনযাপনে জয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য। পিএনএসপিতে জয় শিক্ষানবিশ হিসেবে ২০১৫ এর নভেম্বর মাসে যোগদান করে। মাস তিনেক শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার পর জয়ের শিখনক্ষমতা ও স্বাধীন জীবন যাপনের (ওহফরঢ়বহফবহঃ খরারহম) এর আগ্রহ লক্ষ করে পিএনএসপির প্রয়াত পরিচালক রফিক জামান জয়কে দাপ্তরিক কাজে দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক ছয় মাসের প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশিক্ষণ শেষে পিএনএসপিতে সহকারী কর্মসূচি কর্মকর্তা (সম্মান) হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিন বছর (ফেব্রুয়ারি ২০১৬-ডিসেম্বর ২০১৮) ধরে জয় পিএনএসপির উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সভা ইত্যাদি আয়োজনে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। প্রশিক্ষণকালীন জয়কে তার দক্ষতা অনুযায়ী দাপ্তরিক কার্যক্রমের পাশাপাশি রাস্তায় একা চলাচলসহ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় বিশেষত স্বাধীন জীবনযাপনের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয় পিএনএসপি। এ ছাড়া বাস্তবিক কর্মকান্ড ও ছবির মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের উপযোগী শব্দসহ ইংরেজি অক্ষর, সংখ্যা ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং বলতে শেখানো হয়। পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে খাপ খাওয়াতে নিয়মিত শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম করানো হয় জয়কে।

আমার বিশ্বাস, জীবনের এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে এ পৃথিবীতে সে বেঁচে থাকতে শিখে যাবে। আমি একজন পেশাদার, কিন্তু জয়ের কাছে আমি কেবলই মা, ওর বন্ধু। আমার জয় এখন যুদ্ধ করতে শিখছে। সে তার আচরণগত, কথা বলার সমস্যা, হাইপার অ্যাকটিভিটিকে অনেকটাই অতিক্রম করেছে। সে এখন এত কথা (স্পষ্ট-অস্পষ্ট) বলে, আমিই মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলি ‘একটু চুপ, পরে শুনছি।’

জয় বেড়ে উঠছে শুধু হাতে-পায়ে নয়, মনে-বুদ্ধিতেও। এখন আমার জয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বড়, ঠিক আমার বাবার মতো। আমার যখন খুব মন খারাপ হয়, আমার মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে এমনভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মনে হয় বাবার আদর পাচ্ছি। কোনো খাবার খেতে গিয়ে আগে আমাকে খাওয়াতে চায়, বারবার সাধে, ঠিক ছোটবেলায় বাবা যেমন আমাকে সাধতেন। ঘুমাতে গিয়ে ঘুমপাড়ানি গান আমি শোনাব কী, জয়ই আমাকে আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা গেয়ে ঘুম পাড়াতে চায়। রিকশায় আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করে ঘুরে বেড়ানো, বৃষ্টিতে ভেজা সব মনে করিয়ে দেয় আমার ছোট্ট জয় বড় হয়ে উঠছে। আমার স্বপ্ন একজন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ হিসেবে জয়কে গড়ে তোলা। যেন সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার কাজে সেও অংশগ্রহণ করতে পারে। যেন পরিবার-সমাজ গঠনে, দেশের বোঝা না হয়ে, নিজেকে কাজে লাগতে পারে সেটাই এখন একমাত্র লক্ষ্য আমার।

ঘরে বসে আয়: প্রতিবন্ধী নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন

সগীর হোসাইন খান

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের চিকিৎসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি অধিকার ভোগে খানিকটা হলেও গতি পেয়েছে। তবে গন্তব্য রয়েছে আরও দূরে। দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ এখনো কর্মহীন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নেতিবাচক প্রভাবের ফলে সরকারি অনেক সুযোগ তারা ভোগ করতে পারেন না।

চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ স্বল্পমাত্রার প্রতিবন্ধী মানুষকে প্রাধান্য দেন। দেশের অবকাঠমোগত বাধা এবং সামাজিক নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন না হলে এই অবস্থা বিরাজমান থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। সময় এসেছে সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধিতার ধরনের ভিত্তিতে চাকরির অধিকার নিশ্চিতে সরকারের সুদৃষ্টির।

এ দেশে সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার অভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবাধ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। ঘরবন্দী জীবন যাপনকারীদের মধ্যে অন্যতম হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষ। এর মধ্যে আবার প্রতিবন্ধী নারীরা ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছেন। একে প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, তার ওপর নারী হিসেবেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে সামাজিক বৈষম্য। প্রবেশগম্যতার অভাব এবং পারিবারিক অতিরিক্ত নিরাপত্তা চিন্তায় তটস্থ তারা।

এই অবস্থার মোকাবিলায় অনেকেই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মক্ষম ও উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। এমন একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী ফারজানা সুলতানা জ্যোতি। আড়াই বছর বয়স থেকে তিনি ঘরবন্দী। ঘরে বসেই মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ শেষে দীর্ঘদিন কর্মহীন কাটিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ ২০১১ সালে। জীবনের মোড় খানিকটা হলেও ঘুরে যায়। অনলাইনে টুকিটাকি কাজ করে ঘরে বসে আয় করতে শুরু করেন তিনি। গ্রাফিক ডিজাইন শেখার সিদ্ধান্ত নেন ২০১৫ সালে। বিভিন্ন ভিডিও টিউটেরিয়াল দেখে শিখতে শুরুও করেন। তার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)। বি-স্ক্যান এর স্বেচ্ছাসেবী শাহ আলম দায়িত্ব নেন জ্যোতিকে অনলাইনে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ শেখানোর। চট্টগ্রাম থেকে শাহ আলম স্কাইপের মাধ্যমে ঢাকায় বসবাসরত জ্যোতিকে গ্রাফিক ডিজাইনের হাতেখড়ি দেন। এরপর মিজানুর রহমান মিজান এবং সোহাগ হোসেনের কাছে অর্থের বিনিময়ে নিজের দক্ষতাকে আরও ঝালিয়ে নেন তিনি। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে মাসে তিন হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারেননি এখনও পর্যন্ত।

