মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষেত্রে সিআরপিডি এর ধারা ১৯ – স্বাধীনভাবে বসবাস এবং সমাজে একীভূত হওয়ার অধিকারকে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
ভারতের পুনেতে বাপু ট্রাস্টের উদ্যোগে এবং ওপেন ট্রাস্টের সহযোগিতায় ট্রান্সফর্মিনং কমিউনিটি ফর ইনক্লুশেন উইথ সাইকোসোশাল ডিজেবিলিটি বিষয়ক, ৩০ এপ্রিল ২০১৩ থেকে ৪ মে ২০১৩, ৫ দিন ব্যাপী ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়েছিল। এশিয়া মহাদেশ থেকে নেপাল, চীন, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ, ভারত এতে অংশ নেয়। কোন কোন দেশের একাধিক সংগঠন এবং মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন তারাও ছিলেন। ক্রস ডিজেবিলিটি এর পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে আমার এই প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার কিছুটা আপনাদেও সকলের সাথে ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করছি।
ওয়ার্কশপের লক্ষ্য ছিলঃ
১। আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম প্রদানের মাধ্যমে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পক্ষে এ্যাডভোকেসি করতে সাধারণ লক্ষ্য ঠিক করা।
২। কর্মশালা এবং গবেষণার মাধ্যমে আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক স¤পর্কের মাঝে সম্মান বজায় রেখে এই অঞ্চলের মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজে অন্তর্ভ’ক্ত করতে এ্যাডভোকেসি কর্মের জন্য কৌশল পত্র তৈরি।
৩। ধারা ১৯ ( অন্যান্য সম্পর্কিত সিআরপিডি ধারাসহ) অনুযায়ী এই অঞ্চলের মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজে অন্তর্ভ’ক্ত করতে এর সাথে স¤পর্কিত শিক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে একটি সাধারণ দৃষ্টি গড়ে তোলা।
বলা হয়ে থাকে, অন্যের জন্য যা অবিচার, এদের জন্য তা-ই বিধান। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে আটকে রাখা, বেধে রাখা, ইলেক্ট্রিক শক দেয়া ইত্যাদি অন্যের ক্ষেত্রে অবিচার হলেও পারিবারিক শান্তি রক্ষায় এবং চিকিৎসার নামে এ সকল কিছুই প্রয়োগ করা একজন মানসিক সমস্যাজনিত ব্যক্তির জন্য বিধান। একজন মানসিক সমস্যাজনিত ব্যক্তির স্বাধীনতাকে এমনই বিভিন্নভাবে হরন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ওয়ার্কশপে ফিনল্যান্ডের একটি প্রোগ্রাম দেখানো হলো যার নাম ওপেন ডায়ালগ, যেখানে কোন রকম মেডিকেশেন (ঔষধ) ছাড়া শুধু মাত্র পরামর্শ এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয় এবং তাদের সাফল্যের হার শতকরা ৮৫ ভাগ। কিন্তু সেই পদ্ধতিকে সহজে সবার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে কিভাবে?
পক্ষান্তরে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অভিভাবক এবং অনেক সময় ব্যক্তি নিজেও ঔষধভিত্তিক চিকিৎসার পক্ষে কথা বলছেন। তাই যারা এই বিষয়ে এ্যাডভোকেসি করছেন তাদের জন্য একদিকে যেমন প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে আবার অন্যদিকে যাদের জন্য বলা হচ্ছে তারাই হয়তো এর বিরোধিতা করছেন। এছাড়াও প্রকাশ্যে এসে কথা বলার মত মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমস্যা যেমন আছে তেমনই আছে সংখ্যার আধিক্য। সামাজিক বৈষম্যের শিকার হবেন বলে তারা নিজেদের প্রকাশ করতে পারেন না। কেন চিকিৎসা কেন্দ্রকেই বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত পরিবার বা অভিভাবকগণ? কারণ এটাই সামনে তুলে ধরা হয়েছে এবং এর বিকল্প তেমন উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা নেই।
মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি পারিবারিক সহযোগিতা পান না। ফলে তার সমস্যার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে সেটা গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়। তখন পরিবার বাধ্য হয়ে এবং রেহাই পেতে এদেরকে চিকিৎসা কেন্দ্রে দিয়ে আসেন। পাবনা মানসিক হাসপাতালে এমন অনেক ব্যক্তিকে পাওয়া যাবে যারা সুস্থ হওয়ার পরও তাদের পরিবার তাদেরকে ফেরত নিতে আসেন নি। কারণ কুসংস্কার, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি মানেই পাগল আর একবার যার নামের সাথে পাগল শব্দটি যুক্ত হয়েছে তার আর রেহাই নেই, পাগল মানেই হিংস্র, তাই পাগলের সাথে কি করে বসবাস করা যায়? যে কোন অসুখে আমরা চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য ছুটে যাই কিন্তু মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে চাই না সামাজিক বদনামের ভয়ে। অথচ প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন মানসিক সমস্যা রয়েছে। কারোটা আয়ত্তে থাকে কারোটা তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আর তখনই প্রয়োজন হয় একজন মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নেয়ার। প্রাথমিক অবস্থায় এই কাজটি করা গেলে অনেকেই অবস্থা গুরুতর পরিস্থিতির দিকে চলে যাওয়াকে রোধ করতে পারেন।
বাপু ট্রাস্টের পক্ষ থেকে কিছু বস্তি এলাকায় কাজ করা হচ্ছে। যেখানে তারা পথ নাটক, ড্রাম সার্কেল ইত্যাদির মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন বস্তিবাসীর। নিয়মিত তাদের সাথে মিটিং করছেন এবং সেখান থেকে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরামর্শের মাধ্যমে বড় ধরনের মানসিক সংকটের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে এবং মানসিক সংকটে পতিত ব্যক্তিকে পরামর্শের মাধ্যমে রক্ষা করছেন, কাজ করছেন মানসিক প্রতিবন্ধিতা রোধে। এর জন্য তাদের রয়েছে সাইকোলজিস্ট, এলাকার বিভিন্ন কমিনিটি হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ, মিউনিসিপ্যালিটি, পুলিশ ইত্যাকার নানা ধরনের সংস্থা । আক্রা›ত ব্যক্তির ফলোয়াপ করা হচ্ছে প্রতি মাসে একবার করে । যা কাজে লাগছে রিসার্চে। তবে এর জন্য তাদের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দেয়া লোক রয়েছে। রয়েছে পিয়ার গ্র“প, যেখানে যে কেউ অংশ নিতে পারে।
ওয়ার্কশপে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি দেখা দেয় তা হলো কি হবে সেই কর্ম পদ্ধতি যেই পদ্ধতিতে এই এশিয়া অঞ্চলের সবাই একই মাধ্যমে কাজ করবে? কারণ বাপু ট্রাস্টের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, একটি বস্তি এলাকার কর্ম পদ্ধতি অন্য এলাকায় প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। তাহলে এক দেশ থেকে আর দেশ কিভাবে একই পদ্ধতিতে কাজ করবে? কমিউনিটি বেসড কর্ম পদ্ধতির কথা বলা হলেও সেটার সাফল্যের ডাটা প্রয়োজন এবং এমন একটা বিকল্প পদ্ধতির প্রয়োজন যেই পদ্ধতিতে সবাই কাজ করবেন।
তাহলে কি হবে সেই বিকল্প পদ্ধতি যেই নিয়মে কাজ করা হবে। ওয়ার্কশপে আগত মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এবং সেই সাথে ক্রস ডিজেবিলিটি নিয়ে কর্মরত দলনেতারা যেই বিষয়ে সবাই একমত পোষন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
১।সম্মিলিতভাবে ট্রান্সএশিয়ান স্ট্র্যাটেজি গ্রুপ ফর পিপিল উইথ সাইকোসোশাল ডিজেবিলিটি নামে একটি গ্রুপ করা হয়েছে।
২। কর্ম এলাকা হবে এশিয়া।
৩। অনেক নামে সংজ্ঞায়িত করা হলেও এখানে উপস্থিত সকল মানসিক সমস্যাজনিত ব্যক্তি এবং সার্ভাইভার নিজেদের মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি (PPSD) হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে সম্মত হয়েছেন।
৪। এই গ্রু্পের উদ্দেশ্য হবে ব্যাপক কর্মসুচীর মাধ্যমে এই অঞ্চলের মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সমাজে অন্তভূক্ত করার লক্ষ্যে ক) জ্ঞানের ভান্ডার গড়ে তোলা,
খ) নতুন প্রবর্তিত সামাজিক কৌশল এবং দক্ষতার উন্নয়ন করা এবং
গ) পাবলিক পলিসি এ্যাডভোকেসি তৈরি করা।
৫। সিআরপিডি এর সাথে সহমত পোষন করে , এককভাবে মেডিক্যাল চিকিৎসা (পক্ষেও না বিরুদ্ধেও না) এর উপর জোর দেয়া হয় নি। মেডিকাল চিকিৎসাকে অতিক্রম করে তাদের সামাজিক অন্তর্ভ’ক্তি, নিরাপত্তা, আত্নমর্যাদা এবং পূর্ণ মানবাধিকার নিশ্চিত করা, স্বাধীনতা, শিক্ষা, স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার, চাকরি ইত্যাদি প্রাধান্য দিতে হবে। সিআরপিডি দ্বারা প্রণীত প্রত্যেকের মানবাধিকারকে তুলে ধরতে হবে। তাদের মানবাধিকারের বিষয়ের আলোচনায় সকল শিষ্টাচারপূর্ণ এবং রাজনৈতিক অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া হবে, যেহেতু তারা, সংবিধান অনুযায়ী, অক্ষমতার আওতায় থাকার কারণে এই সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুকির মধ্যে আছেন।
