আমার নাম ইতি। বাবার অতি আদরের ইতি। এই ইতি নামের পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। সেটা হলো অপরূপ এই পৃথিবীতে আমার আগমনের মাত্র অল্পসময় আগে মা স্বপ্ন দেখেন ফুলের মতোন ফুটফুটে সুন্দরী এক মেয়ে কোলে নিয়ে তিনি বসে আছেন। তাকে ঘিরে আছে রাজ্যির মানুষ। কেউ এই নাম বলে, কেউ সেই নাম বলে কোন নামই মায়ের পছন্দ হয় না। নানান জল্পনার মাঝে কে যেনো হুট করে বলে উঠলো, মেয়ের নাম রাখুন ইতি। ঠিক সে সময় প্রচন্ড প্রসবব্যাথা নিয়ে মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমাকে প্রথম কোলে নিয়েই মা ঘোষনা দিলেন, এই মেয়ের নাম রাখবো ইতি। ইতি নামেই সবাই আমার মেয়েকে ডাকবে।
পরিবারের সবার আদরে বেড়ে উঠছি। দিনে দিনে আহলাদী আর জেদী হয়ে উঠছি। তবুও কারুর আদর কমে না। আমাকে নিয়ে সবার কাড়াকাড়ি। কিছুক্ষন এর কোলে তো কিছুক্ষন তার কোলে। হঠাৎ একদিন মায়ের খেয়াল হলো মেয়ের মাথায় চুল উঠছে না। শরীরের কোথাও একরত্তি লোম নেই। দাঁতও উঠছে না। দিনে দিনে মেয়ের চেহারা কেমন যেনো অদ্ভূতুড়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না। আমার বড় ভাই দুবছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে হাঁটতে পারে না। সেই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আমার এই অবস্থা। বাবা মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। শুরু হলো ডাক্তার-বদ্যি। ছুটোছুটি। কিন্তু কোনো ডাক্তার এই অদ্ভুত রোগটার নাম জানে না। শেষ পর্যন্ত এক ডাক্তার বললো এই রোগের নাম “Ectodermal Dysplasia” আজ পর্যন্ত যার কোন চিকিৎসা বের হয়নি। ডাক্তারের এই কথা শুনে বাবা-মা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না যে তারা দু’জন সুস্থ -স্বাভাবিক কিন্তু তাদেরই দু’সন্তান এত কষ্টে ভরা জীবন নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এই রোগটি হলে মানুষের শরীরে প্রায় দেড়শো রকমের সমস্যা দেখা যায় যার মাঝে আমার শুধু মাত্র পাঁচ ধরণের সমস্যা দেখা গিয়েছে। যেমন- চুল উঠে নি আমার। শরীরের কোথাও এক রত্তি লোম নেই। যার কারনে গরম একটুও সইতে পারি না আমি। দাঁতও উঠছে না। ভ্রু নেই, মুখে রক্তের দাগ। এই রোগটা হয় জন্মের পর থেকেই। অবশ্য শরীরে আর তেমন অন্য সমস্যা দেখা যায় না। তবে এই মানুষের দৃষ্টিতে এই অদ্ভুতুড়ে শরীর নিয়েই আমৃত্যু জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। তাই স্বাভাবিক জীবন শুরু করার উদ্দেশ্যে ছ’বছর বয়সে ভর্তি হলাম পাড়ার স্কুলে। আমার পাশে কিছুতেই কেউ বসবে না। সবাই আমাকে ভয় পায়। আমি নাকি মানুষ নই ভূত। খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে। কিছুতেই বুঝতাম না তারা আমার সাথে এমন কেন করে! প্রতিদিন ঘরে এসে কান্নাকাটি করতাম। বাবা বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরদিন আবার স্কুলে পাঠাতো। মানুষের নানান কথা আর সহপাঠিদের ঠাট্টা বিদ্রপের সাথেই পঞ্চম শ্রেণীতে খুব ভালোভাবে পাশ করলাম। এবার নতুন স্কুল। বাবার ইচ্ছে নামকরা এক স্কুলে পড়াবেন আমাকে। কিন্তু কোন স্কুলই আমাকে ভর্তি করাবে না। যদিও খুব ভালোভাবেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি আমি কিন্তু ভাইভাতে আমাকে ইচ্ছে করে ঝড়িয়ে দেওয়া হতো। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে মায়ের। প্রচন্ড রাগে তিনি জানতে চাইলেন এতো ভালো রেজাল্ট করা সত্বেও আমার মেয়েকে কেনো ভর্তি করাচ্ছেন না? ২০০৫ সালের ঘটনা এটি। মিরপুর-১৪ এ অবস্থিত শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এ্যান্ড কলেজের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সৈয়দ মনিরূল ইসলাম পি পি এম স্যার আমার সামনেই বলে উঠেন, আপনার মেয়েকে দেখে বাচ্চারা ভয় পাবে। পড়ালেখার পরিবেশই তো থাকবে না এই স্কুলে। অন্য কোথাও ভর্তি করান একে। কিন্তু বাবা মা হাল ছাড়বেন না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে একটি স্কুলকে রাজী করাতে সক্ষম হন। আমাকে তারা সমাজের সামনে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মন্ত্র শেখাতে চান। কিন্তু ততদিনে আমি মানসিক ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছি। মাঠে, ঘাটে, হাটে, বাজারে যেখানেই যাই মানুষের হাসাহাসি, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের খোরাক হয়ে উঠছি। ঘর থেকে বেরুতেই ইচ্ছে হতো না। নিভৃতে কেঁদে বালিশ ভেজাতাম। একরাশ প্রশ্নের দল হানা দিয়ে যেতো মনের কোনে যার কোন উত্তর আমার জানা ছিলো না। তবে এটুক বুঝতাম আমি ঠিক আর দশজনের মত নই। সমাজ আমায় প্রতিবন্ধী ডাকে। কেন ডাকে জানি না। আমি কি আসলেই প্রতিবন্ধী! সমবয়সী মেয়েরা দু’বেনী ঝুলিয়ে কি সুন্দর গল্প গুজবে দল বেধে স্কুলে যায়। আমার কোন বন্ধুই নেই। কেন নেই? আমি তো ইচ্ছে করে এ রোগটি বহন করে আনিনি পৃথিবীতে। সবাই পড়ালেখা করে সুন্দর ভবিষতের স্বপ্ন দেখে আর আমাকে পদে পদে নানা লাঞ্চনা সহ্য করতে হয়। ভাবি আমার ভাইটা তো নিজে নিজে চলা ফেরা করতে পারে না তার না জানি আরো কতো কষ্ট। স্রষ্ঠাকে দোষারোপ করে উঠতাম মাঝে সাঝে। হুট হাট পাগলের মতোন চেঁচিয়ে উঠে মুক্তি চাইতাম দুঃসহ যাপিত জীবনের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে। একসময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বাবা মার প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছি এখন। আমার ভাইয়া কিন্তু একটুও মনোবল হারায়নি। হুইলচেয়ারে অন্যের সাহায্যে এখন সে এম,বি,এ করছে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে। তাই আমিও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছি জীবন নিয়ে। এতো ঝড় ঝাপ্টায় যারা একটুও ভেঙ্গে পড়েননি সেই বাবা মার এতো পরিশ্রম বিফলে যেতে দেওয়া যায় না। আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। এই সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরও আছে। আমরাও পারি।
ফাতেমা আক্তার ইতি,
ছাত্রী, স্বেচ্ছাসেবী সদস্য বি-স্ক্যান।