জ্যোতির মতোই আরেকজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী তাহমিনা আক্তার। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করেন। চাকরির বেশ কিছু প্রস্তাব পেলেও চলাফেরার সমস্যার জন্য গৃহবন্দী জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছেন তাহমিনা। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তিনি। সিদ্ধান্ত নেন ঘরে বসে কাজ করবেন। এই চিন্তা থেকেই অথেন্টিক আইসিটি’র অনলাইন বিজ্ঞাপনের প্রতিবেদন তৈরির কাজ করতে শুরু করেন। নিজের কর্মদক্ষতাকে বৃদ্ধি করতে ২০১৮ সালের শেষে Coders Trust Bangladesh -এর মাধ্যমে অনলাইনে ওয়ার্ডপ্রেস কাস্টমাইজেশন এবং গ্রাফিক ডিজাইন শেখেন। এখন তার স্বপ্ন আর দশজন সাধারণ তরুণের মতো তিনিও ঘরে বসে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করবেন।

জ্যোতি ও তাহমিনার মতো অনেকেই রয়েছেন, যারা নিজেদের সামান্য যোগ্যতা ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অপেক্ষায়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের এগিয়ে নিয়ে আসতে সরকারের রয়েছে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। বাংলাদেশের জনশক্তির অর্ধেকই নারী। আমরা ভালো করেই জানি, এই অর্ধেক শক্তিকে অলস বা অকার্যকর রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে পঞ্চম লক্ষ্যমাত্রায় নারী-পুরুষের সমতার মাধ্যমে নারী সমাজকে এগিয়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। মাইক্রোসফট এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে ২০১৫ সালে আয়োজিত ‘ইনোভেশন ফর ইমপ্যাক্ট’ শীর্ষক কর্মশালার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীদের অবস্থান মাত্র ৩৩.৭%। এ প্রেক্ষিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের দক্ষ জনশক্তি এবং নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধিতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের মন্ত্রণালয়সমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘Info Lady’ বা তথ্য আপা; মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রয়াস কর্মসূচি ‘জয়িতা’ ইত্যাদি। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীরা তাদের দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে চুড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে। এই সফলতায় পুরুষের সমপরিমাণ অবদান রেখে নারীও দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। নারী-পুরুষ শ্রেণিভেদে এই সাফল্য বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসের ফল। প্রতিবন্ধী মানুষও এর মধ্যে অন্যতম। সরকার নারীদের আর্থিক স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করছে। অন্যদিকে নারীদের মধ্যেও আরও বেশি পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত প্রতিবন্ধী নারীরা সরকারের দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। আবার তাদের মধ্যে যারা গৃহবন্দী তারা সমাজে লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের বিশেষভাবে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেন তারা রাষ্ট্র ও পরিবারের বোঝা হয়ে না থাকে।

অনেক সময় ধারণা করা হয়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন মানে ব্যয় ও কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া। অথচ সরকার গৃহীত প্রকল্পগুলোতে প্রযুক্তির সহায়তায় কিংবা সংগতিপূর্ণ বন্দোবস্তের মাধ্যমে বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়াই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

সরকারের বিশেষ কর্মসূচিগুলোতে নারীদের বিভিন্নভাবে ক্ষমতায়িত করা হচ্ছে। যেমন প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ-পরবর্তী ঋণ প্রদান, ব্যাংকে বিশেষ সুবিধা প্রদান প্রভৃতি। সরকারের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। আরও বেশি প্রয়োজন অনলাইনভিত্তিক প্রশিক্ষণের। এতে গুরুতর শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘরে বসে অংশ নিতে পারবে। তা ছাড়া মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসমূহে আবাসন ব্যবস্থা রাখলে প্রতিবন্ধী নারীরা সহজেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবেন। সরকারের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ প্রকল্পের মধ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য ভ্রাম্যমাণ কম্পিউটার ল্যাব একটি চমৎকার উদাহরণ। এমন ভ্রাম্যমাণ সেবাগুলোকে আরেকটু বিস্তৃত করে গৃহবন্দী প্রতিবন্ধী নারীদের কর্মপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যারা একদমই ঘর থেকে বের হতে পারেন না, তারাও উপার্জনক্ষম জনশক্তিকে রূপান্তরিত হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত আকবর হোসেন। দেড় বছর বয়সে পোলিও থেকে তিনি প্রতিবন্ধিতা বরণ করেন। চলাফেরার জন্য হুইলচেয়ার একমাত্র ভরসা। ঘরে বসে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছেন। এরপর থেকে ঘরই তার পৃথিবী। কিন্তু তাই বলে ‘আমিও আয় করবো’ ভাবনাটা বাদ দেননি। ঘরে পড়ে থাকা কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি গ্রাফিক ও ওয়েব ডিজাইনে হাতেখড়ি নেন। বর্তমানে তিনি ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করে মাসে গড়ে ২৫ হাজার টাকা আয় করছেন।

