মনোবলের কাছে হার মেনেছে মাসুদের প্রতিবন্ধিতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রবল মনোবল ও ইচ্ছা শক্তি থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় তা আরেকবার প্রমাণ করলেন নীলফামারীর শারীরিক প্রতিবন্ধী মাসুদ রানা। মুখে কলম ধরে পরীক্ষা দেয়ার পর গত ২৯ ডিসেম্বর’২০১৩, জেএসএসি ফলাফল প্রকাশিত হলে জানা যায় সে কৃতিত্বের সাথে ৪.৮৮ পেয়েছে।

নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের খামাতপাড়া গ্রামে জন্ম মাসুদ রানার। জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মাসুদ। দিনমজুর বাবা মাহফুজুর রহমানের দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে মাসুদ দ্বিতীয়। বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান মাসুদের বাবা মাহফুজুর রহমান। দারিদ্রতার কারণে অন্যান্য সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেন নি তিনি। কিন্তু মাসুদ রানার প্রবল ইচ্ছা শক্তিই লেখাপড়ায় কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। যার ফলশ্রুতিতে তার আজকের এই ফলাফল। এ ব্যাপারে মাসুদ রানার সাথে কথা বললে সে জানায় “অনেক পরিশ্রম করেছি বলেই ভাল ফলাফল করেছি।” ভবিষ্যতে কি হতে চায় জানতে চাইলে সে বলে, পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের সেবা করতে চায় সে। তার মত দরিদ্রদের সেবায় নিয়োজিত হতে হবে তাকে তাই হাতের দুর্বলতাকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেবে না কিছুতেই।

উল্লেখ্য, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র মাসুদ রানা কিশোরগঞ্জ মডেল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়।

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি

– মোস্তফা কামাল যাত্রা
মনো-দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবিধানমূলক নাট্যক্রিয়া অনুশীলন নাট্য সংস্থা উৎস (UTSA) ১৯৯৭ সাল থেকে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কাজ করে আসছে। চট্টগ্রাম বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ইনষ্টিটিউট, হাই-কেয়ার হিয়ারিং সেন্টার এন্ড স্কুল এবং স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা’র উপকারভোগীদের নিয়ে স্বল্প সময়ে থেরাপিউটিক থিয়েটার-এর বিভিন্ন অনুষঙ্গের প্রয়োগ করতে গিয়ে যে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে, তাকে সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে দাতা সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে “থিয়েটার থেরাপি সেন্টার অব দ্য ডিজএ্যাবল্ড (টিটিসিডি)”।

টিটিসিডি কেন্দ্রিয়ভাবে মনো-বিশ্লেষক নাট্য অধিবেশন পরিচালনার পাশাপাশি উৎস (ইউটিএসএ) এর তত্ত্বাবধানে ‘জাতীয় প্রতিবিধানমূলক নাট্য কর্মশালা’ আয়োজনের মাধ্যমে মনোসামাজিক নাট্যক্রিয়া পরিচালনায় দক্ষ থিয়েটার থেরাপিষ্ট গড়ে তুলতে ছিল সর্বদাই সচেষ্ট। এসব কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার বিখ্যাত মনো-বিশ্লেষক নাট্য বিজ্ঞানীরা।

চট্টগ্রামেরই আরেকটি স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সংশপ্তক’ -এর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক ও বিনোদন কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং প্রতিভার উন্মেষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমাদের আরও উৎসাহিত করে তুলে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) সংশপ্তকের উদ্যোগকে আরও সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

মনো-বিশ্লেষক নাট্যের পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতা ইস্যুতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক নাটকের প্রদর্শনী আয়োজনে উৎস’র অভিজ্ঞা, সংশপ্তক, ইপসা, বিটা ও ওয়াচ’সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আয়োজন, যেসব প্রতিভার আবিষ্কার করেছে তা আমাদের সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।

অপরদিকে ক্রীড়া ক্ষেত্রে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতি’র সমর্থনে    ‘চিটাগাং সোসাইটি ফর দ্যা ডিসএ্যাবল্ড (সিএসডি)’ ২০০৫ সাল থেকেই চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্রীড়ার বিকাশে আয়োজন করে আসছে ‘বিভাগীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা’। এ প্রক্রিয়াকে আরও সুসংগঠিত করতে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতি- চট্টগ্রাম শাখা’। বর্তমানে চট্টগ্রাম ভিত্তিক উক্ত সংগঠন-দ্বয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রামে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেটের অনুশীলন ও বিকাশে কাজ করছে ‘চিটাগাং ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব (সিবিসিসি)’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবছর বিভাগীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সংস্থা, এ্যালায়েন্স অব আরবান ডিপিও’স ইন চিটাগাং (এইউডিসি), ডিজএ্যাবিলিটি রাইটস গ্রুপ (ডিআরজি) এবং উৎসের আয়োজনে ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনকে ঘিরে চট্টগ্রামে যে উদ্দীপনা ও উৎসাহ সৃষ্টি করে তা অভাবনীয়। তবে একে মূল স্রোতধারায় আরও বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করতে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সমিতি, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ‘থিয়েটার ইনষ্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি)-কেও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিগত এক দশকে বেসরকারি পর্যায় থেকে যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয়েছে; তার ফলাফল স্বরূপ আমাদের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ ও শিল্পীরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রেখে চলেছে প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই চট্টগ্রাম জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ কমিটির।

জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ অনুযায়ী, উক্ত জেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ কমিটি প্রতি ২ মাসে ন্যূনতম ১টি সভা করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একীভূত সমাজ প্রতিষ্ঠায় নানান উদ্যোগ নেওয়ার কথা। কিন্তু উক্ত সভাটি নিয়মিত হয় না। যার ফলে জেলা প্রতিবন্ধী কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচী বাস্তবায়নও হয় না। অন্যদিকে এই কমিটিতে নেই বিভাগীয় ক্রীড়া সমিতি পরিষদের কোন প্রতিনিধিত্ব। আমরা চলমান এই নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাই। চাই জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধী বান্ধব ইতিবাচক ও কার্যকর পদক্ষেপ। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিয়ভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যে উদাসীনতা প্রদর্শন করছে; তা সত্যিই বিমাতাসুলভ। এই মানসিকতার পরিবর্তন এনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পরিকল্পনা ও ইতিবাচক উদ্যোগ নেবেন এটাই এখন সময়ের দাবি।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উৎস, চট্টগ্রাম।

চাইছি তোমার বন্ধুতা!

একটি শিশু তারই সমবয়সী তবে তার চেয়ে স্বাস্থ্যটা একটু বেশী ভালো এমন একজন শিশুকে উঠাবসা করাচ্ছে। একজন ১,২,৩,… গুণছে আর অন্যজন উঠছে বসছে আর হাঁপাচ্ছে। অন্য আরেকটি ক্লাসে দেখি একটি কিশোরী মেয়ে মহানন্দে ছোট্ট শিশুদের Ring-a-ring a roses Rhymes শোনাচ্ছে আর খেলছে। শিশুরা আনন্দে আত্মহারা। খুবই মনোরম দু’টি দৃশ্য।   এমনই অনেক ঘটনা আছে যা এইসব ছোট ছোট সোনামণিরা ঘটিয়ে যাচ্ছিল প্রতিটা দিন। তবে এখন আর সেই দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না একটি বিশেষ স্কুলে। আর এই কারণে যে শিশুটি অন্য Regular স্কুল থেকে সেই বিশেষ স্কুলে আসতো তার যেমন মন খারাপ ঠিক একইভাবে এই সকল বিশেষ শিশুরাও অপেক্ষায় থাকে তাদের সেই প্রিয় বন্ধুটির।   আজ আমি লিখছি সেইসব সুস্থ্য-স্বাভাবিক শিশুদের কাছে তাদের সাহায্য চাইতে। যাদের ভালোবাসা একজন পিছিয়ে পড়া শিশুকে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ, শেখাতে পারে অনেক কিছু।   যাদের ঘরে একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু যেমন- অটিস্টিক, সেরিব্রাল পলসি, বুদ্ধিগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ইত্যাদি এমন অনেক শিশু আছে তারা প্রতিনিয়তই নানান সমস্যার সম্মুখীন হন এই সকল শিশুদের নিয়ে। সমাধানে আসতে না পেরে এক সময় তারা কারো কাছে কোন অনুরোধ, অনুযোগ করে না। ভেবেই নেয় আর কিছু করার নাই। তবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি উপলব্ধি করি, আমাদের হতাশ হলে চলবে না, আমাদের প্রথম কাজ শুরু করতে হবে নিজেদের ঘর থেকে। তারপর ধীরে ধীরে আমরা এগুবো বৃহত্তর গোষ্ঠীর দিকে। আমাদের স্থির করতে হবে আমরা আসলে কী চাই। আমাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য মা-বাবা-ভাই-বোন সর্বপরি পরিবারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?   আমার মেয়ের উন্নতির পেছনে আমার পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ‘মুশফিক’ যে কিনা আমার মেয়ের মাত্র ৪ মাসের বড় তার অবদানকে আমি অস্বীকার করতে পারবো না কখনোই। ছোট মুশফিক গর্বভরে পরিচয় দেয় “আমি School for Gifted Children (একটি বিশেষ শিক্ষালয়)-এর Volunteer, আমার বন্ধু ফারহান”। আবার ফারহানকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- “তোমার বন্ধু কে?” সে তার মতো করে বলে- “বন্ধু মুশপিক”। এটা একদিনে সম্ভব হয়নি। এই কিছুদিন আগেও মুশফিক তার স্কুল ছুটির পর সময় দিতে পারতো তার এই পিছিয়ে পড়া বন্ধুদেরকে। মুশফিক বই মেলা থেকে সাইন ল্যাংগুয়েজের লিফলেট কিনে এনেছে শুধুমাত্র হামজা’র সঙ্গে বন্ধুত্ত্ব গড়ে তোলার জন্য। সে যোগযোগ করে সাইন লেংগুয়েজের মাধ্যমে। এই সকল শিশুদের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেককিছু। আমি দেখেছি এই সকল বিশেষ শিশুরা স্বাভাবিক শিশুদের সাথে মেলামেশা করে কতোটা উন্নতি লাভ করতে পারে। আবার আমি এও দেখেছি একটি পরিবারে দুটো সন্তান- একজন স্বাভাবিক এবং অন্যজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। মা তার বিশেষ শিশুকে তার কোলে কবে শেষবার নিয়েছেন তা তিনি নিজেও মনে করতে পারবেন না বা তার সঙ্গে সারাদিনে ১০ মিনিট বসেছেন কিনা সন্দেহ। তবে তিনি তার অন্যান্য কাজ সামলে নিচ্ছেন খুব সুচারুরূপে। আবার এমনও হয় যে, যে ভাই বা বোনটি সুস্থ্য সে এমনই ব্যস্ত তার কাজ নিয়ে যে তারা তাদের বিশেষ ভাই বা বোনকে সময়ই দিতে পারে না। যার কারণেই আমাদের আজ খুঁজতে হয় মুশফিক- এর মতো বন্ধুদের যারা তাদের কোমল হৃদয়ের ভালোবাসায় সিক্ত করে এই সকল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মনকে, পূরণ করে তাদের সুপ্ত বাসনাগুলোকে। কিন্তু আমার মনে হয় বাবা, মা, ভাই-বোন বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বন্ধুর মতো আন্তরিক আচরণ তাদের ভবিষ্যৎ এর পথ আরো মসৃণ হয়ে উঠবে। আমরা চাইবো শুধু মুশফিকেরাই নয় পরিবারের অন্যান্য সকল সদস্যরাও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবেন তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে।

