বহুশ্র“ত একটি গানের লাইন দিয়ে লিখাটা শুরু করছি। আমি যে দেখেছি কতো যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়…। আজকে আমার খুব মনে পড়ছে জীবনের পথে পথে ফেলে আসা অনেক সুন্দর সব মুকুলের কথা। সেইসব মানুষের কথা, যারা প্রস্ফুটিত হবার আগেই ঝরে গেছে জীবনের ক্যানভাস থেকে। আমাদের স্বার্থান্ধ সমাজ, তাদের দিকে ফিরেও তাকায় নি।
এইসব মুকুল যাতে ঝরে না পড়ে, প্রষ্ফুটিত হবার সুযোগ পায়, এই লক্ষ্যে নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান। একই লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে বিকাশ নামে একটি বিশেষ স্কুল। ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য বিশেষায়িত এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সুপ্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং জার্মানির স্বনামধন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অলিম্প এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান অলিম্প-বেজনার ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই অলিম্প-বেজনার ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী শিশু-কিশোরদের জন্য হাসপাতাল, স্কুল ও ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিকাশ স্কুল এলাকার দুঃস্থ অসহায় শিশুদের পাশাপাশি ভিন্নভাবে সক্ষমদের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পাঠদান করবে। স্কুলটিতে ভিন্নভাবে সক্ষমদের পাঠদান এবং পরিচর্যার জন্য ৫ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা রয়েছেন। যারা বিগত এক বছর সেন্টার ফর দ্যা রিহাবিলিটেশন অফ দ্যা প্যারালাইজড বা সিআরপিতে প্রতিবন্ধীবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছেন।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে স্কুলটিতে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম নামে একটি প্রি-প্রাইমারী শ্রেণী এবং ১-৫ পর্যন্ত নিয়মিত শ্রেনীক্রমে, জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের আওতায় পাঠদান করা হচ্ছে। সর্বমোট ১২৫ জন শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহনের সুযোগ পাবে এই স্কুলে। ঢাকার অদূরে টঙ্গির গাজীপুরায় গত ২৪ জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে এই স্কুল।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিয়েলাটেক্স গ্র“পের এমডি ডেভিড হাসানাতকে এই স্কুল নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি জানালেন, এই স্কুলের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন, তাঁর স্ত্রী। তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সাথে সংযুক্ত ছিলেন। তখন তিনি দেখেছেন, তৃণমূল পর্যায়ের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার অভাব কীভাবে আমাদের সম্পূর্ন সমাজ অবকাঠামোকে প্রভাবিত করছে। তিনি দেখেছেন, ভিন্নভাবে সক্ষম একটি শিশুর স্বাভাবিক মেধা থাকার পরেও সামাজিক বঞ্চনার কারণে ব্যাহত হচ্ছে তার চলার গতি। তাই এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা।
