মুহম্মদ জাফর ইকবাল
এই দেশে এর থেকে অনেক কম জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নিয়ে যদি আমরা অনেক কথা বলি তাহলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অধিকার নিয়ে আমরা কেন কথা বলি না?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যে কিছু কাজ করি সেজন্যে আমাকে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। একবার আমি তাদের অফিসে গিয়েছি, সেখানে প্রায় সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ, তাদের বেশীর ভাগই পুরোপুরি দৃষ্টিহীন। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতে বলতে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ করে কারেন্ট চলে গেল। কারেন্ট চলে গেলে আমরা সব সময়েই আমাদের কাজকর্ম থামিয়ে দিই, কারেন্ট এলে আবার কাজ শুরু করি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিষ্ঠানে আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, তাদের কোনো কাজ বন্ধ করতে হল না, সবাই নিজের মত কাজ করতে লাগল! বিষয়টি অনেক আগেই আমার অনুমান করা উচিৎ ছিল, আমরা যারা চোখ ব্যবহার করে কাজকর্ম করি তারা অন্ধকারে কাজ করতে পারি না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা পারে! এক দিক দিয়ে তারা আমাদের থেকে বেশী পারদর্শী।
আমার অবশ্যি আরো কিছু জানা বাকী ছিল। সাধারণ ডট মেট্রিক্স প্রিন্টার ব্যবহার করে ব্রেইল ছাপানোর জন্য আমি একটা প্রিন্টার তৈরি করেছি সেটা নিয়েও আলোচনা হল। তখন তাদের একজন বলল, “আমাদের এখানে সত্যিকারের ব্রেইল প্রিন্টার আছে, আপনাকে দেখাই।” আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল সেখানে ব্রেইল প্রিন্টারে কাগজ ঢুকিয়ে ব্রেইল ছাপা হচ্ছে এবং সারা পৃথিবীর সকল প্রিন্টারে যা হয় এখানেও তাই হল, প্রিন্টারের ভিতরে কোথাও কাগজ আটকে গেল। আমি ধরেই নিলাম দেখানোটা আজকের মতো এখানেই শেষ।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ব্রেইল প্রিন্টার দেখানো সেখানেই শেষ হল না। পুরোপুরি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলেটি একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে প্রিন্টার খুলতে শুরু করল, কিছুক্ষণেই প্রিন্টার খুলে গেল, যন্ত্রপাতি আলাদা হল এবং ছেলেটি প্রিন্টারে আটকে থাকা কাগজ খুলে আবার প্রিন্টার জুড়ে ফেলল। (আমি যখন কোনো যন্ত্র খুলে সেটা আবার লাগানোর চেষ্টা করি তখন কীভাবে কীভাবে জানি সব সময়ই আবিষ্কার করি একটা দুইটা স্ক্রু বেশী রয়ে গেছে- কিন্তু এখানে কোনো বাড়তি স্ক্রু আবিষ্কৃত হল না!) প্রিন্টার জুড়ে দিয়ে আবার কম্পিউটারের সাথে লাগানো হল এবং কম্পিউটারে একটা ফাইল বের করে সে আমাকে প্রিন্ট করে দেখাল। আমি ব্রেইল প্রিন্টার দেখে যতটুকু মুগ্ধ হয়েছি তার থেকে বেশী মুগ্ধ হলাম এই ছেলেটিকে দেখে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ তারা সব কাজ করতে পারবে না, কিছু কিছু কাজ শুধু মাত্র যারা দেখতে পায় তারা করবে। আমার ভুল ভাঙ্গল, কে কি কাজ করতে পারবে তার কোনো সীমা রেখা কেউ টানতে পারবে না। যাদের আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভেবে এসেছি তারা মোটেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নয়, দৃষ্টি ছাড়াই তারা আমাদের মত কাজ করে এসেছে। সবাই হয়তো পারবে না, কিন্তু এই ছেলেটি যেহেতু পারে তাই এটা নিশ্চয়ই সম্ভব, ঠিকভাবে সুযোগ দেয়া হলে আরো অনেকেই অনেক কিছু করতে পারবে। প্রতিবন্ধী শব্দটিই আসলে নতুন করে ব্যাখ্যা করা দরকার। আসলে একদিকে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদিকে সেটি তারা পূরণ করে নিতে পারবে- আমাদের শুধুমাত্র সে সুযোগটি করে দিতে হবে।
এটি যে আমার দেখা একটি মাত্র ঘটনা তা মোটেও নয়। বেশ কয়েক বছর আগে আমাকে একটা মেয়ে ফোন করেছিল কোন একটা কাজে। মেয়েটির কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম সে শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাকে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। আমাকে কেন ফোন করেছিল এখন আর মনে নেই। কোন একটা কাজে আমি সম্ভবত আমার মত করে সাহায্য করেছিলাম। মেয়েটি ব্লগে খুব লেখালেখি করে প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার নিয়ে নিজে নিজে রীতিমত একটা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। (তার নাম বা তার তৈরি প্রতিষ্ঠানের নাম বললে অনেকেই তাকে চিনে যাবে- ইচ্ছে করে তাই নামটা বলছি না!) এক সময় তার সাথে আমার দেখা হল এবং তখন আমি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম তার যে এতো বড় সংগঠন এতো চমৎকার আন্দোলন, সমাজের জন্যে এতো বড় অবদান সব সে করেছে শুধুমাত্র একটি আঙ্গুল দিয়ে। সারা শরীরে শুধু এই আঙ্গুলটি দিয়ে সে কোন কিছু স্পর্শ করতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি এই মেয়েটিকে দেখে আমার নিজেকে পুরোপুরি অবাঞ্চিতকর মনে হয়েছে। শুধু মাত্র একটা সচল আক্সগুল দিয়ে যদি একজন এতো কিছু করতে পারে তাহলে আমরা আমাদের সারা শরীর, হাত পা মাথা ঘাড় বুক পেট সবকিছু নিয়ে কেন কিছু করতে পারি না? শুধু যে করতে পারি না তা নয় আমরা কেন সারাক্ষণ জগৎ সংসার দেশ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে অভিযোগ করে যাই?