মারুফা হোসেন
পরিচালক
স্কুল ফর গিফটেড চিল্ড্রেন (একটি বিশেষ স্কুল)

প্রতিবন্ধী ভাতা ৩শ টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা করার দাবী

দিনাজপুর প্রতিনিধি: গত ২১ ডিসেম্বর ২০১৩ দিনাজপুর সদর উপজেলায় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (সিডিসি) দিনাজপুর আয়োজিত সেন্টার ফর ডিজএ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডি ডি)’র সহযোগিতায় “প্রোমোটিং রাইটস ফর পারসন উইথ ডিজএ্যাবিলিটি ইনক্লুসিভ লোকাল গর্ভানেন্স এন্ড সার্ভিস প্রোভাইডিং ইন্সটিটিউশন (পিআরপিডি-ডিআই)” প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধী স্ব-সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে সমস্যা চিহ্নিতকরণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।

উপস্থিত প্রতিবন্ধী স্ব-সংগঠনের সদস্যরা স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করেন এবং প্রাপ্তির ক্ষেত্র গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা ৩শ টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা করার দাবী করেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। এছাড়াও তাদের স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে স্ব-সংগঠনের উদ্যোগে নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নিজেদেরই সোচ্চার হবার ব্যাপারে জোর দেন তারা।

আসুন প্রতিবন্ধীবান্ধব বাংলাদেশ গড়ি

৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদাপূর্ণ ভাবে এই দিনটি পালন করা হয়। এইদিন বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, আইন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা অনুষ্ঠান করে থাকে। বস্তুত সকল আলোচনা ও সমালোচনা এই দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই প্রশ্ন জাগে -প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কী একদিনই বরাদ্দ?

 

তথ্যানুসারে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ জনগোষ্ঠী কোন না কোন প্রতিবন্ধিতার শিকার। কিন্তু এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী নিয়ে নীতিনির্ধারকদের নেই কোন মাথা ব্যাথা। আজ অবধি বাংলাদেশে তৈরী হয়নি পূর্নাঙ্গ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আইন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩য় অধ্যায়ের ২৭ নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকদের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও এই বিশাল জন গোষ্ঠী (প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা) যথাযথ অধিকার থেকে বঞ্চিত, অবহেলার শিকার ও করুণার পাত্র।

 

বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যাপারে অনিহা প্রকাশ করে। প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক কোন খবর এক কলাম জায়গা পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। বি-স্ক্যান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন মিডিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পক্ষে বিভিন্ন প্রচার প্রচারনা করে আসছে। কিন্তু এসব প্রচার প্রচারনা চালাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুক্ষিন হতে হচ্ছে সর্বক্ষণ। যার ফলস্বরূপ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটা নিজস্ব প্রচার মাধ্যম বা পত্রিকার প্রবল অভাববোধের অনুভব থেকেই অপরাজেয়  পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। আমাদের প্রত্যাশা, এই পত্রিকা হবে প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের মুখপত্র ও বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর।

 

অপরাজেয় পত্রিকার ১ম প্রকাশনা প্রকাশে যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি, সকলের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ আমাদের অব্যাহত পথযাত্রাকে সুগম করবে।

 

