সাবরিনা সুলতানা
সায়েম এবং সায়মা জমজ দু’ভাই বোন। প্রকৃতির অদ্ভুদ খেয়ালের বশে দু’জনেই ছোটবেলা থেকে দূরারোগ্য এক ব্যাধিতে আক্রান্ত। হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা দুঃসাধ্য। পড়ালেখাও বেশি দূর এগোয়নি। শিক্ষক যদি স্কুলে যেতে মানা করেন বাবা মা আর কি করেন!! ঘরে বসে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা কোনমতে দেওয়া হলো। তারপর! বাংলাদেশের আরো অনেকের মতোনই যাতায়াত ব্যবস্থা ও সর্বক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতার অভাবে তাদের জীবনটাও আটকে গেলো চারদেয়ালের আবদ্ধ ঘরে।
স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ বড় দু’সন্তান। তাদের চোখের সামনেই বাবা মায়ের সার্বক্ষনিক কড়া নজরে বেড়ে উঠছে পাঁচ বছরের ছোট বোন সেলিনা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চতুর্থ বর্ষে পড়ছে এখন সে। বাবা মায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এখন তাদের ছোট মেয়েকে ঘিরেই। এছাড়া আর উপায়ও বা কি, অন্য দু’সন্তান তো অকর্মার বোঝা হয়ে পড়ে আছে ঘরে। তাই বুঝি ছোট বোন সেলিনার বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়াতে সব দোষ এসে পড়লো বড় ভাই বোনের কাঁধে।
ঠিক এই ভয়টাই সায়েমের ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো, যেদিন বোনকে আংটি পড়াতে এসে পাত্র পক্ষের এক সদস্যের চোখে পড়ে যায় তারা। মা পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, খবরদার! তোরা দু’জন রুম থেকে বেরুবি না। কিন্তু তারা কি করবে। বাতাসে পর্দা কেঁপে গেলো। আর করিডোরের বেসিনে হাত ধুতে এসে পাত্রের বড় বোনের চোখে পড়ে গেলো হুইলচেয়ারে বসে থাকা সায়মা। এরপরে এক ঝাক প্রশ্নের মুখে বিব্রত বাবা মা। হুইলচেয়ার কেনো, কি তাদের সমস্যা, বংশে আর কার কার আছে ইত্যাদি নানান জিজ্ঞাসা। পাত্রী তাদের পছন্দই ছিলো। কথা পাকা করে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেদিন তারা কিছুই জানালেন না। এরপর থেকে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন কেনো যেনো। বাবার ধারণা হুইলচেয়ারে তাদের দেখেই। এমন ঘরের মেয়েকে নিজের ঘরের পুত্রবধূ করে কিভাবেই বা নেবেন!
সুপ্রিয় পাঠক, গল্প মনে হলেও এটি সত্য ঘটনা। এদেশে প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে লুকোছাপার বিষয়টি শুধুমাত্র নিম্নবিত্তের চেয়ে বেশী মাতামাতি আমাদের আভিজাত্যের অহমিকায় ঘেরা দালান-কোঠাগুলোয়। শুধু মাত্র ধারণার বশঃবর্তী হয়ে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরানার অভিভাবকেরা নিজের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখিন সন্তানকে বিনা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন। অনেক সময় সমাজের অসচেতন মানুষেরা এই দায় চাপিয়ে দেন বলে বাবা মাও বাধ্য হয়ে সরাসরি অভিসম্পাত দিয়ে পড়েন আপন সন্তানকে। কটু কথা শোনাতেও করেন না এতটুকু দ্বিধা।
বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিচ্ছে ছোট এই ঘটনাটি। অনিচ্ছেকৃত এই শারীরক সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধিতা কি তাদের অপরাধ! প্রতিবন্ধিতার সম্মুখিন যারা তারা কি সত্যিই চাইতে পারে তাদের আদরের ভাই বোনের সামান্যতম ক্ষতি? শারীরিক বা নানা কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বাবা মায়ের কিংবা সমাজের বোঝা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের এই বোঝা হয়ে উঠার পেছনে আসলে কারা দায়ী? বাবা মা তাদের অ-প্রতিবন্ধী সন্তানকে যদি শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে চান, তাহলে প্রতিবন্ধী সন্তানদের জন্যে কেনো ভিন্ন ভাবনা? কেনোই বা তাদের ঘরের কোনে বন্দী করে অপয়া/বোঝা আখ্যায়িত করে অপমানিত করা !??
একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলেই উত্তরগুলো পাওয়া যায়। প্রতিবন্ধিতার সম্মুখিন ভাই বোন তাদের অ-প্রতিবন্ধী ভাই বোনের ক্ষতি কোনভাবেই চাইতে পারে না। শারীরিক সীমাবদ্ধতা কিছুতেই তাদের অক্ষমতা হতে পারে না। এই সীমাবদ্ধতা নিয়েও সক্ষমতার বহু উদাহরণ আছে ভিনদেশে এমনকি নিজ দেশেও। বরঞ্চ বুঝতে হবে সামাজিক নানান প্রতিবন্ধকতাই তাদের সক্ষমতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবন্ধী মানুষের সহায়ক ব্যবস্থাগুলোর অভাব এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন অসচেতন সমাজ ব্যবস্থাই তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সমাজের মূলধারা থেকে। অভিভাবকেরাই যদি নিজের সন্তানের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হন, অসচেতন এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কখনোই সম্ভব নয়।
আপনার বাধাগুলো কিসে? সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব? সিঁড়ি দিয়ে উঠানো নামানো সমস্যা? লোকে ভীড় করে, তাকিয়ে থাকে, বিব্রত করে??
আপনি এসব ঠুনকো বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন নাকি সন্তানের ‘সুদৃঢ়-স্বপ্নালু ভবিষৎ’ তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। আজ কষ্ট করে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসুন আপনি। দুদিন পর সমাজ তথা রাষ্ট্র বাধ্য হবে আপনার চলার পথ সহজ করে দিতে। যখন এদেশের পরিবার/অভিভাবকেরা অ-প্রতিবন্ধী সন্তানের পাশাপাশি তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানকেও সমান মর্যাদা দিয়ে একিসাথে শিক্ষা, বিনোদনের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন, সমাজের চোখ আপনাতেই জেগে উঠবে। ভুলে যাবেন না, আপনার সন্তানের আত্মসম্মানবোধ অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব আপনার হাতেই!