প্রতিবন্ধী নারীদের গণশুনানি; প্রবেশগম্য বাস আমদানির আশ্বাস বিআরটিসির

অপরাজেয় ডেস্ক

স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পরেও প্রতিবন্ধী মানুষের উপযোগী প্রবেশগম্য গণপরিবহন ও ফুটপাত নেই। সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। এ নিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজমান।

অন্যদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) ও ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এ বিষয়ে নিজেদের অপারগতা জানিয়ে ভবিষ্যতে নতুন করে বাস আমদানির উদ্যোগ নেওয়া এবং সড়ক ব্যবস্থাপনা মানুষের উপযোগী করে তোলার আশ্বাস দেন।

বিশ্ব প্রবেশগম্যতা সচেতনতা দিবস ২০১৯ উপলক্ষে গত ১৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে এই গণশুনানির আয়োজন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্স প্রকল্পের অর্থায়নে গণপরিবহনে প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থান শীর্ষক এই গণশুনানিতে উপস্থিত প্রতিবন্ধী মানুষ বিশেষত প্রতিবন্ধী নারীরা স্বাধীন চলাচল ও যাতায়াতের প্রেক্ষাপট এবং সরকারি বেসরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে প্রবেশগম্য যানবাহন এবং সচেতনতার অভাবে গণপরিবহনে তাদের ভোগান্তি এবং সাধ্যের অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয় তুলে ধরেন। এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিসি এর ব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য উপযোগী বাস নতুন করে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে আরও চারটি বৃদ্ধি করে তেরোটি আসন করা হয়েছে। এ সময় তিনি জানান, বিআরটিসি এবং বিআরটিএ এর নতুন চালক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সচেতন হবার বিষয়টি উল্লেখ আছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) প্রকল্প পরিচালক (ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং) নাসিরুদ্দিন তরফদার (উপসচিব) বলেন, বিআরটি ও এমআরটিকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে প্রতিবন্ধী মানুষদের উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় অযান্ত্রিক বাহন ( রিক্সা) সংরক্ষিত করার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত বিবেচনা করা হবে। বাসে প্রতিবন্ধী যাত্রীরা রেয়াতি ভাড়ায় ছাড় পায় না। এ বিষয়ে সমাজসেবায় অভিযোগ করলে তারা পরিবহন মালিকদের জানাতে বলে, অন্যদিকে পরিবহন মালিকেরা দায় এড়িয়ে যায়। এ বিষয়ে করণীয় জানতে চাইলে জনাব মোস্তাফিজুর রহমান বিআরটিসির হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করতে বলেন।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর দপ্তর সম্পাদক ফিরোজ আলম, প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিসচার একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ যাতায়াতব্যবস্থার দাবিকে সংহতি জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার প্রতিবন্ধী মানুষের উপযোগী গণপরিবহন ও যাতায়াতব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার তাগিদ দিয়ে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এআরআই এ বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী।

সমাপনী বক্তব্যে বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘বাদ যাবে না একজনও’ এ বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১১.২ এ অরক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী মানুষ এবং বয়োবৃদ্ধ মানুষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যানবাহনব্যবস্থার সম্প্রসারণের মাধ্যমে সবার নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সুলভ এবং টেকসই পরিবহনব্যবস্থায় সবার অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অথচ প্রায় আট বছর ধরে বিআরটিসির সঙ্গে জনওকালতির পর আজও এ সমস্যা সমাধানে বিআরটিসি এবং সরকারের পদক্ষেপসমূহ দুর্বল। সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রবেশগম্য বাস আমদানিতেও বাসমালিকদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা নেই।

উপস্থিত প্রতিবন্ধী মানুষদের আরও অভিযোগ ছিল পরিবহন শ্রমিকদের অসচেতনতা ও অসহযোগিতার কারণে গণপরিবহনে যাতায়াতে বিপত্তি এবং সংরক্ষিত নারী আসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, বাসগুলো সঠিক জায়গায় দাঁড়ায় না। প্রায়ই চলন্ত বাসে ওঠানামা করতে হয়। অনেকেই এভাবে বাসে উঠতে না পারায় রিকশা বা সিএনজিতে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করে চলাফেরা করেন। প্রতিবন্ধী নারীরা গণপরিবহনে যৌন সহিংসতা বন্ধ করতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে আরও বলেন, সব বাসই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের উপযোগী করা দরকার।

এদিন গণশুনানিতে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে অংশ নেন উইমেন উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউডিডিএফ) নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্দীন হলের হল সাংসদ শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নাঈম মোল্লা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী রেবেকা মুন্সি সীমা, কর্মজীবী শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী সানজিদা আক্তার, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সগীর হোসাইন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারী হাওয়া আক্তার, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী তনিমা প্রমুখ।

১০% প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়োগে প্রতিষ্ঠানের ৫% কর মওকুফ

অপরাজেয় প্রতিবেদক

কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট কর্মীর ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার ভিত্তিতে প্রদেয় করের পাঁচ শতাংশ মওকুফ পাবে। অন্যদিকে সরকার প্রদত্ত বিশেষ সুবিধাসমূহ প্রতিবন্ধী মানুষদের দেওয়া না হলে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় করের অতিরিক্ত ৫ শতাংশ কর দিতে হবে সরকারকে।

অন্যদিকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতায়াত ও সেবা গ্রহণে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা না করলে অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল । তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এই ঘোষণা এলেও ২০২০-২১ করবছর থেকে তা কার্যকর করা হবে বলে জানান তিনি।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের স্বার্থ সুরক্ষায় আয়করেও এর ধারাবাহিকতা আমরা বজায় রাখতে চাই। এ বিবেচনায় কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট জনবলের ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষকে কর্মসংস্থানের অধিকার নিশ্চিত করে নিয়োগ দিলে সে প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় করের পাঁচ শতাংশ কর রেয়াত প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

বাজেট বক্তৃতায় কামাল বলেন, গতবছর চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের যাতায়াত ও সেবা গ্রহণে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা না রাখলে অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের বিধান করা হয়েছিল।

“এ বছরে এর আওতা বাড়িয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিওতে এ বিধান আরোপের প্রস্তাব করছি। তবে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যাতে সুবিধা স্থাপনের প্রয়োজনীয় সময় পায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ২০২০-২১ করবছর হতে নতুন আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ বিধান কার্যকর হবে।”

দেশে ১৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শনাক্ত করার তথ্য গতবছর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

রাজধানীর গণস্থাপনায় সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার বেহাল চিত্র

অপরাজেয় প্রতিবেদক

রাজধানীর বিদ্যালয় এবং গণস্থাপনাসমূহে সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার বেহাল চিত্র মিলেছে।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য র‌্যাম্প, প্রবেশগম্য টয়লেট এবং লিফট বা প্ল্যাটফর্ম লিফট রাখতে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ বিদ্যালয় এবং স্থাপনায় তা দেখা যায়নি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য পর্যাপ্ত টেকটাইল ব্লক এবং করিডর গাইড রেলিং নেই। স্বল্পদৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য আসবাবপত্রের সঙ্গে মেঝে বা পারিপার্শ্বিক জিনিসপত্রে সঠিক রঙের ব্যবহার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও শ্রবণযোগ্য (অডিবল) নির্দেশনা রাখা হয়নি।