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের রক্তিম শুভেচ্ছা।

প্রত্যাশা

মোঃ খোরশেদ আলম

প্রতিবন্ধী বলে মোদের ঠেলছ যারা দূরে,

আগামীতে থাকবো জেনো, মোরাই সবার আগে।

করুণাটা চাইনা কারো, চাইনা কারো দয়া,

সবার কাছে করি মোরা সহযোগিতার আসা।

অলক্ষণে অপায়াটা বলছ মোদের যারা,

দেখবে শুধু কিভাবে হই আমরা সবার সেরা।

ঘনকালো আঁধার যতই ধরুক মোদের ঘিরে,

জানবে তবু সামনে যাবো জ্ঞানের মশাল জ্বেলে।

নিন্দা-ঘৃণা-হিংসে করো দুঃখ মোদের নাই,

সফল কামের শেষে যেন উৎসাহটা পাই।

আজকে যতই বাড়ছে মোদের পথ চলারই সাথী,

কালকে আরো দ্বিগুণ হবে প্রত্যাশা তাই করি।

ব্লাইন্ড ক্রিকেটে বাংলাদেশ

ব্লাইন্ড ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ১৯২২ সালে অষ্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে, এর পর ধীরে ধীরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এই ব্লাইন্ড ক্রিকেট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ২০০০ সালে ব্লাইন্ড ক্রিকেটের আগমন ঘটে। জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রিয়া সমিতি এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম এর যৌথ উদ্যাগে এবং ওয়েষ্ট বেঙল ব্লাইন্ড ক্রিকেট এসোসিয়েশন (ইন্ডিয়া) এর সহযোগীতায় ঢাকায় ৬ই নভেম্বর ২০০০ইং তারিখে সপ্তাহ ব্যাপি ব্লাইন্ড ক্রিকেট প্রথম প্রশিক্ষন ক্যাম্প শুরু হয়। প্রশিক্ষন সমাপ্তির পর ১২ই নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় ষ্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল দেশের টেষ্ট ইতিহাসে প্রথম টেষ্টটি খেলে। এই স্মরণীয় দিনে মধ্যহ্ন বিরতির সময় ভারত ও বাংলাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররা একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। ঐ দিনই বাংলাদের ব্লাইন্ড ক্রিকেটের গোড়া পত্তন হয়। এরই ধারাবাহীকতায় ধীরে ধীরে বাংলাদেশে ব্লাইন্ড ক্রিকেট এগিয়ে যেতে থাকে এবং এরই এক পর্যায়ে ১৭ই মে ২০০৮ ইং সালে বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই খেলাকে তৃণমূল পর্যায় হতে জাতীয় ও আর্ন্তজাতীক পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিবিসিসির কার্য্যক্রম শুরু হয়। এরই এক পর্যায়ে ১৪, ১৫, ১৬ নভেম্বর ২০০৮ সালে ভারতের নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ক্রিকেট কাউন্সীল এর ও ব্লাইন্ড ক্রিকেট অফ এশিয়া এর বার্ষিক সাধারণ সভায় বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট কাউন্সিল এর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর মোঃ ইয়াদ আলী ফকির (অবঃ) এবং বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিম এর ক্যাপ্টেন মোঃ হাফিজুর রহমান বুলেট অংশ গ্রহন করে। এ সভায় বাংলাদেশ এর ১০ম দেশ হিসাবে পুর্ণাঙ্গ সদস্য পদ লাভ করে।অন্য সদস্য রাষ্ট্র গুলো হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েষ্ট ইন্ড্রিজ, সাউথ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং নেপাল এবং একই সাথে বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট অব এশিয়া এর সদস্য পদ লাভ করে। এর অন্যান্য রাষ্ট্র গুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল।

২০০৮ সাল থেকে বিবিসিসি’র সহযোগিতায় তরুন উদীয়মান ক্রিকেটার তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিম এর ক্যাপ্টেন হিসাবে মোঃ হাফিজুর রহমান বুলেট কোচ সানোয়ার আহমেদকে সাথে নিয়ে ক্রিকেট ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করে আসছে। এই কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে ব্লাইন্ড ক্রিকেটকে উন্নত করা এবং জনপ্রিয় করা।

উল্লেখ্য, বিবিসিসি’র সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮টি ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্লাবগুলো হলো, ঢাকা ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, এনএএসপিডি ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, চিটাগং ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, রাজশাহী ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, কক্সবাজার ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, সুনামগঞ্জ ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, এবিসি ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব, যশোহর ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব এবং আরো কয়েকটি ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অপেক্ষায়। ট্রেনিং ক্যাম্পে এ যাবৎ ২৫০ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছে এবং তারা এখন ক্রিকেট খেলতে পারে।

 

সাইটসেভার্স-এর স্ট্রেনদেনিং গভর্মেন্ট ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশন প্রোগ্রাম (জিআইইপি) প্রকল্পের আয়োজনে সাইটসেভার্স-এর আর্থিক ও বিবিসিসি’র কারিগরি সহযোগিতায় ২০১১ সাল হতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দশ দিন ব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। এই ট্রেনিং ক্যাম্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে ব্লাইন্ড ক্রিকেটকে উন্নত করা এবং স্কুল ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিম প্রতিষ্ঠা করা। এভাবেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তরুণরা স্কুল ব্লাইন্ড ক্রিকেট প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।

 

ব্লাইন্ড ক্রিকেট খেলার নিয়ম-কানুন

ব্লাইন্ড ক্রিকেটের উৎপত্তি অস্ট্রেলিয়াতে এবং বর্তমানে ডজনখানিক দেশে এই খেলা নিয়মিত চর্চা হচ্ছে।

কিছু মূল পার্থক্য ছাড়া প্রচলিত ক্রিকেটের মতোই সকল নিয়ম-কানুন। প্রথমমত দুই দলেই সমান সংখ্যক ১১ জন খেলোয়াড় থাকবে যারা সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং কিছুটা দেখতে পায় যারা। যখন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় ব্যাট বা বল করবে অথবা বল ছুড়বে তখন তাকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু যখন সে দৌড়াবে অথবা বল খুঁজবে তখন সে সাহায্য নিতে পারবে তাদের টিমমেটদের যারা কিনা আংশিক দেখতে পায়।

 

ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ক্রিকেট কাউন্সিল দ্বারা অনুমোদিত বল আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে ব্যবহৃত হবে। এটা সচরাচর ক্রিকেট খেলার বলের মতো দেখতে সাদা বল কিন্তু এটি তুলনামূলক হালকা এবং এটা বাজতে থাকে। বোলার নিচ দিয়ে বল করে মাটিতে গড়িয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে বলটি ছুড়ে দেয় যে কিনা বলটি যাওয়ার শব্দ শুনে ব্যাট দিয়ে জোরে বলটিকে আঘাত করে। তারপর বিস্ময়করভাবে খেলা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে।

 

টিম এবং খেলোয়াড়

একটি খেলায় দুইটি দল থাকবে এবং প্রতিটি দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকবে। প্রতি টিমে যেখানে কমপক্ষে:

৪ জন সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় থাকবে (বি-১)

৩ জন আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় থাকবে (বি-২) এবং সর্বোচ্চ

৪ জন অংশত আংশিক দৃষ্টি সম্পন্ন খেলোয়াড় থাকবে (বি-৩)

 

বিবিসিসি’র এই কার্যক্রম সম্পাদন করার জন্য সরকারসহ কর্পোরেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের সম্ভাবনা ও দক্ষতাকে উন্নয়ন করতে সহযোগিতা করবে।