আকবর হোসেন মনে করেন, আরও বেশি প্রশিক্ষণ পেলে কাজের পরিধি বাড়াতে পারবেন। তাছাড়া এই দক্ষতা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণও নিতে হয়। তার স্বপ্ন একটি ডিজাইন স্টুডিও খোলা। এ জন্য তিনি সরকারের কাছে সহযোগিতা চান। তিনি আরও মনে করেন সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইনভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করা হয় তাহলে তার মতো আরও অনেকের স্বপ্ন সহজে বাস্তবে রূপ নেবে। আকবর হোসেনের উদাহরণই প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে সামান্য কিছু প্রয়াস সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হলে জ্যোতি কিংবা তাহমিনাদের মতো আরও প্রতিবন্ধী নারী উপার্জনক্ষম হয়ে উঠতে পারবে। এর ফলে পরিবারের বোঝা থেকে তারা উত্তরণ পাবে। দেশের জিডিপিতেও অবদান রাখতে পারবে। এভাবেই সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।

শোষণের বিরুদ্ধে এবং শোষিতের পক্ষে আন্দোলনকারী আন্তোনিও গ্র্যামসি

জাহেদ খান

আঠারো শতকের শেষ ভাগে জন্ম নেওয়া এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইতালির সবচেয়ে সাহসী সাংবাদিকতার কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত আন্তোনিও গ্র্যামসির জীবনদর্শন এখনো অনেকের জীবনে প্রভাব রাখে। চিরকাল শোষণের বিরুদ্ধে এবং শোষিতের পক্ষে নির্ভীক কলমসৈনিক হিসেবে কাজ করে যাওয়া গ্র্যামসির জীবন নিয়ে প্রবল আগ্রহ রয়েছে অনেকের মধ্যেই।

আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। অসীম সমস্যা কাঁধে নিয়ে ছোট্ট গ্র্যামসি বেড়ে উঠেছেন। হার মানেননি নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কাছে। নতি স্বীকার করেননি নির্মম নিষ্ঠুর বাস্তবতা তথা দারিদ্র্যের কাছে। লড়াই চালিয়ে গেছেন নিজের ও সমাজের সঙ্গে। পরবর্তীকালে সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জনের পর লড়াই করেছেন স্বৈরাচারী শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে। বৈষম্যপীড়িত মানুষদের পক্ষে লড়াই করতে করতেই মানুষটি দেহ ত্যাগ করেন। 

নিপীড়িত শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে এবং কম্যুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার ফলে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরাগভাজন হন গ্র্যামসি। পার্লামেন্টে সদস্যপদ থাকা সত্ত্বেও ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে চরমপন্থী সরকার তাকে রোমে গ্রেপ্তার করে। অন্যায়ভাবে বিচারে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাদন্ড দেওয়া হয় তাঁকে। শোষিত শ্রেণির এতটাই বিরাগভাজন ছিলেন তিনি, এমনকি বিচারকার্য চলাকালীন এক প্রসিকিউটর উত্তেজিত হয়ে দাবি করেন, গ্র্যামসির মস্তিষ্ক যত নষ্টের গোড়া, তাই বিশ বছরের জন্য কর্মহীন করে দিতে হবে এই মস্তিষ্ককে। বিচারক কথা রাখলেন এবং গ্র্যামসির শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে আগ্রাহ্য করে ২০ বছর ৪ মাস ৫ দিনের জন্য কারাবন্দী থাকার রায় দেওয়া হয় বিচারে। ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই নেতাকে অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে ১৯২৮ সালের ৪ জুন এই সাজা দেওয়া হয় এবং মাত্র ৯ বছর পরেই ১৯৩৭ সালের ২৭ এপ্রিল কারাগারেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বৈষম্যপীড়িত মানুষের এই বন্ধু।  

কারাগারে বন্দীকালীন তিনি ডায়েরি লেখা শুরু করেন। তাঁর জীবনের ঘটনাবলি, চিন্তা-চেতনা, দার্শনিক আদর্শÑ সব ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ রাখেন। কারাগারে তাঁর ডায়েরিতে লেখা দর্শন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক বছর পর্যন্ত দিনের আলোয় আসেনি। তিনি কারাগারে বসে প্রায় ৫০০ চিঠি লিখেছিলেন। ফ্যাসিবাদের উত্থান, বামদের জয়জয়কার, পশ্চিমা পৃথিবীর স্বৈরাচারী মনোভাব, সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ ও বৈশ্বিক মাত্রা এবং তাঁর সমাজতান্ত্রিক দর্শন সে সময়ে প্রচন্ড আলোড়ন তোলে। তাঁর লেখা রাজনৈতিক দর্শনে নতুন বাস্তবতা এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। 

গ্র্যামসির মৃত্যুর তেরো বছর পর ১৯৫০ সালের শেষের দিকে তাঁর লেখাগুলো প্রকাশ হতে শুরু করে এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়।