শেরেবাংলা নগর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, কল্যাণপুর বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মিরপুর বালিকা আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট ছাড়াও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নতুন ভবনে চালানো এক প্রবেশগম্যতা নিরীক্ষা গবেষণায় বিদ্যালয়গুলোর সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার এ বেহাল চিত্র পেয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন বি-স্ক্যান।

কিশোরী ও নারীদের সমাজে-অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সহিংসতা বিলোপে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহযোগিতায় নেদারল্যান্ডস সরকারের যৌথ প্রয়াসে বাস্তবায়িত গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্স প্রকল্পের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় সাত ধরনের প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণে সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার অবস্থানচিত্র নিয়ে এ গবেষণা হয়।

একজন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে স্থাপত্য প্রকৌশলী ও নির্মাণ প্রকৌশলী এবং দুজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী (হুইলচেয়ার ও ক্রাচ ব্যবহারকারী), দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী, স্বল্পদৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারী, মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী নারী এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের স্থাপনা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ভবনের চেয়ে বেশি প্রবেশগম্য। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবনসমূহ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেও প্রবেশ উপযোগী নয়।

কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী র‌্যাম্প বা প্রবেশগম্য টয়লেট দেখা যায়নি; টয়লেটগুলোর অবস্থাও খুবই অস্বাস্থ্যকর। দোতলায় ওঠার জন্য মিরপুর বালিকা আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট ছাড়া আর কোথাও লিফট বা প্ল্যাটফর্ম লিফটের ব্যবহার দেখা যায়নি। তবে এ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি পাওয়া গেছে; প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ২% কোটা নির্ধারিত রয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতে জোর দেওয়া বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক ফোকাল কর্মকর্তা সালমা জাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অপরাজেয়কে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন প্রবেশগম্য করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। কোনো বিদ্যালয়ে যদি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী ব্যবস্থা না থাকে এবং এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আমরা পাই, তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতে জোর দিলেও বিদ্যালয় ভবনগুলোতে এ মুহূর্তে টেকটাইল স্থাপনের পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) সহকারী প্রধান প্রকৌশলী বুলবুল আক্তার। তিনি জানান, বিদ্যালয় ভবনে টেকটাইল স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা এখনো নেই। তবে পুরাতন নিচতলা বিদ্যালয়গুলোর ভবন সংস্কার এবং ওপরতলা নির্মাণের সময় র‌্যাম্প এবং প্রবেশগম্য টয়লেট দেওয়া হবে।

অন্যদিকে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নতুন ভবনেই একমাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য টেকটাইল টাইলস এবং করিডোরে গাইড রেলিং ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবহারযোগ্য র‌্যাম্প, লিফট এবং সিড়ির সামনে এই টাইলস দেখা গেছে। তবে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপের সম্মুখভাগে স্বল্পদৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের ভিন্ন রং দেওয়া খুবই প্রয়োজনীয় হলেও ফাউন্ডেশনের ভবনে সেটি দেখা যায়নি। সিঁড়িতে বিভিন্ন তলার তথ্য টেকটাইলে লিখিত থাকলে শ্রবণ ও দৃষ্টি দুই ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষই তা পড়তে পারবেন। এ ছাড়া শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তথ্য প্রদানকারী ডেস্কগুলোতে বাংলা ইশারা ভাষার ব্যবহারের প্রচলন, বিভিন্ন তথ্যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা নিরক্ষর মানুষের জন্য নির্দেশনামূলক চিহ্নের ব্যবহার ছিল না এবং তথ্যকেন্দ্রে ব্যবহৃত ডেস্কের উচ্চতা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের উচ্চতায় ছিল না।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন নারী পোশাকশ্রমিকদের জন্য নির্মিত হোস্টেলটি মোটামুটি প্রবেশগম্য করা হয়েছে। র‌্যাম্প, লিফট, প্রবেশগম্য টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে কোনো টেকটাইল টাইলস স্থাপন করা হয়নি। এসব বিষয়ে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু তালেবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধে এবং এনডিডি মডিউলে বেশি জোর দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন উঠোন বৈঠকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে সচেতন করা হয়। প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি।

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নতুন ভবনের প্রকল্প পরিচালক খুরশিদ আলম চৌধুরী বলেন, যেকোনো সরকারি ভবনকে প্রবেশগম্য করতে দরপত্র আহ্বানের সময় সেই ভবনে যে যে ফিটিংসের প্রয়োজন হবে, সেটা বলে দিলে ভবনটি প্রবেশগম্য করা সহজতর হয়। তা ছাড়া সরকারি একটি মূল্যতালিকা রয়েছে, যার বাইরে কোনো জিনিস ক্রয় করা সহজ নয়। এই তালিকায় প্রতিবন্ধী মানুষের প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

‘কাজগুলো ছাড়া ছাড়া, সমন্বিত হচ্ছে না; প্রচারণারও অভাব’ – ডা. আশরাফী আহমেদ

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালনায় প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ-২০১৩ এর বর্তমান পরিস্থিতি, সংকট উত্তরণে পদক্ষেপ ইত্যাদি জানতে সম্প্রতি অধিদফতরের যুগ্ম সচিব ডা. আশরাফী আহমেদের মুখোমুখি হয় অপরাজেয়। গত ৬ বছরব্যাপী চলমান জরিপ কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি জানান, ২০১৩ সালের জুন থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৪ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর পরিচয়পত্র পেয়েছেন। (তথ্যসূত্র:https://www.dis.gov.bd/en/)। চলমান এ প্রক্রিয়ায় গড়ে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ প্রতিবন্ধী মানুষ হালনাগাদ হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নিজেই শনাক্তকরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সরকারি উদ্যোগ থাকলেও প্রচারণার অভাব, সমন্বয়হীনতা ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি, সঠিক শনাক্তকরণে জটিলতা এবং সেগুলো নিরসনে তাদের উদ্যোগ, সীমাবদ্ধতাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতায়।
সাক্ষাৎকার ও প্রতিবেদন  : শাহরিয়ার সাজ্জাদ

অপরাজেয়: প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপের প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের এ পর্যন্ত সফরটি সম্পর্কে কিছু বলুন।
আশরাফী আহমেদ: প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ প্রণয়নের পর প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যায় বিভ্রান্তি, প্রতিবন্ধিতার ধরন ও উন্নয়ন বিবেচনায় একটি শনাক্তকরণ জরিপের মাধ্যমে পরিচয়পত্র প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী ১২ ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষকে শনাক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে ১২টি উপজেলা ও দুটি ইউসিডিতে প্রাথমিক প্রকল্প পরিকল্পনা করে সমাজসেবা অধিদফতরের  তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন পর্যায়ে বাড়ি বাড়ি সমাজকর্মী পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রসমূহের পরামর্শকবৃন্দ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডাক্তারদের দ্বারা শনাক্তকরণের মাধ্যমে সনদ প্রদান করা হয়।
তবে আমাদের জরিপ কার্যক্রমের পদ্ধতি শতভাগ সঠিক হয়েছে বলা যাবে না। বিগত অর্থবছরের ভিত্তি অনুযায়ী ভুলভ্রান্তি ও কারিগরি সমস্যাগুলো সমাধান প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