ইতির আত্মকথন

আমার নাম ইতি। বাবার অতি আদরের ইতি। এই ইতি নামের পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। সেটা হলো অপরূপ এই পৃথিবীতে আমার আগমনের মাত্র অল্পসময় আগে মা স্বপ্ন দেখেন ফুলের মতোন ফুটফুটে সুন্দরী এক মেয়ে কোলে নিয়ে তিনি বসে আছেন। তাকে ঘিরে আছে রাজ্যির মানুষ। কেউ এই নাম বলে, কেউ সেই নাম বলে কোন নামই মায়ের পছন্দ হয় না। নানান জল্পনার মাঝে কে যেনো হুট করে বলে উঠলো, মেয়ের নাম রাখুন ইতি। ঠিক সে সময় প্রচন্ড প্রসবব্যাথা নিয়ে মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমাকে প্রথম কোলে নিয়েই মা ঘোষনা দিলেন, এই মেয়ের নাম রাখবো ইতি। ইতি নামেই সবাই আমার মেয়েকে ডাকবে।

পরিবারের সবার আদরে বেড়ে উঠছি। দিনে দিনে আহলাদী আর জেদী হয়ে উঠছি। তবুও কারুর আদর কমে না। আমাকে নিয়ে সবার কাড়াকাড়ি। কিছুক্ষন এর কোলে তো কিছুক্ষন তার কোলে। হঠাৎ একদিন মায়ের খেয়াল হলো মেয়ের মাথায় চুল উঠছে না। শরীরের কোথাও একরত্তি লোম নেই। দাঁতও উঠছে না।  দিনে দিনে মেয়ের চেহারা কেমন যেনো অদ্ভূতুড়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না।  আমার বড় ভাই দুবছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে হাঁটতে পারে না। সেই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আমার এই অবস্থা। বাবা মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। শুরু হলো ডাক্তার-বদ্যি। ছুটোছুটি। কিন্তু কোনো ডাক্তার এই অদ্ভুত রোগটার নাম জানে না। শেষ পর্যন্ত এক ডাক্তার বললো এই রোগের নাম ÒEctodermal DysplasiaÓ আজ পর্যন্ত যার কোন চিকিৎসা বের হয়নি। ডাক্তারের এই কথা শুনে বাবা-মা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না যে তারা দু’জন সুস্থ -স্বাভাবিক কিন্তু তাদেরই দু’সন্তান এত কষ্টে ভরা জীবন নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এই রোগটি হলে মানুষের শরীরে প্রায় দেড়শো রকমের সমস্যা দেখা যায় যার মাঝে আমার শুধু মাত্র পাঁচ ধরণের সমস্যা দেখা গিয়েছে। যেমন- চুল উঠে নি আমার। শরীরের কোথাও এক রত্তি লোম নেই। যার কারনে গরম একটুও সইতে পারি না আমি। দাঁতও উঠছে না। ভ্রু নেই, মুখে রক্তের দাগ। এই রোগটা হয় জন্মের পর থেকেই। অবশ্য শরীরে আর তেমন অন্য সমস্যা দেখা যায় না। তবে এই মানুষের দৃষ্টিতে এই অদ্ভুতুড়ে শরীর নিয়েই আমৃত্যু জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। তাই স্বাভাবিক জীবন শুরু করার উদ্দেশ্যে ছ’বছর বয়সে ভর্তি হলাম পাড়ার স্কুলে। আমার পাশে কিছুতেই কেউ বসবে না। সবাই আমাকে ভয় পায়। আমি নাকি মানুষ নই ভূত। খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে। কিছুতেই বুঝতাম না তারা আমার সাথে এমন কেন করে! প্রতিদিন ঘরে এসে কান্নাকাটি করতাম। বাবা বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরদিন আবার স্কুলে পাঠাতো। মানুষের নানান কথা আর সহপাঠিদের ঠাট্টা বিদ্রুপ সাথেই পঞ্চম শ্রেণীতে খুব ভালোভাবে পাশ করলাম। এবার নতুন স্কুল। বাবার ইচ্ছে নামকরা এক স্কুলে পড়াবেন আমাকে। কিন্তু কোন স্কুলই আমাকে ভর্তি করাবে না। যদিও খুব ভালোভাবেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি আমি কিন্তু ভাইভাতে আমাকে ইচ্ছে করে ঝড়িয়ে দেওয়া হতো। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে মায়ের। প্রচন্ড রাগে তিনি জানতে চাইলেন এতো ভালো রেজাল্ট করা সত্বেও আমার মেয়েকে কেনো ভর্তি করাচ্ছেন না? ২০০৫ সালের ঘটনা এটি। মিরপুর-১৪ এ অবস্থিত শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এ্যান্ড কলেজের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সৈয়দ মনিরূল ইসলাম পি পি এম স্যার আমার সামনেই বলে উঠেন, আপনার মেয়েকে দেখে বাচ্চারা ভয় পাবে। পড়ালেখার পরিবেশই তো থাকবে না এই স্কুলে। অন্য কোথাও ভর্তি করান একে। কিন্তু বাবা মা হাল ছাড়বেন না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে একটি স্কুলকে রাজী করাতে সক্ষম হন। আমাকে তারা সমাজের সামনে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মন্ত্র শেখাতে চান। কিন্তু ততদিনে আমি মানসিক ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছি। মাঠে, ঘাটে, হাটে, বাজারে যেখানেই যাই মানুষের হাসাহাসি, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের খোরাক হয়ে উঠছি। ঘর থেকে বেরুতেই ইচ্ছে হতো না। নিভৃতে কেঁদে বালিশ ভেজাতাম। একরাশ প্রশ্নের দল হানা দিয়ে যেতো মনের কোনে যার কোন উত্তর আমার জানা ছিলো না। তবে এটুক বুঝতাম আমি ঠিক আর দশজনের মত নই। সমাজ আমায় প্রতিবন্ধী ডাকে। কেন ডাকে জানি না। আমি কি আসলেই প্রতিবন্ধী! সমবয়সী মেয়েরা দু’বেনী ঝুলিয়ে কি সুন্দর গল্প গুজবে দল বেধে স্কুলে যায়। আমার কোন বন্ধুই নেই। কেন নেই? আমি তো ইচ্ছে করে এ রোগটি বহন করে আনিনি পৃথিবীতে। সবাই পড়ালেখা করে সুন্দর ভবিষতের স্বপ্ন দেখে আর আমাকে পদে পদে নানা লাঞ্চনা সহ্য করতে হয়। ভাবি আমার ভাইটা তো নিজে নিজে চলা ফেরা করতে পারে না তার না জানি আরো কতো কষ্ট। স্রষ্ঠাকে দোষারোপ করে উঠতাম মাঝে সাঝে। হুট হাট পাগলের মতোন চেঁচিয়ে উঠে মুক্তি চাইতাম দুঃসহ যাপিত জীবনের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে। একসময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বাবা মার প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছি এখন। আমার ভাইয়া কিন্তু একটুও মনোবল হারায়নি। হুইলচেয়ারে অন্যের সাহায্যে এখন সে এম,বি,এ করছে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে। তাই আমিও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছি জীবন নিয়ে। এতো ঝড় ঝাপ্টায় যারা একটুও ভেঙ্গে পড়েননি সেই বাবা মার এতো পরিশ্রম বিফলে যেতে দেওয়া যায় না। আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। এই সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরও আছে। আমরাও পারি।

