বাড়ি13th issue, December 2015প্রতিবন্ধী মানুষ নাকি প্রতিবন্ধকতা

প্রতিবন্ধী মানুষ নাকি প্রতিবন্ধকতা

 

 মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 

ইলেকট্রনিক্স ল্যাবরেটরিতে ছেলেমেয়েরা ক্লাশ করছে, আমি ভেতরে ঢুকতেই সবাই কাজ থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “তোমাদের ক্লাশে আজকে একজন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে।”

ছেলেমেয়েরা একটু অবাক হয়ে তাকাল। অনেকদিন আগেই নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। এখন এতোদিন পর একজন নতুন ছাত্রীর আসার কথা না। আর যদি এসেও থাকে সেটা আমার ল্যাবরেটরি ক্লাশের মাঝখানে ঘোষণা দেয়ার কথা না।

আমি বললাম, “আমার চারজন ভলান্টিয়ার দরকার। মোটা তাজা ভলান্টিয়ার।”

ছাত্রছাত্রীরা আরো অবাক হল, নতুন ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সাথে ভলান্টিয়ারের কী সম্পর্ক? আর ভলান্টিয়ার যদিও যা দরকার হয় মোটা তাজা ভলান্টিয়ার কেন?

আমি তখন তাদের কারণটা বললাম, “ নতুন যে ছাত্রীটি এসেছে সে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। তার হুইলচেয়ারটা ধরে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে তুলে নিয়ে আসতে হবে।”

 

আমার কথা শোনা মাত্র চারজনের জায়গায় ডজন খানেক ভলান্টিয়ার রেডি হয়ে গেল। আমি বললাম, “আর সবাই শোনো, এই নতুন ছাত্রীটিকে ঠিক তোমাদের একজন বলে ধরে নেবে। তাকে করুণা করবে না, মায়া দেখাবে না। নিজের মত চলতে দেবে, শুধুমাত্র যে কাজটুকু তার নিজের পক্ষে করা সম্ভব না সেই কাজটায় তাকে সাহায্য করবে। মনে থাকবে?”

ছাত্র-ছাত্রীরা মাথা নেড়ে বলল মনে থাকবে। কিছুক্ষণের ভেতর ভলান্টিয়াররা নতুন ছাত্রীটিকে তাদের ক্লাশে নিয়ে এল।

ঠিক এভাবেই আমাদের বিভাগে হুইলচেয়ারে থাকা একজন ছাত্রীকে নিয়ে লেখাপড়া শুরু হয়েছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু এখানে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করার মতো পরিবেশ নেই। দেশে এখন আইন হয়েছে প্রত্যেকটা নতুন বিল্ডিংয়ে সবার জন্যে “প্রবেশগম্যতা” থাকতে হবে। প্রবেশগম্যতা শব্দটি আগে শোনা যেতো না, আজকাল শুনতে পাই।

 

আমাদের সরকারী বাজেটে লেখা আছেঃ “প্রবেশগম্যতা” অর্থ ভৌত অবকাঠামো, যানবহন, যোগাযোগ তথ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সকল সুবিধা ও সেবাসমূহে অন্যান্যদের মত প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণ প্রাপ্তির অধিকার।” সেই একই গেজেটের একটি অংশ হচ্ছে “প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার” এবং সেখানে নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য প্রথম পাঁচটি অধিকারের কথা বলেই প্রবেশগম্যতার কথা বলা হয়েছে।

যদি আমাদের দেশের বিল্ডিংগুলোতে পথে ঘাটে সত্যি সত্যি প্রবেশগম্যতা তৈরি করে দেওয়া যেতো সেটি কতো বড় একটি কাজ হতো কেউ কল্পনা করতে পারে? প্রবেশগম্যতার দাবীটি তো আর অন্যায় অযৌক্তিক কাল্পনিক দাবী নয় এটি আমাদের দেশের আইনে আমাদের অংশীদার করা একটা অধিকারের দাবী।

 

আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যা কতো? সঠিক সংখ্যাটি আমি খুঁজে বের করতে পারি নি তবে সারা পৃথিবীর জরীপে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে সংখ্যাটি পনের শতাংশ। আমাদের বাংলাদেশের জন্যেও এটা নিশ্চয়ই সত্যি শুধু তাই নয় বাংলাদেশের জন্যেও এই সংখ্যাটি আরো বেশী হতে পারে কেন না দেখা গেছে প্রতিবন্ধীদের শতকরা আশি ভাগ এসেছে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে। আমাদের দেশের জন্যে সংখ্যাটি যদি পনেরো শতাংশই ধরে নেই তাহলে এই দেশের মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই কোটি। সংখ্যায় পুরো অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা থেকে বেশী। আমাদের দেশে আদিবাসী মানুষের সংখ্যা বিশ লাখের মত, তারা খুব ভালো অবস্থানে নেই। তারপরও তাদের কোনো একটা কিছু হলে দেশের মানুষ তাদেরকে বুক আগলে রক্ষা করার চেষ্টা করে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়, মানববন্ধন হয়। সব সময় যে সমস্যার সমাধান হয় তা নয়, কিন্তু অন্তত তাদের জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা হয়েছে সেটা মনে করে আমরা একটু সান্তনা পাবার চেষ্টা করি। এই দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা আদিবাসী মানুষের সংখ্যা থেকে প্রায় দশ গুণ বেশী কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহও নেই। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে এরকম একটি ছেলে বা মেয়ের পড়াশোনা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন সেই খবরটি কখনো খবরের কাগজে আসে না, মিডিয়াতে প্রচারিত হয় না।

 

শুধুমাত্র হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে বলে একটি মেয়ে হোমিওপ্যাথিক কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। আমি এই ঘটনাটির কথা জানি কারণ আমি নিজেও তার জন্যে কথাবার্তা বলেছিলাম। দেশের আইনে তার অধিকারের কথা বলা আছে কিন্তু তারপরও এই মানুষগুলো অসহায়। তারা কোনো দয়া দাক্ষিণ্য চায় না, এই দেশ তাদেরকে যে অধিকার দিয়েছে সেই অধিকারটুকু ব্যবহার করে একটু লেখাপড়া করতে চায়। সেই সুযোগটুকু দেবার জন্যে কর্তৃপক্ষকে কতোটুকুই বা বাড়তি কাজ করতে হবে কিন্তু সেটাও তারা করতে রাজী নয়।

অথচ ব্যাপারটা স¤পূর্ণ অন্যভাবে দেখা সম্ভব। এই দেশে কম পক্ষে সোয়া দুই কোটি মানুষকে আমরা প্রতিবন্ধী বলি (যদিও আমার প্রতিবন্ধী শব্দটিতে গুরুতর আপত্তি আছে, তাদের জীবনে যেটুকু প্রতিবন্ধিতা শুধু সেটুকু সরিয়ে দিলেই তারা শুধু যে আমাদের মত মানুষ তা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের থেকে অনেক বেশী কর্মক্ষম, অনেক বেশী সৃজনশীল, এটি আমার নিজের চোখে দেখা।) সোয়া দুই কোটি মানুষের এক তৃতীয়াংশ হচ্ছে কমবয়সী যাদের স্কুলে যাবার কথা। অর্থাৎ প্রায় পঁচাত্তর লক্ষ শিশুকে আমরা লেখাপড়া করার সুযোগ দিচ্ছি না। এর ভেতরে নানা ধরণের প্রতিবন্ধিতা আছে, হয়তো একটা অংশের জন্যে খুবই বিশেষ ধরণের স্কুল দরকার কিন্তু তাদের বড় একটা অংশ একবারে সাধারণ স্কুলে যেতে পারে এবং যাওয়া উচিৎ।

 

এই দেশে এখন যে শিক্ষানীতিটি আছে সেই শিক্ষানীতিটি প্রণয়নের কমিটিতে আমি একজন সদস্য ছিলাম।

আমার মনে আছে, একেবারে প্রথম অধ্যায়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করার সময় যে লাইনটি লিখতে পেরে কমিটির সব সদস্যই এক ধরণের আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলেন সেটি হচ্ছে “সব ধরণের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।”

আমলাদের কারণে এই শিক্ষানীতির অনেক কিছুই খোয়া গেছে। শিক্ষানীতিতে নেই তারপরও জোর করে কিছু বিষয় চালু করা হয়েছে এরকম ঘটনাও ঘটেছে কিন্তু তারপরেও যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট করে বলা আছে তার একটি হচ্ছে একীভূত শিক্ষা। যার অর্থ সব ধরণের ছেলেমেয়ে একই স্কুলে পড়বে। অর্থাৎ একজন ছেলে বা মেয়ে যদি চোখে দেখতে না পায়, কথা বলতে না পারে, কথা শুনতে না পারে কিংবা হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে না পারে তাদের জন্যে আলাদা বা বিশেষ স্কুলের প্রয়োজন নেই। আমাদের যে সাধারণ স্কুলগুলো আছে সেখানে অন্য সব ছেলেমেয়েদের সাথে পড়বে। তাদের যদি বিশেষ কোনো প্রয়োজন থাকে তাহলে তার জন্যে স্কুল আলাদাভাবে একটু প্রস্তুতি নেবে তার বেশী কিছু নয়।

 