৬। এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশে ইতিমধ্যে কিছুটা পছন্দমত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার কাছে থেকে তাদের সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা রয়েছে এবং চিকিৎসা তাদের পছন্দ অনুযায়ি এবং স্বাধীনভাবে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। সরকারের উচিত মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষেত্রের যে বৈচিত্র্যপূর্ণ চাহিদা রয়েছে তা সনাক্ত করা এবং এই স্পেকট্রামে পরিসেবার ব্যবস্থা করা
ক) এশিয়াতে নন মেডিক্যাল পদ্ধতি থাকলেও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠান প্রায়ই ভাল করার নামে এখানে সীমানা নির্ধারণ (gate keeping) করে বাধা সৃষ্টি করে । স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্টানগুলো একটি বিকল্প পদ্ধতি বের করে আনার লক্ষ্যে এই সীমানা অতিক্রম করবেন বলে আশা করা হয়।
খ) একটি নন মেডিক্যাল সাপোর্ট সিস্টেম এবং বিকল্প পদ্ধতির ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা এবং উৎসাহ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা সত্যিকারভাবে তাদের মতামতের পরিচর্চা করতে পারেন।
গ) এককভাবে মেডিক্যাল স্বাস্থ্যসেবা কাটানোর ও বিকল্প ব্যবস্থার জন্য আমাদের যে সকল পরীক্ষিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্নিক পদ্ধতি রয়েছে তার উন্নতি সাধন করা যেতে পারে, যা নির্বাচন ও প্রয়োগ ব্যক্তিগত পছন্দ, প্রকৃত স্বাধীন এবং জ্ঞান সম্মত মতামতের উপর ভিত্তি করে করা যেতে পারে।
৭। এই অঞ্চলে একাধিক দেশ রয়েছে যেখানে আইনের পরিবর্তন এবং সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্রুপের পক্ষ থেকে নতুন এবং পুরাতন, বর্তমান ও সংশোধিত, সকল আইন প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক ও সাধারণ আইন সিআরপিডি এর অনুবর্তী হয়ে করার প্রস্তাব করা হয়।
৮। এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়নের জায়গা থেকে কার্যক্রম এবং লক্ষ্য হবে, এশিয়া অঞ্চলে দাতা সংস্থা, সরকার, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সংস্থা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে PPSDএর উন্নতি ও রক্ষা নিশ্চিত করতে সম্পদ বন্টনের সাম্য এবং ন্যায়সংগত বিতরণ এই স্ট্র্যাটেজি গ্রুপ চিহ্নিত করবে।
৯। নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরিন ভাল সংগঠন এবং যোগাযোগের মাধ্যমে এই গ্রুপকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মোকাবেলা করার জন্য তৈরি হতে হবে।
১০। একটি কৌশল গ্রুপ হিসেবে, মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ব্যক্তিকে বিকল্প সহায়তা ও যতœ দেয়ার ব্যাপারে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ডিজেবিলিটি এ্যালায়েন্স (আইডিএ) এর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রোগ্রাম অফিসার আলেকজান্ডার কোট ওয়ার্কশপটি পরিচালনা করেন, এছাড়াও ছিলেন এ্যাডভোকেসি সেন্টার ইন মেন্টাল হেলথ এর পরিচালক ভারগভি দেবর। পরবর্তীতে যারা ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছিলেন তারা হলেন ডিজেবেল্ড পিপল ইন্টারন্যাশনাল এর প্রেসিডেন্ট জাভেদ আবেদি, ন্যাশনাল ফেডারেশেন অব দ্যা ডিজেবেল্ড – নেপাল এর প্রেসিডেন্ট সুদর্শন সুবেদি প্রমুখ।
ওয়ার্কশপে সর্বজনীন কোন কর্ম পদ্ধতি খুজে পাওয়া যায় নি, কিন্তু যেই গ্রুপটি তৈরি করা হয়েছে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমন একটি বিকল্প পদ্ধতি আমরা অবশ্যই খুজে পাবো যেখানে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মর্যাদার সাথে সমাজে বসবাস করতে পারবেন। সেজন্য বর্তমান প্রজন্মকে সাহসিকতার সাথে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই নিশ্চিত হবে কাম্য ভবিষ্যত।