ইতালির সারডিনিয়ায় ১৯৮১ সালের ২২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণকারী আন্তোনিও গ্র্যামসির ছেলেবেলা কেটেছে চরম দারিদ্র্যে। তাঁর পিতা অন্যায়ভাবে জালিয়াতির অভিযোগে ১৮৯৭ সালে ৫ বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভাবে মা, ভাই, বোনকে নিয়ে বিপদে পড়েন গ্র্যামসি। তাই অর্থ উপার্জনে নামতে হয় তাঁকে। বাবা কারাগার থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর উপার্জিত অর্থেই চলেছে পরিবার। এগারো বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে গ্র্যামসি ট্যাক্স অফিসে দুই বছর কাজ করেন। তাঁর বাবার ৫ বছরের অনুপস্থিতির কারণে পরিবারকে নিয়ে টিকে থাকার জন্য প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। গ্র্যামসির মেরুদন্ডে সমস্যার কারণে তিনি কুঁজো হয়ে চলাফেরা করতেন। ধারণা করা হয়, জন্মের সময় আয়ার হাত থেকে পড়ে গিয়ে মেরুদন্ডে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। ফলে তিনি দীর্ঘদেহী ছিলেন না। উচ্চতায় তিনি ৫ ফুটের কম ছিলেন।

দুর্দশা আর দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে তিনি বিদ্যালয়ে ভালোভাবে শিক্ষার সুযোগ না পেলেও জ্ঞান আহরণের নেশা তাঁকে সব সময়েই প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। ছাত্র হিসেবে বেশ মেধাবী ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি নিজ প্রচেষ্টায় পড়াশোনা অব্যাহত রেখে স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে ভালো গ্রেড অর্জন করেন। 

তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ আসে তাঁর। যদিও দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যগত কারণে পড়াশোনা করতে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাঁর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি বিপ্লবী কারখানা পরিষদের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়ান। 

১৯১৫ সালে একজন প্রতিশ্রুতিশীল একাডেমিক স্কলার হওয়া সত্ত্বেও গ্র্যামসি পিএসআইয়ের সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন এবং সাংবাদিকতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি তুরিন এডিশনে নিয়মিত কলাম লিখতেন, যা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জটিলতা নিরসনের দাবি

অপরাজেয় ডেস্ক

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও সম্ভাবনাবিষয়ক এক আলোচনা সভা আয়োজন করে খুলনা মহানগর প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ। প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত হোক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিপাদ্যে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এর আয়োজন করে সংস্থাটি। সভার শুরুতে আয়োজিত র‌্যালিটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভবনে গিয়ে শেষ হয়।

স্বাগত বক্তব্যে আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের ভর্তিসংক্রান্ত সমস্যা তুলে ধরে তা সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান। এ সময় তিনি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার দাবি জানান। খুলনা মহানগর প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আ. সালাম হাওলাদারের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন অধ্যাপক ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালক শরীফ হাসান লিমন। বক্তব্য প্রদানকালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জটিলতাহীন ভর্তির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেন। সভায় মূল নিবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র নাজমুস সাকিব। তিনি এ সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের ইতিবাচক দিকসমূহ তুলে ধরে এ দেশের প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বৈষম্য রোধের আহবান জানান।

আরও বক্তব্য দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী নজরানা ইয়াসমিন হীরা, জেলা জাসদ সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক স ম রেজাউল করিম, কেএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক আফরোজা আক্তার মনজু প্রমুখ। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

স্থাপত্য নকশায় পুরস্কৃত আগা খান মসজিদ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়

মাহমুদুল হাসান

কয়েকজন বন্ধু মিলে স্থাপত্য নকশায় পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। একজন নারী স্থপতি আধুনিক স্থাপত্য ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়ে মসজিদটির নকশা করেছেন। ঢাকার দক্ষিণখানের ফয়েদাবাদে অবস্থিত এই মসজিদের নাম বায়তুর রউফ। স্থপতির নাম মেরিনা তাবাসসুম। স্থাপত্য নকশায় অভিনবত্বের দরুন ‘আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক’ মেরিনাকে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার ২০১৬ এ পুরস্কৃত করেছে।

একটি টেলিভিশন প্রতিবেদন থেকে মসজিদটি সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। মসজিদের কোনো মিনার নেই, গম্বুজ নেই, মিহরাব নেই। কিন্তু মসজিদের ভেতর প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা আছে। নানান বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের কথা জেনে মসজিদটিতে যেতে আগ্রহী হয়েছিলাম।

আমাদের বন্ধু জামাল। সে হুইলচেয়ারসহকারে চলাফেরা করে। আমাদের মসজিদ দর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা শুনে সেও অনেক উৎসাহ নিয়ে যেতে চাইল। তার চলাচলে হুইলচেয়ার যাতায়াতের সমস্যার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়। কিন্তু আধুনিক স্থপতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার মতো নকশাকৃত এ মসজিদে প্রবেশগম্যতায় বাধা পেতে হতে পারে, তা ভাবনাতেই আসেনি।

কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারে উল্টো। জামালকে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে গিয়েই বিপত্তির শুরু। রাস্তা থেকে মসজিদে ওঠার জন্য সিঁড়ির পাশাপাশি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য যেমনটি থাকতে হয়, তেমন কোনো ঢালু পথ (র‌্যাম্প) ছিল না। বাধ্য হয়েই দুজন ধরে হুইলচেয়ারসহ তাকে মসজিদ পর্যন্ত ওঠালাম। অসুবিধার মাত্রাটা চরমে পৌঁছল যখন জামাল বলল, তার টয়লেটে যেতে হবে। সেই সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে গুগল ম্যাপ অনুসরণ করে কখনো পথ হারিয়ে, কখনো লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে, নানা অলিগলি পেরিয়ে মসজিতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা লেগেছে। টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হওয়াটাই স্বাভাবিক। জামালকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে টয়লেট দেখতে গেলাম। একটা সরু পেসেজ দিয়ে অজুর জায়গা পার হয়ে টয়লেটে যেতে হয়। দুটো মাত্র টয়লেট। নিচু কমোড। যার কোনোটাই হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকা বা ব্যবহার করার উপযোগী করে তৈরি করা হয়নি। গম্ভীর মুখে ফিরে এলে জামাল বলল, আমাকে বাইরে রেখে তোরা ভিতরে নামাজ পড়ে আয়। আমি বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে নেব। তার কথা শুনে আমার প্রায় কান্না চলে এলো।

