টিভি, পত্রিকায় এবং মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে বেশ কিছু দিন ধরেই “জাতীয় পরিচয় পত্র’’ নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এখানে যাদের বয়স ১ জানুয়ারি ১৯৯৫ বা তার পূর্বে তাদের হালনাগাদকৃত লিস্টে নাম উঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে একজন কর্মী বাসায় আসেন, যিনি নতুন ভোটার হওয়ার কেউ আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। বাসা থেকে তাকে আমার কথা বলা হলে, আমি জানাই বিজ্ঞাপনে দেয়া তারিখের সাথে আমার জন্ম তারিখ চার দিন কম অর্থাৎ আমার জন্ম তারিখ ৪ জানুয়ারি ১৯৯৫। তখন তিনি জানান এটা সমস্যা নয়। আমি আবারও প্রশ্ন তুললে বলেন, “৪/৫ দিন আগ পিছ কোন ব্যাপারই না”। তারপর তিনি আমার এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষার সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন সনদ, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট ও বাবার জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি চেয়ে নেন এবং সাথে সাথে ফর্ম পূরণ করে একটি স্লিপ ধরিয়ে দেন আমাকে। ফর্মটি পূরণ করার সময়ও যথেষ্ট অদক্ষতার ছাপ চোখে পড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ- আমাকে শারীরিক প্রতিবন্ধী দেখা সত্ত্বেও ফর্মের “প্রতিবন্ধী কিনা” এবং ব্লাড গ্রুপের অংশ পূরণ না করেই চলে যাচ্ছিলেন। পরে বলে তা ঠিক করানো হয়।
তিনি যাওয়ার আগে যে স্লিপটি দেন, তাতে ৪ নভেম্বর ২০১২ এর সকাল ৯টায় চট্টগ্রামস্থ ফিরোজসাহ সিটি কর্পোরেশন বালিকা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়। আমিও যথাযথ সময়ে উপস্থিত হয়ে টোকেন নাম্বার অনুসারে আমার ফর্ম বের করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হতে স্বাক্ষর সহ আনুসাংগিক সকল কাজ সম্পন্ন করি। এ কাজে আমার প্রায় দেড় ঘণ্টার মত সময় ব্যয় হয়। কিন্তু ছবি তুলতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। আমাকে বলা হয়, আমার বয়স ৪ দিন কম তাই এই পরিচয় পত্রটি বাতিল বলে গণ্য করা হবে। তখন আমাদের বাসায় যিনি এসেছিলেন তিনি যা বলেছেন তাই তাদের শুনালাম। কিন্তু তারা উত্তরে জানালেন বয়স একদিন কম ও গ্রহণ যোগ্য নয়। আমি তাদের কাছে জানতে চাই, “কেন সরকারী কর্মীর ভুলের কারণে আমি কষ্ট পাবো?” প্রতিউত্তরে তারা বলেন, আমার বয়স পরিবর্তন করে ফেলতে । কিন্তু আমার পরীক্ষার সার্টিফিকেট তারিখ উল্লেখ করে জন্ম তারিখ পরিবর্তনে অপারগতা জানালে তারা তাদের কথা উঠিয়ে “হবে না তাহলে” বলে চলে যান এবং আমিও ফিরে আসতে বাধ্য হই। তবে আসার সময় দেখেছি আমার মত আরও বেশ কয়েকজন ফিরে যাচ্ছেন।
এ কাজে আমি ওই ব্যক্তিদের কাউকেই দোষারোপ করতে চাই না। দোষারোপ করতে চাই সরকারের সেই সব কর্মকর্তাদের যারা মাঠপর্যায়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোন রূপ প্রশিক্ষণ ছাড়াই, অর্ধশিক্ষিত কর্মী প্রেরণ করে। “প্রশিক্ষণ ছাড়া” কথাটি এর জন্য বললাম কারণ পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কেউ এমন বড় ভুল করত না আর আমাকেও এভাবে হয়রানি পোহাতে হত না। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে আমার জন্যে এ ধরনের হয়রানি যে একদম নতুন তা নয়। আমার বা আমাদের মতোন যারা, তাদের সাথে এসব ঘটে চলছে প্রতিনিয়ত। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, এ বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় আমি চট্রগ্রাম বোর্ড হতে অংশগ্রহন করেছিলাম। সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অতিরিক্ত ২০ মিনিট পরীক্ষার সময় বাড়ানোর একটা নতুন নিয়ম করেছে বলে জেনে এসেছি। আমি সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়াতে নিজে লিখতে পারলেও আমার লেখা কিছুটা ধীর গতির তবে লেখা ছাড়াও খাতার পেজ উল্টানো, স্কেল দিয়ে কাজ করার সময় পরীক্ষার মূল্যবান বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়। হাতের সব আঙুল একত্রে কাজ করতে পারেনা বলে সমস্যা গুলো হয়। তাই অতিরিক্ত এই সুবিধা নেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যেগী হলাম। এই করতে গিয়েই জানলাম সরকারি নিবন্ধন লাগবে। সরকারি নিবন্ধন বলতে, সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের আওতায় প্রতিবন্ধী লিস্টে নাম উঠানো এবং আইডি কার্ড প্রাপ্তি। আর চট্টগ্রাম সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরে এই নিবন্ধন পর্যায়েও যথেষ্ট হয়রানির সম্মুখীন হয়েছি আমি। উল্লেখযোগ্য,
– অমার্জিত ব্যবহার যেমন, “প্রতিবন্ধী” বলে সম্বোধন করা। যেন নাম-পরিচয় নেই আমাদের!
– এখান থেকে ওখানে বেশ কয়েকবার দরখাস্ত চালাচালির জন্য বেশ কয়েকদিন পার করে দেয়া।
– ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু শুধু বসিয়ে রাখা।
এত সব হয়রানি আর বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে সব কাগজ পত্র তৈরি করে আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে দিলাম। তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে উপস্থিত হলে তাকে শোনানো হলো, “যারা নিজের হাতে লিখতে পারে তাদের জন্যে আবার কেন অতিরিক্ত সময়!” কেনো যে আমার অতিরিক্ত সময় লাগে তা বোধহয় তারা আমার মতো ভুক্তভ’গী হলেই কেবল বুঝতে পারতেন। অনেক চেষ্টা করেও অতিরিক্ত সময়টুকু আমি পেলাম না। অথচ ২০১০ সালে যখন প্রথম আলোর পাতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যে বরাদ্দ অতিরিক্ত সময় সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি দেখতে পাই সেখানে ¯পষ্ট উল্লেখ ছিলো, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি সেরিব্রাল পালসিজনিত (অপরিণত মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা) এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও শ্রুতিলেখক নিয়োগ এবং অতিরিক্ত ১৫ মিনিট সময় বরাদ্দ পাবেন। পরবর্তীতে তা ২০ মিনিটে উত্তীর্ণ হয়। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারী এ সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু এতসব বিপত্তির পরে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বরত কর্মকর্তা কেন আমার সীমাবদ্ধতা সহকারে নিজের হাতে লেখা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। সরকারী আদেশ মতে শুধুমাত্র শ্র“তি লেখক নিয়োগেই অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার কথা হলো, শ্রুতি লেখকদের যেমন অতিরিক্ত সময় দরকার হয় তেমন আমারও তো সেই সময়টুকু প্রাপ্য। তাহলে আমি বা আমার মতো যারা তারা কেন তা থেকে বঞ্চিত হয় তা আজও আমার বোধগম্য নয়!!
অতিরিক্ত সময় আমি তো আর পেলাম না কিন্তু আমি চাই না ভবিষ্যতে আমার মতন কেউ এমন ভ্রান্ত নিয়মের শিকার হোক। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন-
এসব হয়রানির শেষ কোথায়????
আজিজুর রহমান নাবিল,
ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ, ১ম বর্ষ,
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।