নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বারংবার ঘোষিত হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এবং প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কর্মরত এনজিও নেতৃবৃন্দের বিরোধীতায় প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠন অনিশ্চয়তার সম্মূখীন।
২০১০ সালে ২ এপ্রিল জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস ও বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও উন্নয়নে স্বতন্ত্র অধিদফতর গঠনের ঘোষণা দেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে প্রতিবন্ধী অধিদফতরে রূপান্তরিত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সাংগঠনিক কাঠামোগত অনুমোদন দেয়। পরবর্তীতে এই অধিদফতর গঠন কার্যক্রম অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মুখ থুবড়ে পড়ে। চলতি বছরে ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী এই অধিদফতর গঠনের পুর্নঅঙ্গীকার ব্যক্ত করার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সচল হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী অধিদফতর গঠন বিষয়টি উল্লেখ করলে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। তবে সম্প্রতি এই ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়। আবারও প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় অধিদফতর গঠনের কার্যক্রম। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কিছু জানতে পারে নি এই প্রতিবেদক।
তবে এ বিষয়ে জানার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি নুসরাত জেবিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি প্রক্রিয়াধীন আছে তবে বিষয়টি সময় সাপেক্ষ।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও বাধাটা কোথায় তা তলিয়ে দেখতে গিয়ে জানা যায়, এই অধিদফতর গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পরিচালনা বোর্ডের এনজিও প্রতিনিধিরা বিরোধীতা করেন। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে প্রতিবন্ধী অধিদফতরে রূপান্তরিত করা হলে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কর্মরত এই এনজিও নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোন অংশগ্রহণ বা বিশেষ অগ্রাধিকার থাকবে না। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে সরকারের উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ না থাকায় সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন দিবস উদযাপনসহ নানা কার্যক্রমে এইসব এনজিও থেকে নানা ধরনের সহায়তা পেয়ে থাকে। ফলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তা তাদের ওপর নির্ভরশীল। এইসব কর্মকর্তাও অধিদফতরের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। এর পাশাপাশি বেসরকারি সদস্য সমন্বয়ে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হলেও জবাবদিহি ও স্বচ্ছ কোন প্রতিষ্ঠান নয়। ফলে নানা ধরণের স্বার্থের বিঘ্নতা থাকায় এই ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জনাব কামরুন্নেছা এই চক্র ভাঙ্গতে উদ্যোগী ছিলেন বলেই তিনি দ্রুত জনপ্রশাসনের অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন।
এদিকে প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে একাধিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দের জানান, জাতিসংঘ নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) বাস্তবায়নে এবং নারী অধিকার ও উন্নয়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন নারী অধিদফতর ও পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) বাস্তবায়নে এবং তাদের অধিকার ও উন্নয়নে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠিত হচ্ছে। সিআরপিডি অনুসমর্থনের পর ভারত সরকার কয়েক বছর আগে প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠন করেছে।
তারা জানান, প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠনের মাধ্যমে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে বাস্তবায়নকারী, তদারকি এবং আন্ত-অধিদফতর সমন্বয়কারী স্বতন্ত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ফলে নারী সংগঠনের মত প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনগুলো তাদের ক্ষমতায়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে সফল হবে। পূর্নাঙ্গ অধিদফতর বাস্তবায়িত হলে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কর্মরত এনজিওসমূহের তুলনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনসমূহ তাদের উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অধিকতর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়বে নামসর্বস্ব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা অধিকার বঞ্চিত এই নাগরিকদের পণ্য বানিয়ে বিদেশী দাতাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। সিআরপিডি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠনে যৌক্তিক হলেও আইএনজিওসমূহ নিরব ভূমিকা পালন করছে। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন এবং তাদের অভিভাবক সংগঠনসমূহ প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠনের জোর দাবী জানিয়ে আসছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সাথে যুক্ত বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, সিআরপিডি ও নতুন আইন বাস্তবায়নে এবং আমাদের ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠনের কোন বিকল্প নেই।
তবে অতি সম্প্রতি প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠন প্রক্রিয়া অগ্রগতি ঘটার পর বেসরকারী সংস্থাসমূহের নেতৃবৃন্দ তাদের পুরানো অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। জানা গেছে, এনজিওগুলো বলছে প্রতিবন্ধী অধিদফতর আলাদাভাবে করা হলে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যেহেতু এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হবে তাই প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশেনকে যেন অধিদপ্তর করা না হয় সে ব্যাপারেও তাদের চলছে জোর তদবির।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের এক চিঠিতে বলা হয়, ফাউন্ডেশনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান, জনবল, অফিস সরঞ্জাম ইত্যাদি নতুন অধিদফতরের সাংগঠনিক কাঠামোতে একীভূত করার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া রূপান্তরিত অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোতে নতুনভাবে ৩৭৩টি পদ সৃষ্টি, ৫টি জিপ ও ১টি মাইক্রোবাস অন্তর্ভুক্ত করা এবং ফাউন্ডেশনের উদ্বৃত্ত জনবলকে অধিদফতরে আত্তীকরণেও সম্মতি দেয় মন্ত্রণালয়। চিঠিতে অর্থ বিভাগের সম্মতি গ্রহণসহ বিধিগত আনুষ্ঠানিকতা পালন, অর্থ বিভাগের তরফ থেকে বেতন স্কেল ভেটিং করানো, প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির অনুমোদনসহ মোট সাতটি শর্ত দেওয়া হয়। এছাড়াও বর্তমান প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রগুলো প্রতিবন্ধী অধিদফতরের জেলা কার্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা রয়েছে।