গণস্থাপনাগুলো প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য প্রবেশগম্য করে তৈরি করা হয় না। এটা আমাদের অদূরদর্শিতা ও সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছু নয়। উন্নতির যুগে, এটা আমাদের অনুন্নতির উদাহরণ। নিজের ঘর ছাড়া যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। সেদিন সকালে জামালকে নিয়ে ধানমন্ডির স্টার রেস্টুরেন্টে নাশতা করতে গিয়েও একই সমস্যা হয়েছিল। রাস্তা থেকে নিচতলার ডাইনিং হলে অথবা লিফট পর্যন্ত যেতে আনুমানিক দশ ধাপের একটা সিঁড়ি বাইতে হয়েছিল। বেশ প্রশস্ত সেই সিঁড়ির এক পাশে একটা ঢালু পথ তৈরি করলে কী সমস্যা হতো? জামালকে কষ্ট করে ওঠাতে দেখে আশপাশের অনেকেই বলছিল, তার জন্য বাসায় নাশতা নিয়ে গেলেই তো হতো? এই কথা শুনে আমি অবাক হয়েছি। আমাদের মনমানসিকতা কতটা সুবিচারবিরোধী? আমার মতে, এটা অপ্রতিবন্ধী মানুষের মানসিক দৈন্যতা। এই আধুনিক সময়ে কীভাবে আমরা এ রকম ভাবতে বা বলতে পারি?

একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় খেতে পারবে না?

মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ পড়তে পারবে না?

আমরা অপ্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রতিবন্ধী মানুষদের ইচ্ছা, ভালো লাগা বা অধিকারের কথা চিন্তা করব না? এটা কীভাবে হয়?

যাহোক, আমরা জামালের হুইলচেয়ারকে কখনো সোজা, কখনো আড়াআড়ি, কখনো একটু উঁচু করে টয়লেট পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। একটু প্রশস্ত পথ, কয়েকটি উঁচু-নিচু ধাপ ঢালু করে তৈরি করলেই এই সমস্যায় পড়তে হতো না। তারপর আসে অজুর স্থান। ছোট ও নিচু বেশ কিছু বসার জায়গায় পানির ট্যাপ দিয়ে সবার জন্য অজু করার ভালো ব্যবস্থা থাকলেও জামালের পক্ষে সেখানে পৌঁছা সম্ভব ছিল না। হুইলচেয়ারকে পানির ট্যাপ পর্যন্ত নেওয়াই যায় না। একটা বসার জায়গা ফাঁকা রেখে হুইলচেয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য উচ্চতায় একটা ট্যাপে পানির ব্যবস্থা থাকলে এবং একটা অতিরিক্ত মগের ব্যবস্থা থাকলে জামালের মতো যে কেউ নিজের অজু নিজেই করে নিতে পারত। একটা খোলা জায়গায় আলাদা পানি এনে দিয়ে ওকে অজু করাতে হলো। তারপর আবারও এক ধাপ নিচে নেমে (র‌্যাম্প ছাড়া) মসজিদে প্রবেশ করতে হলো।

আমার মতে, মসজিদটির স্থাপত্য পরিকল্পনায় নতুন ধারণার দিকে যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, সেই তুলনায় প্রার্থনার জন্য সকলের সম-অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধার দিকে কোনো মনোযোগেই দেওয়া হয়নি। বরং বলা যায়, অবহেলাই করা হয়েছে। মনে হয়েছে, এই স্থাপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এর প্রবেশগম্যতা। কেননা, স্থাপত্য পরিকল্পনায় মসজিদের সামগ্রিক উৎকর্ষের বিষয়টি ছিল না। শুধু স্থাপত্যশৈলীর দিকেই মনোযোগ ছিল। আমি যতটুকু বুঝি, যেকোনো আধুনিক স্থাপনা যদি গণস্থাপনা হয়, তাহলে সেটা কতটা ভালোভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখাটা মৌলিক। বিশেষ করে হুইলচেয়ারের প্রবেশগম্যতা না রাখাটা রীতিমতো চিন্তা ও মানসিক সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক। এই আধুনিক জীবন, সমাজ ও স্থাপত্যে যা একবারেই অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য।

হয়তো মসজিদ বলেই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের চিন্তা মেরিনা তাবাসসুমের বিবেচনায় আসেনি। অথবা, বাংলাদেশ বলেই এই দিকটা অবহেলা করা হয়েছে। পুরস্কারদাতা আগা খান, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে স্থাপত্য নকশার দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে, শুধু নির্মাণশৈলীকে বিচারে এনেই এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

আমার অভিজ্ঞতায়, এ দেশের মসজিদগুলোতে শুধু নামাজের জায়গাটাতেই ফোকাস করা হয়। মসজিদে প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথে, টয়লেট আর অজুর জায়গাতে মনোযোগ দেওয়াই হয় না। নারী-শিশু-বৃদ্ধ, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের সুবিধার বিষয়ে চিন্তা করা তো দূরের ব্যাপার। বায়তুর রউফ মসজিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

