বৃষ্টি চৌধুরী
ভোর থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষা এসে গেল দেখতে দেখতে। এখন সারা দিনময় শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। নামের সার্থকতা এখন আর নিজের মাঝে খুঁজে পায় না বৃষ্টি। সারা দিনময় ফ্যাকাশে আকাশ দেখতে ভালোও লাগে না। অথচ এক সময় বৃষ্টি পাগলী বলেই পরিচিতিটা ছিলো বেশি। বেশ উপভোগও করতো ব্যাপারগুলো। কিন্তু সে অন্য এক সময়ের কথা। সময়ের সাথে বুঝি সবই পাল্টে যায়! কথাটা কতোটুকুন সত্যি বুঝতে মন চাইছে…
আজ ভোর ছটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সাধারণত এতো ভোরে উঠার অভ্যাস নেই। আজ আচমকাই চোখ খুলে গেলো। বিছানায় শুয়ে সামনের জানালা দিয়ে বৃষ্টির খেলা দেখার ছলে ভাবনাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিলো বৃষ্টির মাথায়। পাশ ফিরতেই চোখ গেলো গভীর ঘুমে নিমগ্ন চৌধুরীর দিকে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো তাকে। কি অপূর্ব মায়াময় চেহারা। ঘুমন্ত মানুষের চেহারায় বুঝি এই মায়া খেলা করে। সে মায়ার খেলা দেখতে ভালোই লাগলো। এভাবে দেখার সুযোগটাও যে ইদানিং আর হয়ে উঠে না।
সব কিছুই কেমন বদলে যাচ্ছে। দিনগুলো কি দ্রুতই না চলে যাচ্ছে। বলা যায় ফুরিয়ে যাচ্ছে। জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আর বুঝি ফিরে আসবে না কখনো। আরিহ্,আসলেই তো ..পেছনে ফেলে আসা দিন কখনো কি ফিরে পাওয়া যায়!!
কিন্তু অনাগত দিনগুলো যত দ্রুত এগিয়ে আসছে ভয়ে ততই বুকটা কেঁপে উঠছে। অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝে বর্তমানটা কি তবে থমকে থাকে!?
স্বপ্ন-ইচ্ছে-চাহিদাগুলো ছুড়ে ফেলে দিনে দিনে রোবটে পরিণত হওয়া চৌধুরীকে দেখে অন্তত তাই মনে হয় তার। কিন্তু সে তো কেবল বৃষ্টির সামনে এলে। আম্মা সেদিন বললেন, তোমরা দুজনেই তো বাচ্চা! তোমরা আবার করবে সংসার!! বৃষ্টির অবুঝপনা ছেলেমানুষীগুলোই বুঝি দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আচমকা গুনগুন আওয়াজে থমকে দাঁড়ায় বৃষ্টি। চায়ের কাপটা ছলকে উঠে। শেষ বিকেলের আলোয় সোনালী হয়ে উঠেছে পাশের রুমটা। ঐ যে… কি প্রাণবন্ত হাসির ছটা চৌধুরীর চোখে মুখে। দেবদূতের মতোনই নিষ্পাপ। আহা…হাসুক সে! দরজাটা ভেজিয়ে আলগোছে সরে আসে বৃষ্টি।
গুটিগুটি পায়ে সিঁড়িঘর থেকে বেড়িয়ে এসে আচমকা খানিকটা থমকে দাঁড়ায় সে। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে এখন। আজ অনেকদিনের পরে নীলাকাশে মেঘের পাল দেখে এক ধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে মন জুড়ে। একবার পাঁচতলার দিকে তাকালো। কেমন যেনো গা শিরশির করে ওঠে তবুও জোর করে তাকালো। নাহ! কিছুই চোখে পড়ছে না। এক টুকরো অনুভূতিও ডাকছে না।
ভিজতে ভিজতে স্কুল পোশাক পরিহিত কিছু ছেলে মেয়ে পাশ দিয়ে ছুটে গেলো। সেই ছোট্টবেলায় এমনি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেও বাড়ি ফিরতো। মায়ের বকুনিও কম শুনতে হয় নি। সেই পাগলামীটাই মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো ভেতরে। এক হাতের ছাতাটা ছুড়ে ফেলে রাস্তায় নেমে পড়লো সে। যতো বাধাই পথ আগলে রাখুক আজ সে তবুও এই বৃষ্টিতে ভিজেই সামনের দিকে হেঁটে যাবে। আরো অনেকটা পথ সামনের দিকে…অন্য হাতের ক্রাচে ভর করে ক্লান্তিহীন হেঁটেই যাবে কেবলি সামনের দিকে। যতদূর যাবে, পথ কখনোই ফুরোবে না…যেন অনন্তকাল ধরে গোধুলীবেলার বৃষ্টি ভেজা এই পথ প্রতীক্ষায় ছিল তার!