অপরাজেয়: স্বল্পদৃষ্টি ও স্বল্পশ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই শনাক্তকরণ থেকে বাদ পড়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ করার ব্যবস্থা কি রয়েছে?
আশরাফী আহমেদ: কোনো অভিযোগ থাকলে শনাক্তকরণ যে কার্যালয়ে হয়েছে সেখানে জানিয়ে ডাক্তার দ্বারা দ্বিতীয়বার শনাক্তকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি একজন ডাক্তার হিসেবে বুঝি প্রতিবন্ধিতার মাত্রা পরিমাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের অডিওমিটার খুব বেশি নেই। শ্রবণক্ষমতা সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গড় হিসেবে অনুমানের ভিত্তিতে শনাক্ত হয়েছে। সঠিক শনাক্তকরণ না হলে ইউনিয়ন থেকে পর্যায়ক্রমে উপজেলা ও জেলা কার্যালয়ে জানানো যাবে।
প্রক্রিয়াটি চলমান, দ্বিতীয়বার ডাক্তারের মাধ্যমে সঠিক শনাক্তকরণের প্রয়োজন হলে করা যাবে। সমস্যা হলে আমাকে জানালে আমি ব্যবস্থা নেব।  

অপরাজেয়: যারা আপনার কাছে যেতে পারবেন না, বিশেষত তৃণমূল প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কী ব্যবস্থা?
আশরাফী আহমেদ: সমাজসেবা অধিদফতরের ওয়েবসাইটে আমাদের পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তার ফোন নাম্বার আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

অপরাজেয়: শনাক্তকরণের ব্যাপারে কি কোনো অভিযোগ পেয়েছেন? সে ক্ষেত্রে কিভাবে সমাধান করেছেন?
আশরাফী আহমেদ: যেসব অভিযোগ আসছে, বেশির ভাগই পরিচয়পত্র নিয়ে। শনাক্ত হয়নি এমন অভিযোগ পাইনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নিজেও শনাক্তকরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যেমন মস্তিষ্ক পক্ষাঘাতকে (সেরিব্রাল পালসি) বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শনাক্ত করা হয়। 

অপরাজেয়: সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দ্বারা শনাক্তের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের পরামর্শকদের মাধ্যমে শনাক্ত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আশরাফী আহমেদ: প্রতি জেলা ও উপজেলায় একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এ কাজে মনোনীত রয়েছেন। তবে শুধু জরিপের জন্যই সেবাকেন্দ্রের পরামর্শকদের ডাক্তার দ্বারা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সমস্যা অবশ্যই আছে, সমাধান নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে।

অপরাজেয়: কিছু স্থানে অডিওমেট্রিশিয়ান ছাড়া শনাক্তের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য?
আশরাফী আহমেদ: সব জায়গায় অডিওমেট্রিশিয়ান নেই। তা ছাড়া পরিচয়পত্র উদ্বোধনের তাড়াহুড়োর মধ্যে সে সময় পরামর্শকদের কিছু নির্ণায়ক বলে দেওয়া হয়েছিল।

অপরাজেয়: মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত (সেরিব্রাল পালসি) প্রতিবন্ধী মানুষদের কীভাবে শনাক্ত করছেন?
আশরাফী আহমেদ: মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত বলতে বলা হচ্ছে স্ট্রোক। স্ট্রোকে প্যারালাইজড ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাংশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন এর মধ্যে না আসায় আমাদের নীতিমালায় স্বীকৃত না। ডাক্তাররা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নির্ণয়ের উপায় বলে দিয়েছিল তবু মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী মানুষদের অনেক সময় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা হচ্ছে, আবার হাঁটা-চলার সমস্যা দেখে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে। আমি নিজেও জানি সমন্বয়ের সমস্যা রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের বড় আকারে সমন্বয় থাকতে হবে। সবই এগোচ্ছে তবে ছাড়া ছাড়া ভাবে।

অপরাজেয়: এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আশরাফী আহমেদ: গোড়াতেই ভুল হচ্ছে। তবে বড় ধরনের ভুল আমরা পাইনি। সূচনা ফাউন্ডেশন এ নিয়ে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা হচ্ছে।

অপরাজেয়: মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া?
আশরাফী আহমেদ: বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তুলনায় মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপস্থিতি বেশি না। মানসিক ডাক্তার দ্বারা করা উচিত হলেও সরকার মনোনীত ডাক্তারই করছেন।

অপরাজেয়: পরামর্শকেরা করছেন নাকি ডাক্তাররা?
আশরাফী আহমেদ: সব স্থানে ডাক্তার না থাকায় পরামর্শকেরাও কাজগুলো করছেন।

অপরাজেয়: শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্য সংগ্রহে বাংলা ইশারা ভাষায় সহযোগিতার জন্য তথ্যসংগ্রহকর্মী এবং সমাজসেবার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি?
আশরাফী আহমেদ: প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কর্মকর্তারা থাকতে চান না। তারা যোগদানের তিন মাস হলেই বদলির জন্য তদবির শুরু করেন; এ কারণেই কাজটা বেশ দুরূহ।

অপরাজেয়: মাঠপর্যায়ে জরিপকর্মীদের প্রতিক্রিয়া বা পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে কি?
আশরাফী আহমেদ: প্রধানমন্ত্রী পরিচয়পত্র বিতরণের পর থেকে অনেকেই দায়মুক্ত হয়ে আয়েশে আছেন। তারা মনে করছেন, অধিকাংশ কাজই ২০১৫ সালে হয়ে গেছে।

অপরাজেয়: কিছু ক্ষেত্রে শুনতে না পারার কারণে যারা বলতে পারেন না তাদের অর্থাৎ শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষদের শ্রবণ ও বাক অথবা বহুমুখী প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আশরাফী আহমেদ: ব্যক্তি নিজে বা পরিবারের কেউ যদি শনাক্ত করেন তাহলে সঠিক শনাক্ত করা হয়। আমি নিজেও বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আমার অনেক পরিচিত ডাক্তার রয়েছে, যাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি।

অপরাজেয়: অভিযোগ রয়েছে, সমাজসেবা কর্মীরা ফরম হারিয়ে ফেলেছেন?
আশরাফী আহমেদ: এটা দুঃখজনক। দেখুন, অনেক সময় কাজের চাপে বা ভুলে ফরম হারিয়ে যায়। তবে সতর্ক থাকাও দরকার।

অপরাজেয়: জরিপ নিয়ে প্রচারের পরিকল্পনা কি আছে?
আশরাফী আহমেদ: একটি তথ্যচিত্র আছে। বিটিভিতে মাঝেমধ্যে প্রচারণা হয়। অর্থ বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার ফলে নিয়মিত প্রচারণা এবং বেসরকারি চ্যানেলে প্রচার সম্ভব হচ্ছে না।

অপরাজেয়: জরিপের প্রচারণা বিষয়ে সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের ভূমিকা কী? এ বিষয়ে সমাজসেবার কোনো নির্দেশনা আছে?
আশরাফী আহমেদ: এই কেন্দ্রগুলো জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অধীনে হওয়ায় আমরা চিঠি দিয়ে তাদের সহযোগিতা চাইতে পারি। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের রদবদলের কারণে অনেকেরই জরিপ স¤পর্কে ধারণা থাকে না।

অপরাজেয়: কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ মারা গেলে, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
আশরাফী আহমেদ: মৃত ব্যক্তির তথ্য দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আত্মীয়স্বজন জানালে নিবন্ধন থেকে তার নাম বাতিল করা হয়।