বেশ কিছুদিন আগে আরো একটি টেলিফোন পেয়েছিলাম, টেলিফোনে যে আমার সাথে কথা বলছে সেও একটি মেয়ে, বয়স বেশী নয় গলার স্বর খানিকটা যান্ত্রিক এবং আমার পক্ষে বোঝা একটু কঠিন। তখন মেয়েটি মোবাইলে এস.এম.এস করে জানাল সে হুইলচেয়ার নয় একটা বিছানায় আবদ্ধ, পুরোপুরি সুস্থ সবল সেই মেয়েটি একশ ধরনের কাজ করে বেড়াতো, কোন এক গণিত অলিম্পিয়াডে আমার সাথে দেখাও হয়েছিল, স্কুলের চারতলা থেকে পড়ে গিয়ে সে মৃত্যু থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু এখন তাকে নিঃশ্বাসও নিতে হয় যন্ত্র দিয়ে। মেয়েটি মাত্র একটি আক্সগুল ব্যবহার করে কবিতা লিখে আমাকে পাঠাত, সে নাকি ছবিও আঁকতো। আমি সবসময় ভাবতাম তাকে কেমন করে সাহায্য করা যায় কিন্তু তার আগেই মেয়েটির একটি বান্ধবী আমাকে জানাল সে আর বেঁচে নেই। শুনে আমার বুকটি ভেঙ্গে গিয়েছিল।
পৃথিবীর শতকরা পনেরো ভাগ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে প্রতিবন্ধী। বেশীর ভাগই নাকি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায় না, জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে রোগ শোকে যুদ্ধ বিগ্রহ দুর্ঘটনায় প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হয়ে যায়। আমরা কোন একটা কারণে ধরেই নিয়েছি প্রতিবন্ধী মানুষেরা বুঝি সমাজের বোঝা কিন্তু কথাটি মোটেও সত্যি নয়। তাদের জন্যে অল্প একটু সুযোগ করে দিলেই তারা কিন্তু তাদের যেটুকু ক্ষমতা সেটা দিয়ে অনেক কিছু দিতে পারবে। বেশী কিছু নয়- শুধু অল্প একটু সুযোগ।
আমাদের দেশে মাত্র সেই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের প্রায় কেউই জানি না যে আমাদের দেশে আইন করা হয়েছে এখানে প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ে হুইলচেয়ার ওঠার ব্যবস্থা থাকতে হবে, বাথরুমগুলোতে যেন হুইলচেয়ার নিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষেরা যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একটা বিল্ডিং তৈরি করতে যত খরচ হয় তার তুলনায় এই ব্যবস্থাটুকু করে দেয়ার খরচ বলতে গেলে কিছুই নয় তারপরও আমরা দেখি বেশীর ভাগ বিল্ডিংয়ে সেই প্রবেশগম্যতাটুকু নেই।
যে সব দেশ প্রতিবন্ধী বান্ধব সেখানে গেলে এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়ে দেখা যায় যে সেখানে সকল মানুষের যাওয়ার সমান অধিকার। বাস ট্রেনে হুইলচেয়ার নিয়ে ওঠার ব্যবস্থা আছে, সেখানে হুইলচেয়ার নিয়ে বসার ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ে হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়ার মতো বাথরুম আছে। পার্কিং লটে তাদের গাড়ী পার্ক করার আলাদা ব্যবস্থা আছে। একজন মানুষ তার বাসা থেকে হুইলচেয়ার নিয়ে বের হয়ে সারাদিন সারা শহর নিজে নিজে চষে বেরিয়ে আবার তার বাসায় ফিরে আসতে পারবে।
আমি নিশ্চিতভাবে জানি একটা শহর বা দেশে সবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে মোটেও খুব বেশী টাকা পয়সা খরচ করতে হয় না। দরকার শুধুমাত্র ইচ্ছেটুকুর! আর সবচেয়ে বড় কথা সেই ক্ষুদ্র টাকা পয়সা খরচ করে আমরা যদি সেই প্রবেশগম্যতাটুকু নিশ্চিত করতে পারি তাহলে তার প্রতিদানে আমরা যেটুকু পাব তার মূল্য সেই অর্থের পরিমাণ থেকে শত গুণ বেশী।
এটি একটি কঠিন যাত্রা। আমি জানি এই যাত্রাটুকু যদি শুরু করতে পারি তাহলে আমরা একদিন গন্তব্যে পৌছাব। কিন্তু যাত্রাটুকু যদি শুরুই না করি তাহলে গন্তব্যে কোনোদিন পৌছাতে পারব না। এই মুহূর্তে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্যে সুযোগ সুবিধার দাবী তোলার পুরোটুকু করছে প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেরাই। আমরা এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে শুধু সেটা দেখছি- নিজেরা কিছু করছি না।
আমার মনে হয় ব্যাপারটা মোটেও সেরকম হওয়া উচিৎ না, সমস্যাটা একটি মানবিক সমস্যা। এই দেশে এর থেকে অনেক কম জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নিয়ে যদি আমরা অনেক কথা বলি তাহলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অধিকার নিয়ে আমরা কেন কথা বলি না?
আমার মনে হয় সেই সময় চলে এসেছে।