সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

– ইফতেখার মাহমুদ

প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক মেরুকরণ রচিত হয়েছে এমন একটি দেশের মানুষের সাথে পাঁচ দিন কাটিয়ে এলাম। তবে ঘুরে বেড়ানোর তেমন সুযোগ হয়নি। হোটেল আর কর্মশালা কক্ষ। আলোচ্য বিষয় সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার আলোকে হবে উন্নয়ন কর্মকান্ড।

এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অংশীজনদের দক্ষতা উন্নয়ন ও বর্তমান কর্মকান্ডের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অংশ হিসেবে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলাতে সামাজিক সুরক্ষা সপ্তাহ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই আয়োজনে প্রতিবন্ধী মানুষের দায়িত্বে ছিল আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধিতা মোর্চা (ইন্টারন্যাশনাল ডিজেবিলিটি এ্যালায়েন্স – আইডিএ)।

বাংলাদেশে কর্মরত ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা লিওনার্ড চেশায়ার্ড (এলসি) থেকে বি-স্ক্যানের পক্ষে মনোনিত হয়ে আমি এই সম্মেলনে অংশ নেই। বাংলাদেশ থেকে আরও অংশ নেন এ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মহুয়া পাল ও তাসলিম জাহান বিথি। বাংলাদেশসহ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এগারোটি দেশের মোট আঠারো জন ডিপিও প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নেন। দেশগুলো হলো জাপান, ফিজি, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, পূর্ব তিমুর, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান।

সামাজিক সুরক্ষা (social protection) বলতে আমাদের দেশে দান-দাক্ষিণ্য বা চ্যারিটি সংস্কৃতি অর্থাৎ সরকারের সামাজিক সুরক্ষার নামে যে গরিব বাঁচাও বা চুইয়ে পড়া (trickle down) অর্থনীতির ধারণা আমরা পাই তা বর্তমান সময়ের সাথে উপযোগি নয়। ম্যানিলার সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজনে অংশগ্রহণের ফলে আমার এই প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন হয়। আলোচনায় আমরা বুঝতে পারি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা, সার্বজনীন ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ধারণা আমাদের মধ্যে নতুন নতুন পন্থার জন্ম দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান প্রবীন জনগোষ্ঠী, শিশু সুরক্ষা, নারীর প্রতি ঝুঁকি হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলা, নবীন জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাধা, প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সুফল পাওয়াসহ প্রভৃতি মোকাবেলায় সমাজের প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষা করতে সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষার পদক্ষেপসমূহ আয় অক্ষমতার পরিপূরক হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। কিন্তু সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার ধারণা সমাজে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সমান সুযোগ প্রাপ্তি বা সক্রিয় অংশগ্রহণের দিক থেকে বিবেচনা করা হয়। অপরদিকে এদেশে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে কেবল মাত্র তার পরিবারের আয় বা তার সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তির নিজের আয় বা তার সামাজিক বাধাকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। তাছাড়া সামাজিক সুরক্ষার শর্তসমূহ সুনির্দিষ্ট (targeted) জনগোষ্ঠীদের লক্ষ্য করায় অনেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। ফলে সে কর্মসূচি সার্বজনীন হচ্ছে না।

এমন কি যুগের সাথে মানুষের মর্যাদাবোধের পরিবর্তন ও লক্ষিত জনগোষ্ঠীর পরিসর বৃদ্ধি পেলেও সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচির নামসমূহ এখনো সেকেলে ও আত্ম-মর্যাদা পরিপন্থী রয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক যোগ্য ব্যক্তি সে সকল সুযোগ নিতে ইতস্তত বোধ বা অস্বীকার করছেন।

প্রতিটি দেশের সরকারকে সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার পরিসর বৃদ্ধি করতে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা (Financial Space) বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো নিম্ন কর প্রদানকারী দেশের পক্ষে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দূর্নীতি হ্রাস, জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রজাতান্ত্রিক মনোভাব আমাদের নাগরিকদের কর প্রদানে উৎসাহিত করবে, যা আমাদের দেশে সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার পরিসর বৃদ্ধি ও জনগণের জীবনমান বৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখবে।

সকল প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ভাতা প্রদান একটি যুগান্তকারি পদক্ষেপ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২ এপ্রিল ২০১৯ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সকল নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেন। বর্তমানে প্রচলিত ‘অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা’-এর আওতায় মাসিক ৭৫০ টাকা করে প্রায় ১০ (দশ) লক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এই ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভাতা বিতরণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যক্তির মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ৩৬,০০০ (ছত্রিশ হাজার) টাকার নিচে থাকতে হবে। আবার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অন্য কোন ভাতা পেলে তিনি এই ভাতার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এই ভাতা পেতে হলে বয়স নূন্যতম ৬ (ছয়) বছর হতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র ২০১৫-২০২০ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোন সামাজিক সুরক্ষার আর্থিক পরিমাণ অন্যান্য ভাতার তিনগুন হতে হবে। ফলে বর্তমানে পরিচালিত এই কার্যক্রমটি একটি Targeted program হিসেবে চলছে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা গন্ডিবদ্ধ কর্মসূচিটিকে একটি সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার ধারণাকে বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু বর্তমানে পরিচালিত এই কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে সমান সুযোগ ভাতা (equal opportunities allowance) করার প্রস্তাব করছি। সকল প্রতিবন্ধী মানুষকে এই ভাতা দিতে হলে তার শর্তাদি পরিবর্তন করতে হবে। তাছাড়া কেউ যাতে এই ভাতা নিতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে এবং মর্যাদাহানিকর মনে না করে সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

এডিবির সভার প্রথম দিনেই বাংলাদেশ সরকারের সকল নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ভাতা প্রদানের বিষয়টি আমি সভায় তুলে ধরি। তখন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক উপস্থিত ১৮ জনকে এর পক্ষে-বিপক্ষে মত দিতে বললে ৬ জন পক্ষে, ৭ জন বিপক্ষে ও ৫ জন দ্বিধান্বিত থাকেন। পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্ক শেষে সবাই এর পক্ষে অবস্থান নেন। উলেখ্য যে, প্রচলিত সামাজিক সুরক্ষার ধারণাবদ্ধ হওয়ার কারণে আমি নিজেও এই সার্বজনীন ভাতা কার্যক্রমের বিরোধী ছিলাম।

সমন্বয়কারি
বি-স্ক্যান ও পিএনএসপি