অপরাজেয়: এই জরিপের আওতায় কি ফ্যামিলি ট্রি (একই বংশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা) করা হচ্ছে?
আশরাফী আহমেদ: না। তবে বংশে আর কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছে কি না এমন একটি প্রশ্ন ফরমে আছে। অনেকেই তথ্য দিতে চায় না। অনেকেই স্বীকার করেন না, তাদের পরিবারে প্রতিবন্ধী মানুষ আছে। অনলাইনেও ফ্যামিলি ট্রি এর অপশনটি রাখার ভাবনা থাকলেও করা হয়নি। তবে তিন মাস পরপর নতুন তথ্য সংযুক্ত করার যায়।

অপরাজেয়: এক বংশের কেউ অন্য বংশে গিয়ে বিয়ে করে আলাদাভাবে নিবন্ধিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
আশরাফী আহমেদ: খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরবর্তী অনলাইন সংস্করণে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তা ছাড়া নিজেদের সচেতন হতে হবে।

অপরাজেয়: জরিপের ফরমটি ওয়াশিংটন গ্রুপের আদলে তৈরির বিষয়ে বলা হলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। কেন?
আশরাফী আহমেদ: আমি মন্ত্রণালয়ে আসার আগেই ফরমটি তৈরি হয়। ওয়াশিংটন গ্রুপের আদলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চলতি বছরের জুলাই থেকে একটি জরিপ শুরু করবে; খানা জরিপ। ওই জরিপে পক্ষাঘাতের কারণে প্রতিবন্ধিতা, বাসায় বৃদ্ধ যারা লাঠি নিয়ে হাঁটেন তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর ফলাফল পাওয়া যাবে ২০২০ সালের জুনে।

অপরাজেয়: প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ প্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে?
আশরাফী আহমেদ: যেহেতু শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চলমান, আমার মনে হয় এ প্রকল্প চলবে। তবে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের জন্য অর্থবরাদ্দ রয়েছে। জরিপ শব্দটি নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় এ বছরই প্রকল্পটির নাম বদলে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শনাক্তকরণ কর্মসূচি’ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জরিপের আওতাভুক্ত সবাইকে ভাতা দিতে বলেছেন। আগে দশ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেওয়া হলেও এবার ভাতার আওতায় আসবে সাড়ে ১৫ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।

অপরাজেয়: জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্যসমূহ কি সংযুক্ত হয়েছে?
আশরাফী আহমেদ: আমি ২০১৫ সালের জুন মাসে যোগদানের পর মার্চ, ২০১৬ তে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের পর থেকে আমরা পরস্পর তথ্য আদানপ্রদান ও ব্যবহার করতে পারি। তবে নির্বাচন কমিশন চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য সংযুক্ত করে পরিচয়পত্র দিতে পারে। শুরুর দিকে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও  Online Birth Registration Information System (Online BRIS) -এর তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। তাতে তথ্য অন্তর্ভুক্তি ব্যাহত হয়েছিল; সে সময় আমার জায়গায় থাকা পূর্ববর্তী কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যান।

আমি যোগ দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবস ২০১৬ উদ্যাপনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পরিচয়পত্র বিতরণ উদ্বোধন করেন। ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৪ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সুবর্ণ নাগরিকের পরিচয় পত্র বিতরণ করা হয়। ওয়েবসাইটে নিয়মিত তার তথ্য অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। তবে ইউনিসেফ থেকে স্বল্পমূল্যে নেওয়া তথ্য অন্তর্ভুক্তির সফটওয়্যারটি বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি এবং সমস্যার কারণে প্রয়োজনানুযায়ী আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ফলে প্রতিবন্ধী মানুষের ফরম অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরি বা কর্মসংস্থানবিষয়ক সব তথ্যই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। আশা করছি দ্রুতই সংবাদ সম্মেলন করে জনসম্মুখে উন্মুক্ত করা যাবে।

অপরাজেয়: জাতীয় পরিচয়পত্র ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পরিচয়পত্রকে একীভূত করে স্মার্ট কার্ডে দেওয়ার পরিকল্পনা কি আছে?
আশরাফী আহমেদ: প্রধানমন্ত্রী নিজেও বোঝেন এ পরিচয়পত্র একীভূত হওয়া দরকার। এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। নির্বাচন কমিশন চাইলেই জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্য অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তবে যেহেতু এটি আলাদা একটি বিভাগ, আমরা উপযাচক হয়ে কিছু বলতে পারি না।

অপরাজেয়: জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্য উল্লেখ না থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন প্রতিবন্ধী ভোটারের সংখ্যা এবং তাদের প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এ বিষয়ে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আশরাফী আহমেদ: এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলো, নির্বাচন কমিশন ও আন্তঃমন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় করে কাজ করা দরকার। আর সরকারি পর্যায়ে কিছু করতে হলে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা উচ্চপর্যায় থেকে আসা দরকার, আমরা কিছু করতে পারি না।

অপরাজেয়: জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো প্রতিবন্ধী নাগরিকের তথ্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্তি কিংবা সেখানেই সংশোধন করার পরিকল্পনা আছে কি?
আশরাফী আহমেদ: অনলাইনে সম্ভব নয়। নিজ এলাকার সমাজসেবা কার্যালয়ের অধীনে নিবন্ধন করতে হবে। তবে সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান। আমরা সবাই কাজ করছি, কিন্তু কাজগুলো ছাড়া ছাড়া হচ্ছে, সমন্বিত হচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য উপাত্ত ব্যবহার নীতিমালার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত পেয়ে গেছি। এখন সেগুলো একসঙ্গে করে পাঠাতে হবে।

অপরাজেয়: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আশরাফী আহমেদ: অপরাজেয়’কেও ধন্যবাদ।

নিরাপত্তা খাতের বলয়ে মুখ থুবড়ে অধিকার ও উন্নয়ন; উপেক্ষিত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ

মীর মোশারফ হোসেন

বছর বছর বাড়ছে বাজেটের আকার। উড়ছে অর্থ; ব্যবসা-বাণিজ্য, দালানকোঠা, যোগাযোগব্যবস্থাসহ সড়ক উন্নয়ন সবকিছুতেই রমরমা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির সুফল পৌঁছাচ্ছে না প্রতিবন্ধী মানুষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে।

চলতি বাজেট চিত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে মৌলিক অর্থে যা প্রয়োজন, তার ছিটেফোঁটাই মিলছে। বিশেষজ্ঞরা তাই সরকারের নীতির মধ্যেই সমস্যার কথা বলছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নে তারা কয়েক বছর ধরেই মন্ত্রণালয়ভিত্তিক আলাদা বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে এলেও সরকারি কর্মকর্তারা তা কানেই তুলছেন না। উল্টো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বলয়ে মুখ থুবড়ে আছে প্রতিবন্ধী মানুষের বরাদ্দ। উপেক্ষিত শিক্ষা, যোগাযোগ, সড়ক-রেল-নৌপরিবহন, স্বাস্থ্য ও পরিবার, মহিলা ও শিশু, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, শ্রম ও কর্মসংস্থান, যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সমূহে প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় মারফত ১ হাজার ৬২৯ দশমিক ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ১৪.২১ শতাংশ বরাদ্দের ২.১৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য, যা মোট বরাদ্দের ০.৩১ শতাংশ। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ভাতাকেন্দ্রিক বরাদ্দ হয়েছে ৮৫.৩৩ শতাংশ। যা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল উন্নয়ন থেকে দূরে রাখছে। 