ফাতেমা আক্তার ইতি,

ছাত্রী, স্বেচ্ছাসেবী সদস্য বি-স্ক্যান।

সরকারি হয়রানি; পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় ও দু’টো কথা

টিভি, পত্রিকায় এবং মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে বেশ কিছু দিন ধরেই “জাতীয় পরিচয় পত্র’’  নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এখানে যাদের বয়স ১ জানুয়ারি ১৯৯৫ বা তার পূর্বে তাদের হালনাগাদকৃত লিস্টে নাম উঠানোর  জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে একজন কর্মী বাসায় আসেন, যিনি নতুন ভোটার হওয়ার কেউ আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। বাসা থেকে তাকে আমার কথা বলা হলে, আমি জানাই বিজ্ঞাপনে দেয়া তারিখের সাথে আমার জন্ম তারিখ চার দিন কম অর্থাৎ আমার জন্ম তারিখ ৪ জানুয়ারি ১৯৯৫। তখন তিনি জানান এটা সমস্যা নয়। আমি আবারও প্রশ্ন তুললে বলেন, “৪/৫ দিন আগ পিছ কোন ব্যাপারই না”। তারপর তিনি আমার এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষার সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন সনদ, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট ও বাবার জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি চেয়ে নেন এবং সাথে সাথে ফর্ম পূরণ করে একটি স্লিপ ধরিয়ে দেন আমাকে। ফর্মটি পূরণ করার সময়ও যথেষ্ট অদক্ষতার ছাপ চোখে পড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ- আমাকে শারীরিক প্রতিবন্ধী দেখা সত্ত্বেও ফর্মের “প্রতিবন্ধী কিনা” এবং ব্লাড গ্রুপের অংশ পূরণ না করেই চলে যাচ্ছিলেন। পরে বলে তা ঠিক করানো হয়।

তিনি যাওয়ার আগে যে স্লিপটি দেন, তাতে ৪ নভেম্বর ২০১২ এর সকাল ৯টায় চট্টগ্রামস্থ ফিরোজসাহ সিটি কর্পোরেশন বালিকা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়। আমিও যথাযথ সময়ে উপস্থিত হয়ে টোকেন নাম্বার অনুসারে আমার ফর্ম বের করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হতে স্বাক্ষর সহ আনুসাংগিক সকল কাজ সম্পন্ন করি। এ কাজে আমার প্রায় দেড় ঘণ্টার মত সময় ব্যয় হয়। কিন্তু ছবি তুলতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। আমাকে বলা হয়, আমার বয়স ৪ দিন কম তাই এই পরিচয় পত্রটি বাতিল বলে গণ্য করা হবে। তখন আমাদের বাসায় যিনি এসেছিলেন তিনি যা বলেছেন তাই তাদের শুনালাম।  কিন্তু তারা উত্তরে জানালেন বয়স একদিন কম ও গ্রহণ যোগ্য নয়। আমি তাদের কাছে জানতে চাই, “কেন সরকারী কর্মীর ভুলের কারণে আমি কষ্ট পাবো?” প্রতিউত্তরে তারা বলেন, আমার বয়স পরিবর্তন করে ফেলতে । কিন্তু আমার পরীক্ষার সার্টিফিকেট তারিখ উল্লেখ করে জন্ম তারিখ পরিবর্তনে অপারগতা জানালে তারা তাদের কথা উঠিয়ে “হবে না তাহলে” বলে চলে যান এবং আমিও ফিরে আসতে বাধ্য হই। তবে আসার সময় দেখেছি আমার মত আরও বেশ কয়েকজন ফিরে যাচ্ছেন।