আমাদের আগ্রহের কেন্দ্র ছিল বলেই এত দূর থেকে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছিলাম। কিন্তু, পরিকল্পিতভাবে নির্মিত মসজিদেও সাধারণ সব দুর্বলতা রয়ে গেছে বলে আমরা দারুণভাবে আশাহত হয়েছি। যাহোক, সর্বস্তরের মুসল্লিদের সুবিধা এবং আধুনিক স্থাপত্য ও সমাজচিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে অজু-ইস্তিঞ্জার জায়গা তৈরি করলে হয়তো কোনো পুরস্কারও পাওয়া যেত না। তারপরও মনকে মানাতে পারছিলাম না। নামাজ শেষে বন্ধুকে বলেছিলাম, এই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসে তোকে নিয়ে যে পরিমাণ টানাহেঁচড়া করতে হলো, মেরিনা তাবাসসুমকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসা করা দরকার, আপনি না হয়ে এই মসজিদটা যদি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী আমেরিকান স্থপতি মাইকেল গ্রাভস ডিজাইন করতেন, তাহলে মসজিদটা কেমন হতে পারত?

ঋতুকালীন পরিচর্যায় গোপনীয়তা নয়; জানতে হবে, খোলামেলা বলতে হবে

নিশাত আফরোজ

এখনই সময়! কুসংস্কারের দেওয়াল ভেঙে
আসুন, একসাথে এমন পৃথিবী গড়ে তুলি
যেখানে ঋতুকালীন অব্যবস্থাপনায়
আর কোনো মেয়ে পিছিয়ে পড়বে না।।

‘এখনই সময়’ এই প্রতিপাদ্যে গত ২৮ মে পালিত হলো বিশ্ব ঋতুকালীন পরিচর্যা দিবস ২০১৯। এদিন দেশজুড়ে আলোচিত হলো ঋতুকালীন অব্যবস্থাপনায় কোনো মেয়ে যেন আর পিছিয়ে না পড়ে। কিন্তু প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীদের সমস্যা ও আলোচনা বাদ দিয়ে।

এ-সংক্রান্ত জাতীয় পর্যায়ের সরকারি বেসরকারি কোনো আয়োজনেই প্রতিবন্ধী নারীদের ঋতুকালীন পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয় বিষয় আলোচনায় আসেনি। বিশেষত প্রতিবন্ধিতার ধরন ও গুরুতর মাত্রার চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী নারীদের ঋতুকালীন সমস্যা এবং তা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেই, এমনকি সাধারণ নারীদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোরও।

এদিন বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সচেতনতা তৈরিতে সবার সমন্বয়ে কাজ করার তাগিদ দেওয়া হয়। বলা হয় সচেতনতার কাজটি শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। নিজের ঋতুকালীন সমস্যা ও অভিজ্ঞতাগুলো বাবা-মা ছাড়াও বিদ্যালয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। বেশি বেশি আলোচনার মধ্য দিয়ে সবার কাছে সহজ করতে হবে বিষয়টি। নতুবা এ বিষয়ে কুসংস্কার কাটবে না। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কখনো হবে না।

ঋতুচক্র কোনো রোগ নয়, বরং প্রজনন বা জন্মধারা পদ্ধতির একটি প্রক্রিয়া। ঋতুকালীন স্বাস্থ্য, অধিকার সুরক্ষার বিষয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া গোপনীয়তার জায়গা থেকে বিবেচনা করে সংকোচ ও লজ্জার কারণে সামাজিক ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে। ট্যাবু মানে হলো তথ্যের অভাব। যখন কোনো প্রচলিত নিয়ম বা সংস্কার ট্যাবুতে পরিণত হয় তার সঙ্গে কোনো না কোনো ভুল তথ্য বা কুসংস্কার জড়িয়ে যায়। ফলে নানা অজ্ঞতা ও অব্যবস্থাপনায় নারীদের প্রজননক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন নারীরা। পত্রপত্রিকায় দেখা যায় আমাদের দেশে এখনও শতকরা ৮০ জন নারী অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করেন এ সময়। অসচেতনতা এবং সঠিক শিক্ষা ও ধারণার অভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের কিশোরী ও নারীদের ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। প্রান্তিক নারীদের মধ্যে বৈষম্যপীড়িত অবস্থায় রয়েছেন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীরা। কারণ, এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে সরকারি বা বেসরকারি সেবা প্রদানকারী কর্মসংগঠনগুলো কারোর আলোচনাতেই নেই প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীরা।

এমনকি প্রতিবন্ধী নারীরা নিজেরাও এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে অনাগ্রহী। এ জড়তা ভাঙতে এবং নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে দলগত আলোচনার আয়োজন করে বি-স্ক্যান। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী নারীরা নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে।