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভ‚মিকা বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. নূরুল আমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সব উল্লেখ থাকে। এসডিজি বাস্তবায়নে দারিদ্র্য দূর করার বিষয়ে প্রতিবন্ধী মানুষেরা বাদ থাকবে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তা ছাড়া কোনো অবস্থায় কেউ অবহেলিত হবে না, সবার সুরক্ষায় সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ এবং সব মন্ত্রণালয় তা করতে বাধ্য।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়ে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে সব বলেছেন, এর বাইরে কিছু বলার নেই। অপর দিকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ফোকাল মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

তৈরি পোশাকশিল্পে প্রতিবন্ধী নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি; কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে বাধা এবং ব্যবধানসমূহ শনাক্তকরণ ও সম্ভাব্য করণীয়

নুসরাত জেরিন জয়া

গার্লস এডভোকেসি অ্যালায়েন্স (জিএএ) ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্ল্যান নেদারল্যান্ডসের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একটি জনওকালতিমূলক প্রকল্প। পাঁচ বছর (২০১৬-২০২০) মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে কিশোরী ও তরুণ নারীদের সম-অধিকার এবং তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে নারীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়নে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেনদরবার করা। এ ছাড়া বাংলাদেশে কোনো কিশোরী ও তরুণ নারীরা যেন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার না হয়, জিএএ তার সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা খতিয়ে দেখছে। জিএএ তার কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক কুসংস্কার দূর করে কন্যাশিশু, কিশোরী ও নারীর উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালাকে আরও বেশি একীভূত করার ব্যাপারে সরকারি, বেসরকারি, কমিউনিটি ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে প্রভাবিত করে আসছে। একই সঙ্গে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং চর্চার মাধ্যমে সমাজে টেকসই পরিবর্তন আনয়নেও কাজ করছে জিএএ। লিঙ্গবৈষম্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের কোনো নারীই যেন পিছিয়ে না থাকে, জিএএ তার এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী কিশোরী ও তরুণ নারীদের জন্য কর্মপরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী নারী দ্বারা পরিচালিত সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান) এর সঙ্গে ২০১৮ সাল থেকে কাজ শুরু করে জিএএ। প্রতিবন্ধী নারীদের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া কমাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অবকাঠামোসহ সরকার গৃহীত সেবা ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালাগুলোকে প্রবেশগম্যতা নিরীক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীবান্ধব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জিএএ এবং বি-স্ক্যান এর এই কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া জিএএ নাগরিক সমাজের সংগঠনসমূহ (সিএসও) এর সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে তাদের লবিং এবং জনওকালতিমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যমান জ্ঞান এবং দক্ষতা গড়ে তুলতে কাজ করছে। যেন এই সংগঠনসমূহ কিশোরী ও তরুণ নারীদের সম-অধিকার ও সুযোগ সৃষ্টিতে আরও বেশি একীভূত নীতিমালা তৈরি এবং চর্চার প্রসার ঘটানোর জন্য কার্যকরী নেতৃত্ব দিতে পারে।

তৈরি পোশাকশিল্পে প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকের সহজ বাধামুক্ত অংশগ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে সমস্যা চিহ্নিত  এবং উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে জিএএ এর সহযোগিতায় অক্টোবর থেকে নভেম্বর ২০১৮ তে এই গবেষণা পরিচালিত হয়।

গাজীপুর ও সাভারের পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানায় দলীয় আলোচনা এবং নিবিড় সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়

কর্মস্থলে প্রবেশগম্য ব্যবস্থা ও যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ ছাড়া সরকারি প্রতিনিধিবৃন্দ (নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর) সহ বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ও সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃক প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের জন্য গৃহীত নানাবিধ সুযোগ-সুবিধাবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করেন গবেষক দল।

বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ প্রতিবেদন ‘প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক বৈশ্বিক তথ্য’ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ৫০০০ তৈরি পোশাক কারখানায় প্রতিবন্ধী মানুষের একটি বৃহত্তর অংশের কর্মসংস্থান সম্ভব। কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষেরা সেভাবে সুযোগ পাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছে। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশনকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। এসডিজি সূচক ৮.৫ এ ২০৩০ সালের মধ্যে তরুণসমাজ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরসহ সব নারী ও পুরুষের জন্য পূর্ণকালীন ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্য অর্জন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এতে সমমর্যাদার কাজের জন্য সমান মজুরি প্রদান নিশ্চিত করার বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) তেও এই বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্স (জিএএ) প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান) প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীর জন্য তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে বাধা এবং ব্যবধানসমূহ শনাক্তকরণ শীর্ষক এই গবেষণা পরিচালনা করে।

এ গবেষণায় সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া ৫৪ জন প্রতিবন্ধী শ্রমিকের মধ্যে ৫১ জন প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিক। প্রাপ্ত সাক্ষাৎকারের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্যভান্ডারে প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের কোনো তথ্য নেই। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী শ্রমিকেরা অজ্ঞতা এবং সচেতনতার অভাবে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকেরা যৌন নির্যাতন, হয়রানি, খারাপ স্পর্শ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন নন। ফলে কারখানা যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা কমিটিকে তারা এ বিষয়গুলো জানান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারী শ্রমিকেরা এই কমিটিগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন না। অনেক কারখানায় অভিযোগ বাক্সের ব্যবস্থা থাকলেও এর ব্যবহার তারা জানেন না। জাতীয় হেল্পলাইন ৯৯৯, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০৯ এবং শ্রমিক ইউনিয়নের ভূমিকা সম্পর্কেও তারা অবগত নন।

গবেষণায় আরও উঠে আসে, প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের চাহিদা বিষয়ে সচেতনতার অভাবে কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিক ইউনিয়নও যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন না। এ ছাড়া বেতন, কর্মঘণ্টা, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের সঙ্গে কিছুক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পারিশ্রমিক তোলার বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায়, তাদের নিজস্ব কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। এ ছাড়া তারা কর্তৃপক্ষ থেকে অনেকেই নিয়োগপত্র পান না। অসুস্থতা, বিয়ে, তালাক, মাতৃত্বকালীন ইত্যাদি ছুটির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকেরা সমস্যায় ভোগেন। গাজীপুরের বেশ কিছু পোশাক কারখানায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শ্রমিকেরা কাজ করছেন। অন্যান্য কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী হলেও বাংলা ইশারা ভাষা সম্পর্কে অসচেতনতা এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে নিয়োগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

শ্রমিকদের আবাসনব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের চিত্র আরও ভয়াবহ। বাসা ভাড়া বাবদ খরচ হয়ে যায় উপার্জিত আয়ের অধিকাংশ। ফলে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাবলেট, মেস বা কারখানার হোস্টেলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন। অন্যদিকে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি নারী কর্মীদের আবাসিক হোস্টেলে প্রবেশগম্যতার অভাবে প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকেরা সেখানে থাকতে পারেন না।

