পরিবর্তনের চেতনায় নিবেদিত প্রাণ – বি-স্ক্যান

২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হওয়া মাননীয় প্রধান মন্ত্রীকে লেখা একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণার উদ্দেশ্যে বি-স্ক্যান নিয়ে ভাবনার সুচনা। ২০০৯ এর ১৭ ই জুলাই সর্বক্ষেত্রে প্রবেশের সুবিধা চাই এই স্লোগান নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকে অনলাইন গ্রুপের মাধ্যমে বি-স্ক্যান এর যাত্রা শুরু। বি-স্ক্যান মূলত একটি স্বেচ্ছাশ্রমধর্মী সংগঠন।  বাংলাদেশের অবহেলিত সুবিধা বঞ্চিত প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, যাতায়াত ও সর্বক্ষেত্রে প্রবেশের সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগণকে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে কাজ করি আমরা। এদেশের প্রতিবন্ধী মানুষেরা যে জীবন এতদিন কাটিয়ে এসেছেন আমরা তার পরিবর্তন আনতে চাই জনসচেতনতার মাধ্যমে। কারণ আমরা মনে করি সমাজে ব্যক্তির আচরণই আমাদের প্রথম প্রতিবন্ধকতা, যা বাধা হয়ে না দাড়ালে আজ আমরা এভাবে পিছিয়ে থাকতাম না। আমরা স্বপ্ন দেখি ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলোর একটি সুন্দর ভবিষ্যতের। এবং সেটি কখনোই সমাজ থেকে আলাদা হয়ে সম্ভব নয়। আমরা এ সমাজের আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মত জীবন যাপন করতে চাই। তাদের সাথে নিয়েই পথ চলতে চাই। আর তাই আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোতেও কোন বৈষম্য রাখি নি আমরা। প্রতিবন্ধী ও অ-প্রতিবন্ধী নিবন্ধিত সদস্যগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে বি-স্ক্যান এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এছাড়াও নিবন্ধিত সদস্য এবং অনলাইনের সম্মানিত সদস্যগণ সকলেই বি-স্ক্যান এর সকল আয়োজনে আমন্ত্রিত হন। এবং প্রায় সময় স্বইচ্ছায় নানাভাবে বি-স্ক্যানকে সহায়তা দিয়ে থাকেন।

আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমাদের প্রয়াত উপদেষ্টা মরহুম মোঃ মাহবুবুল আশরাফ, এসোসিয়েশেন ফর দ্যা ওয়েলফেয়ার অব দ্যা ডিজেবেল্ড পিপল (এডব্লিউডিপি) এর সচিব ও সমন্বয়ক এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমাদের সৌভাগ্য খুব স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও প্রচার বিমুখ এই নিবেদিত প্রাণ সংগঠক মানুষটির সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলাম আমরা। মাথার উপরের ছায়াটি সরে গেছে যেনো তার অকাল মৃত্যুতে। তবে আরো কিছু মানুষ বটবৃক্ষের মত আমাদের ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন এখনো।

আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ও ল্যাবোরেটরি সার্ভিসেস, বারডেমের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ শুভাগত চৌধূরী।

এছাড়াও উপদেষ্টা হিসেবে আরো আছেন: নর্থ ক্যারোলিনার বাসিন্দা, ক্যারোলিনা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ড. এবিএম নাসির।  আরো আছেন ভাস্কর্য শিল্পী ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী ও প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা কামরুল হাসান মাহফুজ।

বি-স্ক্যানের মূল উদ্দেশ্য, আগামী ২০১৫ সালের মাঝে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ কে ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের নাগরিক মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। গণজাগরণ সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য একটি মানবিক সমাজব্যবস্থা গঠনে কার্যকর ও উদ্যোগী ভূমিকা রাখা। এই উদ্দেশ্য পূরণে বি-স্ক্যান চারটি বিষয়কে সামনে রেখে কাজ করছে।