বিষয়টি অনস্বীকার্য, অপ্রতিবন্ধী নারীদের চেয়ে আমাদের প্রতিবন্ধী নারীদের ঋতুকালীন পরিচর্যা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। আমাদের প্রতিবন্ধিতার বৈচিত্র্যতার কারণে চাহিদাও ভিন্ন ভিন্ন। গুরুতর পর্যায়ের অটিস্টিক নারী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী, মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারী, মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী নারী, মাস্কুলার ডিস্ট্রফি প্রতিবন্ধী নারীসহ যাদের হাত নেই এবং অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য এ সময়টি আরও বেশি মানসিক চাপ ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত যাদের সব কাজের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। মানসিক ও শারীরিক চাপে অতিবাহিত হয় তাদের সময়গুলো। আবার কিছু পুরোনো কুসংস্কার, অজ্ঞতা, লজ্জা বা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বেশির ভাগ পরিবার স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করতে দেন, যা মোটেও নিরাপদ নয়। তবে স্যানিটারি প্যাডের মূল্য নাগালের বাইরে হওয়ায় বহু পরিবারও এই ব্যয় বহন করতে পারে না। এ ছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী নারীই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ দেশে প্রতিবন্ধী নারী ও তার পরিবার ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে চরম অবহেলিত করে রেখেছে। নিয়ম অনুযায়ী ছয় ঘণ্টা পরপর ন্যাপকিন পরিবর্তন করতে পারেন না তারা। ঘা, ইনফেকশন, অ্যালার্জি ইত্যাদি তাদের নৈমিত্তিক সমস্যা, যা অবস্থানভেদে অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করে। স্যানিটারি ন্যাপকিন বা কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করলে, নির্দিষ্ট সময় পরপর তা বদলানো ও পরিষ্কার করা, রোদে শুকানো বা ডিসপোজ ইত্যাদি বিষয়ে কেউ সচেতন নন। নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে এক প্রতিবন্ধী নারী বলছিলেন, কৈশোরে ব্যবহৃত কাপড়টি ধুয়ে ঘরে কাপড় রাখার আলনার পেছনের কোণে শুকোতে দিতেন তিনি। পরে সেই কাপড়ই মাসখানেক পর আবার ব্যবহার করতেন। কেউ কাপড়ের ওপর তুলো ব্যবহার করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একই কাপড় ব্যবহার করেন। একজন জানালেন সহকারীর সাহায্য ছাড়া তিনি নিজে কিছু পারেন না, তাই ন্যূনতম দশ ঘণ্টা প্যাড পরিবর্তন করেন না, সময়ভেদে তা বারো ঘণ্টাও রাখতে হয়। অন্যের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে সমস্যা হয় জেনেও সহ্য করেন। ফলাফল র‌্যাশ, ঘা এবং দুর্বিষহ যন্ত্রণা। এ জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যায় কিংবা নেওয়া জরুরি এ বিষয়েও জানেন না তিনি।

আলোচনার সারমর্ম

উপস্থিত সবাই একমত হলেন, শুধু আলোচনা করলেই হবে না। প্রতিবন্ধী নারীদের ঋতু পরিচর্যা ব্যবস্থাপনায় কর্মসূচি গ্রহণের এখনই সময়। তাই এই দলগত আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, তারাও এ বিষয়ে কাজ শুরু করবেন কাছের মানুষদের মাধ্যমে। নিজ পরিবার, বন্ধু ও পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গেও খোলামেলা আলোচনা হবে। যেন সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তিতে আরও সংঘবদ্ধভাবে অন্যান্য প্রতিবন্ধী নারী ও তাদের পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অভিভাবকদের যথাযথ পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে নিজের কন্যাসন্তানের ঋতুচক্র শুরুর আগেই এ বিষয়ে ধারণা এবং নিরাপদ ও সহজলভ্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা গ্রহণে সচেতন থাকেন তারা। তা ছাড়া আলোচনায় অংশগহণকারীরা মনে করেন, গুরুতর পর্যায়ের প্রতিবন্ধী মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। তাদের সহকারী বা যত্নকারীদের সরকারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও কাজ করা দরকার। পাশাপাশি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী বা অটিস্টিক নারীদের জন্য সঠিক নিয়মাবলি শেখাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্যানিটারি ন্যাপকিনের মূল্য নির্ধারণে সরকার সতর্ক ও সচেতন নজর রাখবেন এমনটাই আশা করেন তারা। বিশেষ করে তৃণমূল ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে প্রজনন এবং ঋতু পরিচর্যা সেবা দেওয়া এবং স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করা যেতে পারে। জনওকালতি ও প্রচারণার পাশাপাশি নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনন্য অবদান রাখতে পারে।

কেবলই শুভংকরের ফাঁকি; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বরাদ্দ নেই

জাতীয় বাজেটের আকার বছর বছর বৃদ্ধির ধারা অক্ষুন্ন রেখে জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এবার বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, শুধু এক বছরের জন্য নয়; বস্তুত এবারের বাজেট তৈরি করা হয়েছে ২০৪১ সালকে লক্ষ্য করে। যদিও প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারভিত্তিক বরাদ্দ বিবেচনায় না রেখেই বাজেট করেছে সরকার। এমনকি ভাতাকেন্দ্রিক হতে গিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান প্রভৃতি খাত এড়িয়ে গেছে সরকার।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর আওতায় ২০১৯ সালের প্রথম মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্যেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। একই প্রক্রিয়ায় ২০১৫-২০১৬ বাজেটে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত এর জন্য করছাড়ের সুযোগ থাকলেও তার বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কোনো তথ্য পরবর্তী সময়ে আমরা পাইনি। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষকে নিয়োগ দিলে করছাড়ের সুযোগ আদৌ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে বলা মুশকিল। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৩ থেকে ২০১৯ ছয় বছরব্যাপী দেশজুড়ে খুঁজে ফিরে ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৪ জন প্রতিবন্ধী মানুষকে শনাক্ত করতে পেরেছে, যার হার মাত্র ১ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন এসেই যায়, বেসরকারি খাতে ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের নিয়োগে করছাড়ের নিয়মটি কি লোক  দেখানো?