এই দেশে এরকম বিশেষ প্রয়োজন আছে সেরকম ছেলেমেয়ের সংখ্যা পঁচাত্তর লক্ষ। পঁচাত্তর লক্ষ ছেলেমেয়ের জন্যে একটা রাষ্ট্র যদি আলাদা একটু ব্যবস্থা না করে তাহলে কেমন করে হবে? পৃথিবীতে বেশীর ভাগ দেশের মোট জনসংখ্যাই তো পঁচাত্তর লক্ষ থেকে কম।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশে বিশেষ প্রয়োজন থাকা ছেলেমেয়েদের বিশেষ ধরণের স্কুলগুলো সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। লেখাপড়ার বিষয় কেন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে? লেখাপড়ার সব কিছু থাকার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এই অত্যন্ত সহজ বিষয়টা কেন কারো চোখে পড়ে না সেটি কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকে না। অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিশেষ প্রয়োজন থাকা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার সাথে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটা সম্পর্ক হয়তো আবিষ্কার করা যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি যার সাথে সম্পর্ক সেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কথাটা কেন আমাদের ভুলে যেতে হবে? যদি সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকতো তাহলে প্রত্যেকবার যখন শিক্ষার নতুন একটা পরিকল্পনা কাজে লাগানো হতো তাহলে এই বিশেষায়িত স্কুলগুলোও তার সুফল পেতে পারতো। এই স্কুলগুলোর দেখভাল করতে পারতো শিক্ষাবিদেরা। আমার মনে হয় এই বিষয়টা নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করার সময় হয়েছে।

যাই হোক দেশ রাষ্ট্র সমাজ যাদের প্রতিবন্ধী বলে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাকেও মাঝে মাঝে তাদের প্রতিবন্ধী মানুষ বলতে হয় কিন্তু আমি কখনোই এই শব্দটিতে স্বস্তি অনুভব করি না। আমি অনেকবার দেখেছি শারীরিক বা মানসিক একটা দিকে তাদের খানিকটা সীমাবদ্ধতা থাকলেও অন্য অনেকদিক দিয়ে তারা সেটা পুষিয়ে নিয়েছেন।

 

মনে আছে একবার কোনো একটা মিটিংয়ে বিশাল কনফারেন্স টেবিল ঘিরে আমরা অনেকে বসে আছি। টেবিলের এক কোনায় একজন চোখে কালো চশমা পরে বসে আছেন, তিনি দেখতে পান না কিন্তু রীতিমত লেখাপড়া করে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেন। টেবিলে অনেকেই আছেন, একেবারে অন্য মাথায় যিনি বসে আছেন ধরা যাক তার নাম জাহিদ (আসল নাম এতোদিন পর আমার মনে নেই), মিটিং চলছে, হঠাৎ করে জাহিদ সাহেবের সামনে রাখা কাঁচের গ্লাসটি তার হাতে লেগে পড়ে গেল, নিচে পড়ে সেটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে যেতো কিন্তু জাহিদ সাহেব সেটা মেঝেতে পড়ার আগেই খপ করে ধরে ফেললেন। কাছাকাছি বসে থাকায় আমরা দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। ঠিক তখন বিশাল টেবিলের একেবারে অন্য মাথায় বসে থাকা কালো চশমা পরা চোখে দেখতে পান না মানুষটি বলে উঠলেন, “নাইস ক্যাচ, জাহিদ।”

আমি এখনো বুঝতে পারি না শুধুমাত্র একটুখানি শব্দ শুনে তিনি যেমন করে বুঝতে পারলেন একটি কাঁচের গ্লাস নিচে পড়ে যাবার মূহুর্তে সেটি ধরে ফেলা হয়েছে এবং সেই ঘটনাটি ঘটেছে টেবিলের অন্য মাথায় বসে থাকা জাহিদ নামক মানুষটির কাছে? আমি নিজের চোখে দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি যে একজন মানুষ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও অন্য কিছু বিষয়ে তার ক্ষমতাটি অবিশ্বাস্য কিন্তু একটা হতে পারে, এবং তাদেরকে সে জন্যে আমাদের যথোপযুক্ত সম্মানটি দিতে হবে।

 

তাই প্রতিবন্ধী শব্দটি আমার খুব অপছন্দের শব্দ। আমার বরং উল্টোটা মনে হয়। আমার মনে হয় কিছু মানুষের সামনে আমরাই বরং প্রতিবন্ধকতা দিয়ে রেখেছি, স্বার্থপরের মতো সেই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি না, তাই তাদের অবিশ্বাস্য ক্ষমতাটা আমরা ব্যবহার করতে পারছি না।

আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের বাংলাদেশে আমরা একদিন সবার সামনে থেকে সকল প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নেব, তখন এই দেশটি হয়ে উঠবে মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসার একটা বিস্ময়কর উদাহরণ।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