ডেভিড হাসানাত কে প্রশ্ন করেছিলাম, এই ধরণের বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠার কারণ কী? তিনি বললেন, ভিন্নভাবে সক্ষমদের জন্য বিশেষ স্কুল কিংবা বিশেষ ব্যবস্থার কনসেপ্ট উন্নত দেশগুলোতে নেই। ওখানের শিশুরা মেইনস্ট্রীমের সাথেই সমানভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। আলাদা স্কুল থাকে শুধুমাত্র একেবারে অক্ষমদের জন্য। সেই ভাবনা থেকে এই স্কুল। কেনো আমাদের এখানে একটি শিশুকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হবে শুধুমাত্র শারীরিক কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য! আপনি স্টিফেন হকিংকে দেখুন। অবাক হবেন। এমন মেধা আমাদেরও আছে। শুধু প্রয়োজন উঠে আসার সঠিক সুযোগ করে দেয়ার। ভিয়েলাটেক্স মনে করে, বি ফড় হড়ঃ ভববফ, নঁঃ ঃবধপয ঃড় ভরংয. ভিন্নভাবে সক্ষমদের জন্য অবহেলাবশত যে ব্যারিয়ার আমরা তৈরী করে রেখেছি, সেটা তুলে দিতে হবে। ডেভিড হাসানাতকে করা আরেকটি প্রশ্ন ছিলো, এতো ঝকঝকে এবং উন্নত ব্যবস্থার স্কুলে সমাজের সাধারণ শ্রেণীর শিশুরা অবাধে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে কী? নাকি, বিশেষ ধনিক শ্রেণীর শিশুদের জন্যই এই ব্যবস্থা? আমাদের আশস্ত করে তিনি জানালেন, স্কুলে বর্তমানে যতো স্টুডেন্ট আছে, তার বেশিরভাগই সাধারণ শ্রেণীর। অনেক পথশিশুকেও শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এনে আংশিক পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীবান্ধব সামাজিক আন্দোলনের পাইওনিয়ার, সিআরপির ভ্যালেরী টেইলর। তার চোখে মানুষের প্রতি মমতার উষ্ণ প্রসবণের অতলান্তিক গভীরতা দেখেছি আমি। দেখলাম, তার ভেতরের মমতার আকাশটা আমার উপরে অটল দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বস্ত সুবিশাল আকাশকেও ঢেকে ফেলতে পারবে। তিনি বললেন এগিয়ে যাওয়ার কথা। শোনালেন প্রত্যয়দীপ্ত গল্পগাঁথা। দেখালেন নতুন কোন আলোঝলমলে ভোরের স্বপ্ন।
কথা বললাম স্কুলের শিক্ষিকা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সাথে। একজন শিক্ষিকা দৃঢ় আশা ব্যক্ত করে বললেন, অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য। সামাজিক অবহেলার এই জায়গাতে সচেতন মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে এই সচেতনতা।
আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি সেদিন দেখেছি প্র¯ফুটিত হবার অধীর অপেক্ষায় থাকা কিছু আনকোড়া ফুলকে। যারা হয়তো একদিন কেউ স্টিফেন হকিং হয়ে উঠবে। বিশ্বায়নের এই সময়ে মানুষ ভয়ঙ্কর হারে আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়ছে। কারো একটুও অবসর নেই। তবুও আমি বিশ্বাস করি, অবস্থার পরিবর্তন হবেই। এতো মানুষের নীরব প্রচেষ্টা বৃথা হবার নয়। এই স্কুলে এসে আমার আবারও মনে হয়েছে, আমাদের পরিবর্তনের মিছিল এগিয়ে চলেছে।
সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছা আর সরকার ও জনসাধারণের সচেতন অংশগ্রহণ এই দুইয়ে মিলে খুব সহজেই তৈরী হতে পারে প্রতিবন্ধীবান্ধব একটি সমাজ। সেদিন হয়তো হুইলচেয়ারে করে হাঁটতে থাকা আমার কোন প্রিয়জনের চোখের গভীরে বেদনার ছাপ থাকবে না। হুইলচেয়ার, স্ক্রাচে ভর করে জেগে উঠবে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ। জেগে উঠবো আমরা।
তাদের বুকপকেটে সযতনে জমিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো বাস্তবের প্রজাপতি হয়ে মেঘের ডানায় করে আকাশ ছোঁবে। সেই স্বপ্নের সহযাত্রী হয়ে আমরাও সেদিন আবার মানুষ হবো।
“বিকাশ স্কুল” ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য একটি বিশেষায়িত স্কুলের নাম
সর্বশেষ
মাসিক আর্কাইভ
- August 2023
- June 2023
- June 2022
- June 2021
- May 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- September 2019
- July 2019
- May 2019
- April 2019
- February 2019
- June 2017
- March 2017
- December 2016
- September 2016
- June 2016
- March 2016
- December 2015
- September 2015
- June 2015
- March 2015
- December 2014
- September 2014
- June 2014
- March 2014
- December 2013
- September 2013
- June 2013
- March 2013
- December 2012