আজমল হোসেন মামুন:গত ৫ সেপ্টেম্বর ছিলো জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফোরাম (এনএফওডব্লিউডি) এর সহ-সভাপতি, এ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ওয়েল ফেয়ার অব দি ডিজএ্যাবল্ড পিপল (এডব্লিউডিপি) এর সেক্রেটারী, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) এর সাবেক সহকারী পরিচালক, বি-স্ক্যান এর অন্যতম উপদেষ্টা, বিশিষ্ট প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক উন্নয়নকর্মী, গবেষক এবং অনুবাদক মোঃ মাহবুবুল আশরাফ ভাইয়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
যিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। তার সংপর্শে আসা যে কোন প্রতিবন্ধী বা অ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন তার পরোপকারী, বিনয়-নম্র, শান্ত স্বভাবের কথা। আমৃত্যু প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া এই মানুষটি সম্বন্ধে আজও বাংলাদেশের সবার ধারণা ইতিবাচক। যে কোন পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে কথা বলেছেন। কারো বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে এগিয়ে গেছেন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে হলেও।
১৯৮২ সালে আর্টিওভেনাস ম্যালফরমেশেন (Arteriovenus Malformation) নামে মেরুদন্ডের একটি দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তরুণ বয়সেই প্রতিবন্ধিতার শিকার হবার পরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন সব কিছু থেকে। সিআরপি (সেন্টার ফর দ্যা রিহেবিলিটেশেন অব দ্যা প্যারালাইজড) এ সিস্টার ভ্যালেরি টেইলরের অনুপ্রেরণায় তৎকালীন অক্সফাম বিল্ডিং এর সিআরপিতে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। এরপরে আর থেমে থাকে নি তাঁর পথচলা।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০০০ পর্যন্ত তিনি ভলান্টারি হেলথ সার্ভিসেস সোসাইটি (VHSS) নামক হেলথ নেটওয়ার্কিং অর্গানাইজেশেন দীর্ঘ ৭ বছর কাজ করেন এবং একই সাথে তিনি ম্যানেজমেন্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশেন করেন। এরপরে ২০০১ – ২০০৩ বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতিতে সহকারী পরিচালক এবং প্রতিবন্ধী উন্নয়ন প্রকল্পের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। এই অফিসটি শাহবাগ থেকে দূরে চলে গেলে তিনি ফ্রীল্যান্স ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ভিএইচএসএস এ থাকা কালীন তিনি একটি রিসোর্স নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। প্রতিবন্ধী মানুষ এবং প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে যে সব প্রশিক্ষক, থেরাপিস্ট ও রিসোর্স পারসনরা আছেন তাদের সাথে অভিভাবকদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তাঁরই উদ্যোগে গঠিত হয় এসোসিয়েশেন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব দ্য ডিজেবেল্ড পিপল (এডব্লিউডিপি)। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ‘স্পন্দন’ নামে একটি ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগও নিয়েছিলেন। যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে নানা খবর, প্রবন্ধ, ফিচারসহ অনেক তথ্যবহুল লেখা প্রকাশিত হতো বলে ম্যাগাজিনটির প্রশাংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এবং তাদের অভিভাবকরা। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ৩টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন তিনি। তার মধ্যে ইউএন এসকাপ কর্তৃক গৃহীত এশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দশক, ২০০৩-২০১২ ‘বিওয়াকো মিলেনিয়াম ফ্রেমওয়ার্ক ফর একশন-এর প্রাথমিক অনুবাদ অন্যতম। এছাড়া তার লেখা প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক অসংখ্য প্রবন্ধ এবং ফিচার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সংগঠন এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করার চেষ্টা করতেন তিনি। সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পূর্বে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য সেখানে কাজ করা শুরুর আগেই জন্ডিস এ আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ তিন মাস ভোগার পর ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ এ পিজি হাসপাতালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ দেশের প্রতিবন্ধী মানুষকে তাঁর আরো অনেক কিছু দেবার ছিল। এ অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যে ক্ষতি হয়েছে তা সত্যিই অপূরণীয়।