একীভূত শিক্ষাঃ ভিন্নভাবে সক্ষম শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একীভূত শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা।

চাকরিঃ যোগ্যতা অনুযায়ী ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তির চাকরি নিশ্চিত করা।

সহায়ক যাতায়াতঃ দেশের শত করা ৫ ভাগ যানবাহনকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে গড়ে তোলা।

সর্বক্ষেত্রে প্রবেশের সুবিধাঃ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিল্ডিংয়ে প্রবেশগম্যতা তৈরীতে জনগণকে সচেতন করা।

বি-স্ক্যান এর উল্লেখযোগ্য কিছু কার্যক্রম তুলে ধরা হলোঃ

শিক্ষা প্রকল্পঃ সরকারের মহাপরিকল্পনা ২০১৫ সালের মাঝে প্রতিবন্ধী শিশুসহ সকল শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার কথা মাথায় রেখে আমরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণার কাজ হাতে নিয়েছি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষা সহায়ক ব্যবস্থার গুরুত্ব বোঝাতে এবং প্রতিবন্ধী মানুষের সহায়ক ব্যবস্থা স¤পর্কে অভিভাবক-ছাত্র-শিক্ষকদের সচেতন করে তুলতে ফেস্টুন, পোস্টার ও ছবির মাধ্যমে নানাভাবে প্রচারণা ও প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করে থাকেন বি-স্ক্যান সদস্যগণ। সচেতনতা ও “সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা” (Universal Accessibility) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংলিষ্ট মহলকে উদ্যোগ নিতে বি-স্ক্যান এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানও পরিচালিত হয়। এবং পরবর্তীতে কোটা ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু দাবীর সাথে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে সংগৃহীত স্বাক্ষরগুলো মাননীয় উপাচার্যের হাতে তুলে দেয়া হয়। তাছাড়া, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষা উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বি-স্ক্যান এর পক্ষ থেকে তাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।

স্বনির্ভর প্রকল্প- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে অনেকেই আছেন যাঁদের অবস্থা এতো খারাপ নয় যে তারা আর্থিক অনুদান নেবেন। কিন্তু কিছু টাকা সুদমুক্ত ঋণ পেলে তারা কোন একটা ব্যবসা শুরু করতে পারেন। সে কথা মাথায় রেখেই বি-স্ক্যান সুদমুক্ত ঋণ প্রকল্প চালু করেছে।

 

প্রবেশগম্যতা ও যাতায়াতঃ বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিগণ। কারণ তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সহায়ক যাতায়াত ও প্রবেশগম্যতা। শুধুমাত্র এ দুয়ের অভাবে তারা বঞ্চিত হন শিক্ষা, চাকুরী সর্বপোরী স্বাভাবিক জীবন যাপনের সবরকম সুযোগ থেকে। রোটারি ক্লাব অব ঢাকা সেন্ট্রালকে সাথে নিয়ে আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ভবনকে প্রবেশগম্য করে তোলার কাজ হাতে নেই। সেই লক্ষ্যে প্রথমেই আমরা জাতীয় জাদুঘরকে বেছে নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে বৈঠক করি আমরা। কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছি যাদুঘরে সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার কাজটি শুরু হয়ে গেছে। বি-স্ক্যান এর কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে চট্টগ্রাম সমিতি- ঢাকা কর্তৃপক্ষ তাদের সমিতি ভবনে মঞ্চের সাথে যুক্ত করেছেন একটি কাঠের র‌্যাম্প। ভবনের টয়লটেকে করেছেন প্রবেশগম্য। আর আমাদের মাঝে জ্বালিয়েছেন নতুন করে আশার আলো।

 