বেশ কিছু কারখানা প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের ব্যাপারে সচেতন। এসব কারখানা থেকে বিনা মূল্যে ওষুধসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উপযোগী সুবিধা দেওয়া হয়। তবে এটুকু যথেষ্ট নয়। বিজিএমইএর তথ্যভান্ডারে প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের সম্পর্কে তথ্য থাকা আবশ্যক। প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকসহ সকল কর্মীকে সহজলভ্য অবকাঠামো ও সেবা প্রদানের জন্য পোশাক কারখানাগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় নেওয়া উচিত। প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের (আইএলও, জাতিসংঘ সংস্থাগুলো) প্রতিবন্ধী নারী কর্মীদের চাকরিতে নিয়োগের আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার। অবকাঠামোগত বাধাসমূহ চিহ্নিত করে প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের চাহিদা অনুসারে সরকারি আবাসিক হোস্টেল তৈরি করা দরকার। প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ এবং বিপদকালীন দ্রুত বহিরগমন নিশ্চিত করতে কারখানাসমূহের কর্তৃপক্ষকে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে প্রবেশগম্য অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এছাড়া উচ্চ আদালতের ২০০৯ সালে নির্দেশিত যৌন সহিংসতা বিরোধী নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রত্যেক শ্রমিককে অবহিত করণ এবং তা প্রকাশ্যের জন্য একটি উপযোগী পরিবেশ প্রণয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি, কারখানা অংশগ্রহণ কমিটিগুলোতেও প্রতিবন্ধী নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিজিএমইএ কর্তৃক সুস্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করে তা সব কারখানায় পাঠানো উচিত। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিকদের সমস্যা মোকাবিলায় শ্রমিক ইউনিয়নকেও সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সেবা প্রদানে সহায়তা করার জন্য মানবসম্পদ এবং বাংলা ইশারা ভাষা অনুবাদক ও পরামর্শদাতা নিয়োগ বা প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হবে কারখানা এবং তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে।

এই গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে বোঝা যায়, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী শ্রমিকেরা উৎপাদনশীল ও নির্ভরযোগ্য কর্মী হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অবদান রাখতে পারেন। কারখানাগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে গবেষণালব্ধ সুপারিশসমূহ নিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সেইপ, আইএলও, শ্রমিক ইউনিয়নসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি একীভূত কর্মক্ষেত্র নির্দেশিকা প্রণয়নের জন্য বি-স্ক্যান এবং জিএএ যৌথ উদ্যোগে জনওকালতিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বি-স্ক্যান এবং জিএএ আশাবাদী, এর ফলে তৈরি পোশাক খাতে প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের সর্বজনীন প্রবেশগম্যতাসহ সম-অধিকার বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বিলোপে বাধাসমূহ হ্রাস করা সম্ভব।

নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা : ক্যাট, সিআরপিডি ও বাংলাদেশের আইন

অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল করিম সিদ্দিকী

আমরা সম্প্রতি দেখলাম নিজের সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর খবর জানতে গিয়ে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী নারী রেনু নিহত হলেন। প্রায় একই সময় মেয়েকে দেখতে গিয়ে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিহত হলেন তথাকথিত গণপিটুনিতে। কিশোরগঞ্জে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে হাত-পা বেঁধে উৎসবমুখর পরিবেশে মেরে মুমূর্ষু করার ঘটনাও ঘটল এ বছরেই!

প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানকে শুধু লালন-পালন করতে অসুবিধা হওয়ার কারণে ২০১৭ সালের শেষ দিকে গলা কেটে তাকে হত্যা করেছে পিতা! বুদ্ধি ও মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের ধর্ষণ করা হলে সেটাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্যই করা হয় না। পুলিশ প্রশাসন এ ধরনের প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও তারা ধর্ষণের মামলা নিতে চায় না।

আমরা চারপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অনুভব করি, যে মানুষ যত বেশি প্রান্তিক সে তত বেশি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে থাকে। এর কারণ হলো অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় থাকা মানুষটির চেয়ে সামান্য খারাপ অবস্থায় থাকা মানুষটির প্রতি বা তার পরিবারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে অভ্যস্ত নয়। মর্যাদা ও সম্মানের মানদন্ডে দুর্বল অবস্থায় থাকা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ন্যায়বিচার লাভের চিত্রও হতাশাজনক। প্রান্তিক গোষ্ঠী বিবিধ কারণে ন্যায়বিচার পায় না বিধায় নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্যক্তিরা হরহামেশাই নানা কায়দায় প্রান্তিক মানুষদের ওপর নির্যাতন চালায়। বৃহত্তম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ‘অধিক হারে’, ‘নিত্য নতুন কায়দায়’ ও ‘তীব্রতর মাত্রায়’ নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকি। অত্র প্রবন্ধে নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইনে ব্যবস্থা এবং তা বাস্তবায়নের পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে জাতিসংঘ The Convention against Torture and Other Cruel, Inhuman and Degrading Treatment and Punishment, 1984, ১৯৮৪ (সংক্ষেপে ক্যাট) নামক একটি আন্তর্জাতিক সনদ প্রণয়ন করে। এ সনদ অনুযায়ী সরকারি কর্মে নিয়োজিত কর্মী বা এরূপ ক্ষমতা ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তির দ্বারা বা তার সম্মতিতে বা জ্ঞাতসারে স্বীকারোক্তি বা তথ্য উদঘাটনের জন্য কিংবা শাস্তি, হুমকি বা ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বেদনা বা যন্ত্রণা দানের উদ্দেশ্যে কৃত কর্মই নিষ্ঠুরতা। এ সনদ মোতাবেক যেকোনো ধরনের নিষ্ঠুরতা নিষিদ্ধ। সনদের ২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে আইনি, বিচারিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য সব ব্যবস্থা গ্রহণে পক্ষরাষ্ট্র বাধ্য। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে এই সনদ অনুস্বাক্ষর করে। তাই বাংলাদেশও এ সনদ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। ক্যাট অনুযায়ী রাষ্ট্র চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায়/কারিকুলামে নিষ্ঠুরতা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে শিক্ষা ও তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য (অনু. ১০)। এতদসংক্রান্ত আইন, নীতি, বিধি ইত্যাদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে রিভিও করতেও রাষ্ট্র বাধ্য (অনু ১১)। এমনকি নিষ্ঠুরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা আইন দ্বারা নিশ্চিত করতেও পক্ষরাষ্ট্র বাধ্য (অনু. ১৪)।

একটু দেরিতে হলেও জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি পৃথক আন্তর্জাতিক সনদ সিআরপিডি প্রণয়ন করে। এ সনদের অনুচ্ছেদ ১৫ তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকেই নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা বা মর্যাদাহানিকর চিকিৎসা অথবা শাস্তি প্রদান করা যাবে না। কোনো ব্যক্তিকেই তার স্বেচ্ছাসম্মতি ছাড়া চিকিৎসার বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়বস্তু করা যাবে না। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের ওপর নির্যাতন, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর কোনো চিকিৎসা বা শাস্তি প্রতিরোধ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সব ধরনের কার্যকর আইনগত, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সিআরপিডির অনুচ্ছেদ ১৬ তে শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য করণীয় সম্পর্কে বেশ কিছু বাধ্যকতা আরোপ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণকে ঘরে-বাইরে লিঙ্গনির্বিশেষে সব ধরনের শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ যথাযথ আইনগত, প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক বা অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রপক্ষ সব ধরনের শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের সেবার জন্য পরিচালিত সকল সুবিধা ও কর্মসূচি স্বাধীন কর্তৃপক্ষের দ্বারা কার্যকরভাবে পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ওপর শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা শনাক্তকরণ, তদন্ত ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ নারী ও শিশুবান্ধব আইন ও নীতিমালাসহ কার্যকর আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করবে।