এ কাজে আমি ওই ব্যক্তিদের কাউকেই দোষারোপ করতে চাই না। দোষারোপ করতে চাই সরকারের সেই সব কর্মকর্তাদের যারা মাঠপর্যায়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোন রূপ প্রশিক্ষণ ছাড়াই, অর্ধশিক্ষিত কর্মী প্রেরণ করে। “প্রশিক্ষণ ছাড়া” কথাটি এর জন্য বললাম কারণ পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কেউ এমন বড় ভুল করত না আর আমাকেও এভাবে হয়রানি পোহাতে হত না। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে আমার জন্যে এ ধরনের হয়রানি যে একদম নতুন তা নয়। আমার বা আমাদের মতোন যারা, তাদের সাথে এসব ঘটে চলছে প্রতিনিয়ত। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, এ বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় আমি চট্রগ্রাম বোর্ড হতে অংশগ্রহন করেছিলাম। সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অতিরিক্ত ২০ মিনিট পরীক্ষার সময় বাড়ানোর একটা নতুন নিয়ম করেছে বলে জেনে এসেছি। আমি সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়াতে নিজে লিখতে পারলেও আমার লেখা কিছুটা ধীর গতির তবে লেখা ছাড়াও খাতার পেজ উল্টানো, স্কেল দিয়ে কাজ করার সময় পরীক্ষার মূল্যবান বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়। হাতের সব আঙুল একত্রে কাজ করতে পারেনা বলে সমস্যা গুলো হয়। তাই অতিরিক্ত এই সুবিধা নেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যেগী হলাম। এই করতে গিয়েই জানলাম সরকারি নিবন্ধন লাগবে। সরকারি নিবন্ধন বলতে, সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের আওতায় প্রতিবন্ধী লিস্টে নাম উঠানো এবং আইডি কার্ড প্রাপ্তি। আর চট্টগ্রাম সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরে এই নিবন্ধন পর্যায়েও যথেষ্ট হয়রানির সম্মুখীন হয়েছি আমি। উল্লেখযোগ্য,

– অমার্জিত ব্যবহার যেমন, “প্রতিবন্ধী” বলে সম্বোধন করা। যেন নাম-পরিচয় নেই আমাদের!

– এখান থেকে ওখানে বেশ কয়েকবার দরখাস্ত চালাচালির জন্য বেশ কয়েকদিন পার করে দেয়া।

– ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু শুধু বসিয়ে রাখা।

এত সব হয়রানি আর বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে সব কাগজ পত্র তৈরি করে আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে দিলাম। তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে উপস্থিত হলে তাকে শোনানো হলো, “যারা নিজের হাতে লিখতে পারে তাদের জন্যে আবার কেন অতিরিক্ত সময়!” কেনো যে আমার অতিরিক্ত সময় লাগে তা বোধহয় তারা আমার মতো ভুক্তভ’গী হলেই কেবল বুঝতে পারতেন। অনেক চেষ্টা করেও অতিরিক্ত সময়টুকু আমি পেলাম না। অথচ ২০১০ সালে যখন প্রথম আলোর পাতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যে বরাদ্দ অতিরিক্ত সময় সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি দেখতে পাই সেখানে ¯পষ্ট উল্লেখ ছিলো, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি সেরিব্রাল পালসিজনিত (অপরিণত মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা) এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও শ্রুতিলেখক নিয়োগ এবং অতিরিক্ত ১৫ মিনিট সময় বরাদ্দ পাবেন। পরবর্তীতে তা ২০ মিনিটে উত্তীর্ণ হয়। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারী এ সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু এতসব বিপত্তির পরে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বরত কর্মকর্তা কেন আমার সীমাবদ্ধতা সহকারে নিজের হাতে লেখা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। সরকারী আদেশ মতে শুধুমাত্র শ্র“তি লেখক নিয়োগেই অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার কথা হলো, শ্রুতি লেখকদের যেমন অতিরিক্ত সময় দরকার হয় তেমন আমারও তো সেই সময়টুকু প্রাপ্য। তাহলে আমি বা আমার মতো যারা তারা কেন তা থেকে বঞ্চিত হয় তা আজও আমার বোধগম্য নয়!!

অতিরিক্ত সময় আমি তো আর পেলাম না কিন্তু আমি চাই না ভবিষ্যতে আমার মতন কেউ এমন ভ্রান্ত নিয়মের শিকার হোক। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন-

এসব হয়রানির শেষ কোথায়????

 

আজিজুর রহমান নাবিল,

ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ, ১ম বর্ষ,

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য হুইলচেয়ার এক্সেসেবল বা প্রবেশগম্য টয়লেট

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এক্সেসেবল বা সহজে প্রবেশগম্য টয়লেট এর ব্যবস্থা খুবই কম দেখা যায়। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, স্টেডিয়াম, সিনেমাহল, অফিস-আদালত এমনকি বড় বড় শপিং মলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এক্সেসেবল টয়লেট এর পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেই। ভীষণ প্রয়োজনীয় সহায়ক এ সুবিধা থেকে তাদের সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত বা উপেক্ষিত করে রাখা হয়েছে। একজন প্রবাসী হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হিসেবে যখন আমি আমার কর্মস্থল এবং শপিংমল থেকে শুরু করে বিনোদন কেন্দ্র সর্বত্র নির্বিঘে অনেকটা সময় অবস্থান করতে পারি তখনই আমার প্রিয় মাতৃভ’মি বাংলাদেশে অবস্থানরত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে। তাদের কোথাও বেড়াতে যেতে বা বিশেষ কোন জরুরী কাজে ঘরের বাইরে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে হলে কি ভীষণ কষ্ট ভোগ করেন কিছুটা অনুভব করতে পারি। কারণ আমি নিজেও ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসে এসব যন্ত্রণার সম্মুখীন হই। আমার মত একজন প্রবাসী হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি ভিনদেশে সব ধরনের সহায়ক ব্যবস্থা পেয়ে এসে নিজ দেশে ল্যান্ড করা মাত্রই অন্যান্য বিমানযাত্রীদের সামনে সব ধরনের ‘হিউমিলিয়েশেন’বা লজ্জার সম্মুখীন হতে হয় এর চেয়ে দুঃখের বোধহয় আর কিছু নেই! কেনই বা আমাদের সাথে এ বৈষম্যে? এর কি আর শেষ নেই !? অথচ আমাদের জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এর ৭ম অধ্যায়ের ৬৪ নং অনুচ্ছেদের প্রতিবন্ধীসহ সর্বজনীনগম্যতা সম্পর্কিত বিশেষ বিধানে পরিষ্কার উল্লেখ আছেঃ

