শামীম আহমেদ
বাঙালি মুসলমান এর সাথে শুক্রবারের জুম্মার নামাযের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। ঈদের দিন নামায না পড়লে যেমন তাদের ঈদ এর পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়, তেমনি শুক্রবারের জুম্মার নামায না পড়লেও বোধহয় পরের এক সপ্তাহ তীব্র অপরাধবোধে কাটে। আমি থাকি নিকেতন। নিকেতনের ইটপাথরের সাথে আমার পরিচয় ২০০৬ থেকে। প্রতি শুক্রবার নিকেতন মসজিদে যাই, যাওয়ার পথে ৪ নম্বর রোডের দু’পাশে ভিক্ষুকরা বসে থাকে। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো চোখ নেই! কেউবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাকিরা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।
২০০৬ সালেরও বেশ ক’বছর আগে বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে আমরা থাকতাম ইস্কাটন গার্ডেন সরকারী কর্মকর্তাদের বাসভবনে। ইস্কাটনে একটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল আছে। সেই স্কুলের সামনে অনেক গাড়ি থাকতো। অনেক বাবা-মা, শিশুরা গাড়ি করে সেখানে আসতেন, বাচ্চাদের বিশেষ ক্লাস হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো – আমি ইউনিভার্সিটিতে, অফিসে যাওয়া আসার পথে দেখতাম।
একদম ছোটকালে আমার আত্মীয়দের মধ্যে একজন ছিলেন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তাকে আমার মামারা ‘পাগলা’ বলে ডাকতেন, আদর করেই হয়তো! তাকে কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছি, আমার আত্মীয়দের মধ্যে তাঁর মতো ভালো মনের মানুষ কমই আছেন। আমার আরেক সহকর্মী ছিলেন যার হাতের কব্জি পর্যন্ত নেই, ছেলেটির বাবা বাংলাদেশের অন্যতম নামকরা উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষ কর্ণধার, ছেলেটিও ভাগ্যবান, সুযোগ পেয়েছে বিদেশ থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে খুব ভালো চাকরি করবার। তার অধিকারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা কিনা খুব কম মানুষেরই হয়।
উপরের কয়েকটা ঘটনায় প্রতিবন্ধিতার সাথে আমার সংশ্লিষ্টতার কথা খানিকটা বললাম। নিকেতনের মসজিদে যাবার পথে একটা ছেলের সাথে প্রতি শুক্রবার আমার দেখা হতো। তার দু’পা অত্যন্ত সরু, চলা-ফেরা করতে পারেনা। আমি যাওয়া আসার পথে শুধু ওই ছেলেটিকেই কিছুটা আর্থিক সহযোগিতা করতাম। একদিন যাবার পথে আমি ওকে বললাম, ‘তুমি কি সারাজীবন ভিক্ষাই করবে? আর কিছু করবেনা?’ সে খুব করুণ মুখ করে বলেছিলো, “ভাইয়া আমি ভিক্ষা করতে চাইনা, আপনাকে কিছুদিন ধরে খুঁজছিলাম, একটা ছোটখাটো দোকান নিতে চাই মোবাইলের, আপনার সাহায্য দরকার।” আমি ওকে তৎক্ষণাৎ আমার বাসায় আসতে বললাম নামাযের পর।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিবন্ধিতার সাথে আমার পরিচয় এর বাইরে একটা বড় প্রফেশনাল সম্পৃক্ততা তৈরি হয় ২০০৯ সালে। ওয়াটারএইড বাংলাদেশ তাদের ‘অন্তর্ভূক্তি এবং ন্যায্যতাভিত্তিক সাম্যতা’ বিষয়ক মূল আদর্শটাকে আরো দৃঢ়ভাবে তুলে ধরবার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়। আমরা ওয়াটারএইড এর ২৭টি দেশে যাতে প্রতিবন্ধিতাকে অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের প্রোগ্রাম ডিজাইন এবং বাস্তবায়ন করি তার জন্য নির্দেশনামূলক গাইডলাইন তৈরি করি, ওয়াটারএইড এবং এর উন্নয়ন সহযোগী প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান এর কর্মকর্তাদেরও এই বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। আমরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থার সাথে একযোগে কাজ করা শুরু করি যাতে করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক অধিকার সুনিশ্চিত হয়, বিশেষ করে তাদের নিরাপদে পানি, পয়ঃনিস্কাশন এবং স্বাস্থ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা না আসে। ওয়াটারএইড এর সমস্ত প্রকল্প এমনকি আমাদের সাথে একসাথে কাজ করা অন্যান্য সংস্থাগুলোও এখন তাদের বিভিন্ন কার্যকর্মে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থাটি করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকেন। আমরা সরকারকেও নানা সময় তাদের বিভিন্ন পলিসি নির্ধারণে প্রতিবন্ধীবান্ধব হতে সাহায্য করেছি। প্রায় ৪ বছরের প্রচেষ্টায় ওয়াটারএইড এর প্রতিবন্ধীবান্ধব পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যাভ্যাসের জন্য হাতে নেয়া কার্যক্রমসমূহ শুধুমাত্র দেশেই প্রশংসিত হয়নি, এমনকি সিলেটের চা-বাগানে চা-শ্রমিক, টাঙ্গালের সুইপার কলোনীতে মেথরদের জন্য কিংবা বান্দরবান এর দূর্গম এলাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এবং তাদেরই নির্দেশনায় তৈরি বিভিন্ন প্রযুক্তি আমাদেরকে আন্তর্জাতিক সুনাম এবং পুরষ্কার এনে দিয়েছে। আমরা জাতিসংঘের বিভিন্ন ঘোষনায়ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষার ব্যাপারটা তুলে ধরতে পেরেছি সার্থকতার সাথে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় আমাদের চলমান সহযোগিতার হাত অব্যাহত থাকবে সামনের দিনগুলিতেও। আজকে যখন শুক্রবারে জুম্মার নামায পড়তে নিকেতন মসজিদে যাই, তখন দেখি অনেকগুলো হুইলচেয়ার। তিন বছর আগেও এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে দেখিনি। সেই যে প্রতিবন্ধী ছেলেটি মোবাইল দোকান করতে সহযোগিতার জন্য আমার বাসায় এসেছিল, সে এখন আর ভিক্ষা করেনা, জুম্মার নামাজ পড়ার সময় এখন আর তাকে দেখিনা। তাতে আমার কোন দুঃখ হয়না। ভালোই লাগে। আমি আশাবাদী মানুষ, আমার খুব ইচ্ছা প্রতিবন্ধী সকল ব্যক্তি আমার সেই সহকর্মীর মতোই সুযোগ সুবিধা পেয়ে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় চাকরি করবে, কেউ তারা ভিক্ষা করবেনা এবং আমার প্রৌঢ় বয়সে আমি যখন নামায পড়তে যাবো তখন রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতার জন্য কেউ আমার কাছে ভিক্ষা চাইবেনা। রাষ্ট্র এবং সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত মানুষ হবেন।
আমি ক্ষুদ্র মানুষ, বড় স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করি। আমাদের বড় স্বপ্ন দেখতে যারা সহযোগিতা করে, তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান বি-স্ক্যান কর্তৃক প্রকাশিত ‘অপরাজেয়’ এর ১ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের শুভেচ্ছা জানাই। চলুন সবাই একসাথে স্বপ্ন দেখি।
শামীম আহমেদ,
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