আন্তর্জাতিক সনদগুলোর বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮; যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮; প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩; নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, ২০১৩; শিশু আইন, ২০১৩; নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯; আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০; ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮; সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; পুলিশ আইন, ১৮৬১; প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৮৬০ ও দন্ডবিধি, ১৮৬০সহ বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ১৬(১)(ট) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকার থাকবে। এই অধিকার যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লঙ্ঘন করবে, তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ব্যক্তি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটিতে ক্ষতিপূরণের আবেদন করতে পারবে। এই আইনের ৩৭(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো ব্যক্তিকে আইনের আশ্রয় লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করলে অভিযুক্ত ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে কিংবা পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে বা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। আইনের তফসিলের ১২ নম্বর দফায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নির্যাতন থেকে মুক্তি, বিচারগম্যতা ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ, সেফহোমে রাখবার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, যোগাযোগের সুবিধার জন্য বিশেষজ্ঞ (যেমন বাংলা ইশারা ভাষাবিদ)সহ কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে সুরক্ষার নিমিত্তে বিদ্যমান আইনি কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু এসব আইনি বিধানের বাস্তবায়ন খুবই হতাশাজনক।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বা পুনর্বাসনের নামে হাজার হাজার হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র বা আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এসব স্থানে আবদ্ধ রেখে চিকিৎসার নামে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়, রোগীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখা হয় বা তাদের অসম্মতিতে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ওষুধ খেতে না চাইলে বা নিয়মকানুন মেনে না চললে তাদের ওপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, নার্স, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নির্মম নির্যাতন চালায়। কখনো কখনো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এসব আচরণ ক্যাট, সিআরপিডি বা বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ক্যাট-এর অনুচ্ছেদ ২, ১০, ১১ ও ১৪ এবং সিআরপিডির অনুচ্ছেদ ১৫ ও ১৬ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর নিষ্ঠুরতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। সরকার আইন প্রণয়ন করেই দায়িত্ব সমাপ্ত করেছে। আইন বাস্তবায়নে তাই সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, মূল জনগোষ্ঠীও যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিজেদের সঙ্গে সমানতালে চলতে দিতে নারাজ! তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বললেও প্রায়ই প্রতিবন্ধী জনগণকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা আমরা তাদের মধ্যে দেখতে পাই। ক্যাট বাস্তবায়নের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাসমূহের পক্ষ থেকে এ বছরের জুন মাসে একটি বিকল্প প্রতিবেদন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটিতে প্রেরণ করা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর চিকিৎসার নামে চলমান প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতন যেমন শেল্টার হোম বা মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র অথবা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে যে সমস্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন  চলে সে বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কারণেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর নিষ্ঠুরতার বিষয়টি জাতিসংঘ অবগত হতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি যে কনক্লুডিং অবজারভেশন দিয়েছে, সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর চলমান নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।

এমতাবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন বা ডিপিওসমূহকে নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি সুশীল সমাজসহ সমাজের মূলধারার জনগোষ্ঠীকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

ইন-কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, ব্লু ল ইন্টারন্যাশনালই-মেইল: advreja@gmail.com

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের রাস্তায় একা চলাচল

নুরুন্নাহার তনিমা

হঠাৎ আমার জীবন বদলে গেল। শ্যামলীর আদাবর, সড়ক ১২তে একটি সংগঠন আছে যার নাম প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ, সংক্ষেপে পিএনএসপি। সেখানকার পরিচালক রফিক জামান ভাই জাদুর মতো আমার জীবন বদলে দিলেন। আমাকে রাস্তায় একা চলতে শিখিয়ে, আমার সব ভুল ধারণা ভেঙে দিলেন। শুধু আমার নয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের রাস্তায় একা চলাচল বিষয়ে আমাদের বাবা-মায়ের মনোভাবও বদলে দিয়েছেন তিনি। আমার জীবনের গতিপথ একেবারে পাল্টে দিয়েছেন এই রফিক ভাই এবং তার সংগঠন পিএনএসপি। আমার সকাল-বিকেলের অলস সময়গুলো হারিয়ে গেছে কোনো এক জাদুর কাঠির স্পর্শে।
এখন আমি একা বাজার করি। ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে একা রাস্তায় বের হয়ে যাই। আমার জন্য একটা কাজের পথও জুটিয়ে দিয়েছেন রফিক ভাই। আমি একাই সেই বিদ্যালয়ে পড়াতে যাই।

আমরা তিন বোন ঢাকাতেই থাকি। দু’বোনের দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা ছোটবেলা থেকে। আমার বাবা-মা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সন্তানদের শিশুকাল থেকে স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। বড় আপা বিদ্যালয়ে যেত। আমরা ঘরে থাকতাম। বড় আপা বেড়াতে যেত। আর আমরা ভাবতাম যদি যেতে পারতাম! কিন্তু বাবা-মাকে বলতে সাহস হতো না। ছোট ছিলাম, তাই বুঝতাম না আমরা অস্বাভাবিক এক জীবন যাপন করছি।

তবে আমরা দুই বোন হলাম বাবা মায়ের কলিজার টুকরা। দুজনেই সব সময় চেষ্টা করতেন আমাদের খুশি রাখতে। আমরা যখন যা চাইতাম, তারা তাই আমাদের এনে দিতেন। গান খুব ভালোবাসতাম। তাই বাবা আমাদের বাসায় শিক্ষক রেখে গান শিখিয়েছেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ও ভালো শিক্ষকের কাছে না গেলে ভালো করে গান শেখা যায় না। অনেক আশা নিয়ে অভিজ্ঞ এক শিক্ষককে গান শেখানোর অনুরোধ করলাম, তিনি বললেন, আমি বাসায় গিয়ে কখনো গান শেখাই না। আমাদের দুই বোনকে দুই হাতে ধরে রাস্তায় হাঁটতে আমার মামণির খুব ঝামেলা হতো। তাই কখনো কখনো তিনি চাইতেন, বড় আপা আমাদের সঙ্গে যাক। তাহলে মামণি একজনকে ধরে রাস্তায় হাঁটবেন আর বড় আপা আরেকজনকে ধরবেন। আপা যেত। কিন্তু যখন অনেক সময় গানের রেওয়াজ বেশি সময় ধরে চলত, আর আমাদের জন্য আপা ও মামণিকে সব কাজ ফেলে আমাদের বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় থাকতে গিয়ে বড় আপার কাজে দেরি হয়ে যেত; তখন ও বিরক্ত হতো। যদিও মামণিকে না করতে পারতো না। অথচ ওর কাজের ক্ষতি হতো। আমরা দুই বোন মন খারাপ করে ভাবতাম, যদি এমন হতো আমরা দুজন মাসে একবার করে চোখে দেখব, তাহলে কারুর সাহায্য নিতে হতো না। 

মা-বাবা ভয় পেতেন আমাদের একা রাস্তায় ছাড়তে। আমরাও ভাবতাম দৃষ্টিহীন মানুষেরা একা রাস্তায় বের হয় না। আমাদের সবার বদ্ধমূল ধারণা ছিল সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ কখনোই একাকী রাস্তায় চলতে পারেন না।