ক) প্রতি তলায় কমপক্ষে একটি অথবা মোট টয়লেটের ৫% (যাহা অধিক) সংখ্যক টয়লেট প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রবেশগম্য করিয়া তৈরী করিতে হইবে।

খ) টয়লেটের ভিতর ন্যূনতম ১.৫ মিটার  ১.৫ মিটার বাধামুক্ত জায়গা থাকিতে হইবে এবং wc-এর একদিকে সংলগ্ন দেওয়াল হইতে ন্যূনতম ৯০০ মি.মি. জায়গা খালি থাকিতে হইবে।

গ) wc-এর আসন হইতে ৪০০ মি.মি. উচ্চতায় পেছনের দেয়াল হইতে সর্বাধিক ৩০০ মি.মি. দূরত্বে এবং সামনের দিকে ন্যূনতম ৪৫০ মি.মি. বর্ধিত করিয়া হ্যান্ডরেইল থাকিতে হইবে।

ঘ) পানির কল মেঝে হইতে ৮৫০ মি.মি. উপরে হইতে হইবে এবং বেসিনের তলা ও পাইপ এমনভাবে থাকিতে হইবে যেন হুইলচেয়ার পৌঁছাইতে পারে।

ঙ) গোসলের জায়গা ১.০ মিটার প্রস্থসহ ১.১৫ বর্গ মিঃ হইবে এবং মেঝেতে কোন প্রকার বেষ্টনী থাকিতে পারিবে না।

এছাড়াও সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার নিয়ম অনুযায়ী একটি দরজা ৮০০ মিমি. বা ৩১.৩৯ ইঞ্চি চওড়া হতে হয়।  নুন্যতম ৬ ফিট বাই ৫ ফিট হলেই একটি হুইলচেয়ার খুব সহজেই টয়লেটে প্রবেশ করে নিজেই দরজা বাঁধতে পারে। তেমন কঠিন কিছু না তবু আইন থাকার পরেও তার সঠিক বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না !?

খুব অবাক হই যখন দেখি, বাংলাদেশ রেলওয়ে ষ্টেশন, ইন্টারসিটি বাস ষ্টেশন, এমনকি ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য সহজে প্রবেশগম্য কোন টয়লেট নেই। একজন নিয়মিত বিমানযাত্রী হিসেবে প্রতিবার আমি যখন ম্যানচেস্টার-ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা যাওয়া করি, পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা না থাকার কারণে আমাকে সব ধরনের হিউমিলিয়েশেন বা অপমানের সম্মুখিন হতে হয়। আমার মতে, সেখানকার টয়লেটগুলো শুধুমাত্র বৈষম্যই প্রদর্শন করে না, বরং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যে কোন দুর্ঘটনা বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতেও ফেলতে পারে।

 

আমাদের দেশের পাবলিক স্থাপনাসহ সকল ভবনে এমন একটি সহায়ক ব্যাবস্থাসম্পন্ন টয়লেট তৈরি খুব কঠিন কিছু নয়

 

প্রবেশগম্য টয়লেট এমন হওয়া উচিত যাতে করে সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজন মেটাতে পারে। একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি যেন সহজে ও নিরাপদে নিজেকে হুইলচেয়ার থেকে কমোডে স্থানান্তর করতে পারে এজন্যই দুই সাইডে দুটি ড্রপ-ডাউনবার বা হ্যান্ড রেইল সাপোর্টের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি টয়লেটে একটি করে ইমার্জেন্সি পুল কর্ড থাকা উচিৎ যেন প্রয়োজনে ঐ ব্যক্তি সাহায্যের জন্য অন্য কাউকে ডাকতে পারেন। তবে সবচেয়ে জরুরী হলো, সর্বজনীন প্রবেশগম্য টয়লেট কেমন হওয়া উচিৎ এবং এতে বেসিক কি কি থাকা প্রয়োজন এ ব্যাপারে পেশাদারী পরামর্শ নেয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ ভবন কর্তৃপক্ষের।

 

আমি আশা করব বি-স্ক্যান এর সকল  প্রতিবন্ধী ও অ-প্রতিবন্ধী সদস্যগণ আমার লেখার সাথে সহমত পোষণ করবেন এবং বাংলাদেশে সর্বজনীন প্রবেশগম্য টয়লেটের দূরাবস্থা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করবেন। আমরা চাই সবধরনের সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যেন একটি করে হলেও প্রবেশগম্য টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে। আমি মনে করি বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের এটা একটা ন্যায্য দাবি ও বড় একটা স্বপ্ন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনা করার জন্য রিহ্যাবসহ সকল ডেভেলাপার প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

তারেক কালাম,

প্রবাসী বাঙ্গালী, ম্যানচেস্টার।

Translate | অনুবাদ