সংবিধানমতে, বাজেট হবে জনসাধারণের মতামদের ভিত্তিতে। কিন্তু দেখা যায় বাজেট প্রণয়ন বিষয়টি সরকারি আমলা এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। যদিও অর্থমন্ত্রী প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাদাভাবে মতবিনিময় করেন। সবার চাহিদা মন দিয়ে শোনেন! কিন্তু অঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী ঘণ্টাকালব্যাপী সেই আলোচনার কোনো প্রতিফলনই দেখা যায় না বাজেট ঘোষণার পর। প্রতিবছর বাজেট নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে আগ্রহের সঞ্চার হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের প্রভাবকে ঘিরে। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের আগ্রহ থাকে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে। অর্থনীতিবিদেরা নানা বিশ্লেষণে সরব হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ের আশায় বিভিন্ন অনালোকিত ইস্যু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকারের দাবিতে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে সরকারের দৃষ্টিপাতের চেষ্টায় ব্রতী হয়। কিন্তু তাতে আমাদের কী আসে যায়। বৈষম্যের নাগপাশে আবদ্ধ রাষ্ট্রকাঠামো থেকে আসলে কতটুকু সুবিধা আমরা পাচ্ছি! আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি কীভাবে সম্ভব? এসব কি আছে কারও ভাবনায়!

আমরা, রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে থাকা মানুষদের অন্যতম। যেমন জাতীয় সংসদে আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সিআইপি বা সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষদের দেখা মেলে না। এমনকি ব্যবসাসফল প্রতিবন্ধী মানুষের খোঁজ পেতে হলে দুরবিন বা মাইক্রোস্কোপের আশ্রয় নিয়েও খুব একটা লাভ নেই। বরং তা সর্বজনবিদিত, একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার লড়াই বা অপমানের সম্মুখীন হওয়ার ঘটনা ভুরিভুরি। ব্যাংকঋণ পাওয়া বহুদূরের কথা। তাই শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত প্রতিবন্ধী মানুষের শেষ ভরসা চাকরি, আরও স্পষ্ট করে বলা যায় সরকারি চাকরি। সমাজের মোটের ওপর দৃষ্টিভঙ্গি যখন প্রতিবন্ধী মানুষ পারে না, পারবে না, পরিবারের এক কোণে ফেলে রাখা যায়; তখন বেসরকারি চাকরি সে এক অলীক স্বপ্নের মতো।

তার ওপর সরকারি চাকরিতে কোটা থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগের বিষয়ে সরকারি ও প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে পরস্পরবিরোধী দাবি রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিবন্ধী মানুষের চাকরির বিষয়ে কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। সর্বোপরি সঠিক শনাক্তকরণ থেকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক অন্তর্ভুক্তি নেই প্রতিবন্ধী মানুষদের।

সরকারের পরিকল্পনাতেও প্রতিবন্ধী মানুষদের কল্যাণমুখী পদক্ষেপই গুরুত্ব পায় বেশি। প্রতিবন্ধী মানুষের বাজেট বরাদ্দের সিংহভাগই সামাজিক নিরাপত্তা খাতসংশ্লিষ্ট অর্থাৎ ভাতানির্ভর। ৩০ বছর আগে যেখানে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষের ঠিকানা ছিল দারিদ্র্য বা অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে, সেখানে তিন দশকে তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও জীবনমানের গতি পরিবর্তন সূচিত হলেও বরাদ্দের চিত্র একই রয়ে গেছে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মোট বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ ২৭.৪ শতাংশ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি মৌলিক খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা খাতে প্রতিবছরই বাড়ছে বরাদ্দ। কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা সর্বোপরি গুণগত শিক্ষার বিকাশে কোনো রূপ বরাদ্দ বাড়ছে না। যেমন শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের ব্রেইল চাহিদা বৃদ্ধি এবং গণিত শিক্ষা পদ্ধতি সহজীকরণসহ গুরুতর শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য শিক্ষা উপকরণ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে কোনো পদক্ষেপ বা গবেষণার জন্য বরাদ্দ নেই। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে একীভ‚ত শিক্ষা বলতে প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষা উপকরণ বা বিদ্যালয়ে র‌্যাম্প স্থাপনে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের একীভুত শিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক উন্নয়নে কোন দিকনির্দেশনা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মেলেনা।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হিসেবে যোগাযোগ (সড়ক, পরিবহন, সেতু, রেল ও যোগাযোগ-সম্পর্কিত বিষয়) খাতে ২৬ শতাংশ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য উপযোগী বাস, ট্রেন, লঞ্চ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, বাস স্টপেজ, লঞ্চ টার্মিনাল, ওভারব্রিজ, ফুটপাত করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাজেট বক্তৃতায় নেই। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা খাত নির্ভরশীল গতানুগতিক বাজেট জুটছে প্রতিবন্ধী মানুষের ভাগ্যে।

প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কাগজ-কলমে ও মৌখিক আশ্বাসের ফুলঝুরির ছড়াছড়ি প্রচুর। অর্থ বরাদ্দের সময়ই জোটে কেবল শুভংকরের ফাঁকি। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নের নামে কাঁঠালের আমসত্ত¡ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা আর কত দিন চলবে? অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী বিশেষত সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী সর্বোপরি রাজনীতিবিদদের কাছে প্রশ্ন, আমাদের সঙ্গে এই অবস্থা বিরাজমান থাকুক, তাই কি চান আপনারা?

নারী ও শিশু বান্ধব বাজেট প্রণয়নের মতো প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারনির্ভর মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব উন্নয়নবাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে কন্ঠ মেলাবেন, নাকি ঝিমিয়ে দিনাতিপাত করবেন!

Translate | অনুবাদ