র‌্যাম্পযুক্ত যানবাহন ও প্রবেশগম্য ভবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবছরই ২রা মার্চে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরা সিআরপি’র সাথে যৌথ উদ্যেগে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের নিয়ে হুইলচেয়ার র‌্যালী এবং সমাবেশের আয়োজন করি। এতে ৭০জন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষ একাÍতা ঘোষণা করে অংশ নেন। যেখানে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের বলেন – এখন থেকে বি আর টি সি বাসে র‌্যাম্প যুক্ত করা হবে, তার এই প্রতিশ্র“তির প্রেক্ষিতে আমরা বিআরটিসির সাথেও আলোচনা করে যাচ্ছি। আমাদের প্রত্যাশা খুব শিগ্যিরই বাংলাদেশেও র‌্যাম্পযুক্ত বাস অবশ্যই চালু হবে।

এবারে এমন কিছু বিষয় উল্লেখ্য করা হলো যা আমাদের দেশে মাত্র শুরু হয়েছেঃ

পোর্টেবল র‌্যাম্পঃ ইউটিউবে বিদেশী ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে  বাংলাদেশে এই প্রথম সহজে বহনযোগ্য কাঠের মাল্টিফোল্ড পোর্টেবল র‌্যাম্প তৈরি এবং সুলভ মূল্যে বিক্রয় করে থাকি আমরা। যেখানে স্থায়ী র‌্যাম্প তৈরীতে মানুষ উৎসাহী নয় সেখানে কম উচ্চতায় সহজেই এটি ব্যবহার করা যাবে। বি-স্ক্যানের বিভিন্ন আয়োজনে এই র‌্যাম্পটি দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে উঠেন।

ডিজেবিলিটি লোগোঃ প্রবেশগম্যতা চিহ্নিত করণ প্রকল্পের আওতায় ডিজেবিলিটি লোগো ছড়িয়ে দেবার পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা। বাংলাদেশে অনেকেরই জানা নেই অনেক বিল্ডিংয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে কোন রকম বাধা ছাড়াই লিফটে উপরে উঠা যায়। সেই জায়গাগুলো যদি শুধু একটি লোগো দিয়ে চিহ্নিত করা যায় তাহলে অনেকেই সচেতন হবেন। আবার কিছু কিছু জায়গায় র‌্যাম্প থাকলেও অনেকেই জানেন না এটা কি এবং কাদের জন্য করা হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সরকারী ও বেসরকারী বেশ কিছু ভবনকে চিহ্নিত করে ডিজেবিলিটি লোগো লাগানো হয়েছে।

বিভিন্ন কার্যক্রমাদিঃ প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার লক্ষ্যে আমাদের প্রচারণা প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যেই একটি শর্ট ফিল্ম ও একটি শর্ট ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা হয়েছে। আরো কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব তৈরিতে চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি ছাড়াও কিছু নির্মাতা স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে কাজ করছেন। এছাড়াও ভবিষ্যতে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। সমাজে নেতিবাচক ভাবনার পরিবর্তে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে সচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার করে থাকি আমরা। এছাড়াও আগামী প্রজন্মের শিশুদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে যা ভবিষ্যতেও অব্যহত থাকবে। এছাড়া আমাদের ক¤িপউটার ট্রেনিং, স্বনির্ভর প্রকল্প, বইকেনা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ, এককালীন ও মাসিক শিক্ষা বৃত্তি এবং চিকিৎসা, হুইলচেয়ার প্রদান ও শীত বস্ত্র বিতরণ ইত্যাদি নানান কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।

আমরা মনে করি, প্রথমত একজন ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে তাদের নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।  প্রতিবন্ধিতা মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়, তাকে শুধু এই মানসিক শক্তিটুকু দেয়া প্রয়োজন যে তাকে এটা নিয়েই বাঁচতে হবে।  আর একমাত্র পারিবারিক সচেতনতাই পারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে। আমাদের বিশ্বাস সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষের সমস্ত সহায়ক ব্যবস্থা সম্বোলিত বাসযোগ্য একটি দেশ। আর তাই বি-স্ক্যান এর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা অব্যহত থাকবে।