যত বড় হচ্ছি, আমাদের প্রয়োজন বাড়ছে। প্রয়োজনের তাগিদে মনের ওপর চাপ বাড়ছে। ঘরের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারার যাতনা কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে। সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়ে পড়তাম যখনই মনে হতো, বাবা-মায়ের অবর্তমানে আমাদের দুজনকে বড় আপার বাসায় থাকতে হবে, তখন আমার কিছুই ভালো লাগত না।

কিন্তু হঠাৎ আমার জীবন বদলে গেল। শ্যামলীর আদাবর, সড়ক ১২তে একটি সংগঠন যার নাম প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ, সংক্ষেপে পিএনএসপি। সেখানকার পরিচালক রফিক জামান ভাই জাদুর মতো আমার জীবন বদলে দিলেন। আমাকে রাস্তায় একা চলতে শিখিয়ে, আমার সব ভুল ধারণা ভেঙে দিলেন। শুধু আমার নয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের রাস্তায় একা চলাচল বিষয়ে আমাদের বাবা-মায়ের মনোভাবও বদলে দিয়েছেন তিনি। আমার জীবনের গতিপথ একেবারে পাল্টে দিয়েছেন এই রফিক ভাই এবং তার সংগঠন পিএনএসপি। আমার সকাল-বিকেলের অলস সময়গুলো হারিয়ে গেছে কোনো এক জাদুর কাঠির স্পর্শে।

এখন আমি একা বাজার করি। ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে একা রাস্তায় বের হয়ে যাই। আমার জন্য একটা কাজের পথও জুটিয়ে দিয়েছেন রফিক ভাই। আমি একাই সেই বিদ্যালয়ে পড়াতে যাই। ফিজিওথেরাপি শিখে, ফিজিওথেরাপি সেবা দিতে যাই মানুষকে। টিউশনি করি। এখন আমার একা বের হতে কোনো সমস্যা হয় না। মনেই হয় না, মাসে এক দিন চোখে দেখলে ভালো হতো। বাসার কারও সাহায্য আর দরকার হয় না আমার। বাবা-মাও আমার দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হওয়াকে আমার দুর্বলতা ভাবেন না।

গত বছর রোজার ঈদের দিন থেকে আমি বাদে বাসার সবার জ্বর হয়েছিল। দোকান থেকে আমি সবার জন্য ওষুধ কিনে আনি। এই কাজটা করার পর আমার বাবা এতটাই খুশি হন যে অতি আবেগে তিনি কেঁদে ফেলেন। আমিও বাবা-মায়ের পাশে থেকে তাদের সেবা করতে পেরে খুব খুশি।

আমি এখন বুঝি, রাস্তায় বের হতে দৃষ্টি যতটা জরুরি, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার হলো মানুষের মনের সাহস। কারণ, সাহস না থাকলে কোনো কাজই করা যায় না। এ লেখা পড়ে যদি সব বাবা-মায়ের মনের ভুল ধারণা ভেঙে যায় এবং যদি তারা বুঝতে পারেন স্বাভাবিক যা, তা-ই সুন্দর- তাহলেই আমার নিজের জীবনের এই গল্পটি বলা সার্থক।

বাংলাদেশের সকল বাবা-মায়ের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আপনাদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের সাহস দিয়ে তাদের মনোবল বাড়াবেন, ভয় দেখিয়ে তাদের ঘরে আটকে রাখবেন না।


প্রবেশগম্য গণপরিবহনের অভাব উন্নয়নের অন্তরায়

অপরাজেয় প্রতিবেদক

প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য যথোপযুক্ত ও যথেষ্ট পরিমাণ কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি না হওয়ার জন্য যাতায়াতের সুব্যবস্থার অভাবকে দায়ী করেন আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় কর্মরত সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট অন্তরা আহমেদ। এ দেশে প্রবেশগম্য গণপরিবহন না থাকার ফলে প্রতিবন্ধী মানুষের, বিশেষত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের অপরিসীম ভোগান্তির বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন ব্যাহত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংস্থাসমূহ এই বিষয়গুলো নিয়ে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে আশা করি সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবে না এবং আমাদের মতো প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ক্ষমতা ও সমতা বাস্তবায়নে এ দেশের প্রতিবন্ধী নারীকে অপরিসীম মানসিক শক্তি, ধৈর্য এবং মনোবল নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

ধৈর্য ও মনোবল এ দুটোর সহযোগিতায় আজকের অন্তরা আহমেদ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন তিনি। তার নিজের জীবনের সংগ্রামটাও এত সহজ ছিল না। রেজিস্ট্রি কর্মকর্তা এ এম আজগর আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ অন্তরা আহমেদ। ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণকারী অন্তরা দুই বছর বয়সে পোলিওর সম্মুখীন হওয়ার ফলে দীর্ঘদিন তিনি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকের প্রচেষ্টায় এগারো বছর বয়সে ক্রাচে ভর করে চলাচল শুরু করেন। মা বেগম রাবেয়া খাতুনের কাছেই বাসায় বসে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় তার। একসময় ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি পিএন উচ্চবিদ্যালয়ে। অন্তরা কখনো ভাবতে পারেননি তারও বিদ্যালয়ে যাওয়া হবে। যেখানে তিনি আলোর পথের যাত্রী হতে পারবেন সমবয়সী অনেকের সঙ্গেই। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বেগম রাহেলা খাতুনসহ অন্য সব শিক্ষক তাকে স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করলে অভিভ‚ত অন্তরা স্বপ্নযাত্রার পথে অগ্রসর হতে শুরু করেন।

ক্রাচে ভর করেই বিদ্যালয়ে যেতেন অন্তরা। শিক্ষাজীবনে চলার পথে খুব ভালো কিছু বন্ধুর সঙ্গ পান তিনি। বন্ধুদের সহযোগিতা আর অসীম মনোবলে ১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৮১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে তার বিভাগের ভবনগুলো ছিল অনেক দূরে। তারপরও কষ্ট মেনে নিয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন ক্লাসগুলোতে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৮৪ সালে স্নাতক এবং ১৯৮৫ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।

এরপর শুরু হয় সমাজে সম-অধিকার ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের লড়াই। নানান মত ও দ্বিমতের মধ্য দিয়ে অন্তরা কর্মজীবন শুরু করেন এবি ব্যাংকে বয়ঃকনিষ্ঠ কর্মকর্তা পদে। কর্মজীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শক্ত মনোবলের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেন তিনি। চাকরির শুরু থেকে কর্মস্থলে আসতে কখনো সময়ক্ষেপণ করেননি। তবে ১৯৯০ সালের সময়টাতে যখন সরকার পতনের আন্দোলন চলছিল সে সময়টা মনে করে তিনি বলেন, তখন কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য বাস, রিকশার সাহায্য নিতেন তিনি। তবে প্রায় দিনে হরতাল থাকার ফলে যাতায়াতের যানবাহনগুলো বন্ধ থাকত। অবস্থা বুঝে সে সময় আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হরতালের দিন আমার ছুটির ব্যবস্থা করে দেন।

কর্মজীবনে উনত্রিশ বছর নিয়মানুবর্তিতা, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে কাটিয়ে দেন অন্তরা। জীবনের এই দীর্ঘতম পথ অতিক্রম করতে সহযোগী প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। প্রতিবন্ধী মানুষদের সঙ্গে সংগঠিত হয়ে কাজ করতে না পারলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন। তবে কর্মব্যস্ততা শেষে অবসর জীবনে এসে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশগ্রহণের ইচ্ছে পোষণ করেন তিনি।

Translate | অনুবাদ