বাড়ি17th issue, December 2016পিঁপড়া থেকে শেখা আত্মনির্ভরশীলতার গল্প

পিঁপড়া থেকে শেখা আত্মনির্ভরশীলতার গল্প

নুরুন্নাহার তনিমা

 

অনেক দিন আগের কথা! কাঁঠালবাগানের একটা দোতলা বাসায় থাকি আমরা। তিন বোনকে নিয়ে বাবা-মায়ের সংসার। বাবার অসীম স্নেহ-মমতার বেড়াজালে আবদ্ধ তিন বোনই। আদরের শেষ নেই। কখনো আমাদের কোনো কাজ করতে দেবেন না তিনি।

বাবার বক্তব্য, যত দিন আমি বেঁচে আছি, তত দিন তোমাদের কাজ করতে হবে না। তিনি মনে করতেন, কাজ করলে আমরা ব্যথা পাব। বাবার কষ্ট হবে। বাবার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তিন বোনের মধ্যে আমরা ছোট দুই বোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন ছোটবেলা থেকেই। তারপরও আমরা ঘরের কিছু টুকটাক কাজ করতাম। গানের চর্চা করতাম। পাশাপাশি ব্রেইলে পড়ার প্রচেষ্টাও চলত অল্পস্বল্প। মায়ের সঙ্গে রান্না করার অনুমতি কেবল বড় আপার ছিল। আগুনের কাছে আমাদের যেতে দেওয়া হবে না এ ব্যাপারে বাবা রীতিমতো ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছিলেন।

 

এর মধ্যে একদিন গ্রামের বাড়ি বরিশাল থেকে খবর এলো, বাবা-মাকে বাড়ি যেতে হবে। আমাদের তিন বোনকে বাসায় একা রেখে বাবা-মা এক সপ্তাহের জন্য চলে গেলেন। মা কিছু খাবার রান্না করে রেখে গেলেন। তবু তো টুকিটাকি কিছু করা লাগে। বিশেষত দুপুরে বড় আপা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, তখন আমরা দুজন ডিম ভাজা আর রুটি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেব। সকালে বড় আপা খাবার রান্না টেবিলের ওপর গুছিয়ে রেখে যেত। প্রতিদিন নির্দিষ্ট এক জায়গাতেই খাবার রাখা থাকত, সহজে যেন আমরা খুঁজে পাই। একদিন দুপুরে আমি বাটিতে হাত দিতেই আমার হাতে ছোট ছোট কী যেন উঠে এল! আমি না বুঝে বাটি হাতে নিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতে পিচ্চি পিচ্চি এসব পোকা আরো বেশি করে উঠতে শুরু করল। আমি হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলেই কুট কুট করে ছোট্ট ওই প্রাণীগুলো কামড় দিতে শুরু করল আমার হাতে। আর তখনই বুঝলাম, এই পিচ্চি প্রাণী পিঁপড়া আমাদের খাবারে ভাগ বসাতে এসেছে। আমি আমার ছোট বোন চাঁদনীকে ডেকে খাবারে পিঁপড়া ওঠার কথা জানালাম এবং দুজনে মিলে এই পিঁপড়া তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমরা যতই চেষ্টা করি, পিঁপড়া ততই আমাদের আরো কামড়ানো অব্যাহত রাখল।

 

সেদিন আমরা অনুভব করলাম দৈনন্দিন কাজ শিখে স্বাবলম্বী হওয়ার গুরুত্ব কতখানি। সেদিনের শিক্ষা থেকে বাবাও অনুধাবন করলেন, তিনি যত দিন বেঁচে আছেন, তত দিন না হয় আমাদের দেখাশোনা করছেন। কিন্তু তাঁদের তো একসময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতেই হবে। তখন তাঁর এই দুই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কন্যার জীবন পরনির্ভরশীলতার শিকল থেকে মুক্ত হবে কীভাবে! বাবা তাঁর চিন্তার গতিপথ পাল্টে ফেললেন। প্রতিনিয়ত আমাদের দুজনকে কাজকর্ম শিখতে উৎসাহ দেওয়ার ফলে এখন আমরা নিজেদের সব কাজ করতে শিখে গিয়েছি। রান্নাও করতে পারি। সবই পারি।

 

আমাদের দেশে সব বাবা-মা তাঁদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে এই ভাবনা পোষণ করে থাকেন, যা ঠিক নয়। যেমনটা আমার বাবা করেছিলেন। অভিভাবকেরা তাঁদের অপ্রতিবন্ধী সন্তানকে কর্মক্ষম করে তোলার জন্য শিশুকাল থেকে যতটা নিবিড় পরিচর্যায় তাদের বড় করেন, ঠিক তার উল্টোটা করেন প্রতিবন্ধী সন্তানকে দুর্বল ও অক্ষম ভেবে। আদর-ভালোবাসার মানে এই নয় যে সন্তানকে ঘরে বসিয়ে রাখা। সত্যিকারের ভালোবাসা হলো, ছেলেমেয়েদের সব কাজ শিখিয়ে এমনভাবে তৈরি করা, যেন তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করতে পারে।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