বাড়ি5th Issue, December 2013নামে কি এসে যায়!

নামে কি এসে যায়!

ড. এবিএম নাসির

 

অপরাজেয়’রই একটি সংখ্যায় ডঃ শুভাগত চোধুরীর লেখা প্রবন্ধে একটি শব্দগুচ্ছ “বিশেষভাবে পারদর্শী” বেশ ভালো লাগলো। ভালো লাগার কারঘ! বহুদিন ধরেই প্রতিবন্ধী শব্দের একটি সুন্দর ও তাৎপযপূর্ণ প্রতিশব্দ খুঁজছিলাম। ডঃ শুভাগত চোধুরীর লেখাটি পড়ে মনে হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যে ভাবে প্রতিনিয়ত প্রতিকুল পরিবেশে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তাদেরকে “বিশেষভাবে পারদর্শী” বললে কি অতিশয়োক্তি হবে?

আমার বৈচিত্রময় বহুমাত্রিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে, কোন মানুষই পরিপূর্ণ সামর্থ্য নিয়ে জন্মায় না। প্রতিটি মানুষই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন ভাবে। কেউ ধর্ম বৈষম্যের শিকার। কেউ আবার শিকার বর্ণবৈষম্যের। নারীরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার। উপজাতীয়রা চাইছেন তাদের আবাসভূমি। এর মাঝেই রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য।

কিন্তু, কিছু মানুষ প্রকৃতির বৈরিতার সম্মুখিন হয়ে প্রতিনিয়ত সামাজিক বৈষম্যের রাহুগ্রস্ত। এই মানুষগুলো মানসিক ও দৈহিকভাবে তথাকথিত অপ্রতিবন্ধী মানুষদের চেয়ে ভিন্ন। প্রাকৃতিক বৈরিতার সম্মুখিন ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এই মানুষগুলোকে অভিহিত করা হয় প্রতিবন্ধী মানুষ সম্বোধনে। যেহেতু Convention on the Rights of Persons with Disabilities (CRPD) অনুযায়ী সারা বিশ্বে Person with Disability সম্বোধন করা হয়ে থাকে, যাকে বাংলা করে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষ/ব্যক্তি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেকে আবার Differently Able People বলেন। তাকে বাংলা করা যায় ‘ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ’। কিন্তু এ নিয়েও রয়েছে নানা দ্বিমত। আমাদের দেশেও অনেকে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ সম্বোধন করতে চান না।

হঠাৎই মনে এলো, সামান্য নাম বা সম্বোধনে বৃথা তর্কে সময় নষ্ট না করে আমাদের তো উচিৎ তাদের অধিকারের নিশ্চিতকরণ। তাদের জীবন যাপনের সহায়ক ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে জানা -বোঝা।

মানসিক, দৈহিক কাঠামোয় আপাতদৃষ্টিতে যারা অনেক বেশী সামর্থবান তাদের চেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে কেন আজও পিছিয়ে আছেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা?

এই পিছিয়ে থাকার কারণ তাদের মানসিক ও দৈহিক সীমাবদ্ধতা নয়। সমাজপতি তথা অপ্রতিবন্ধী মানুষদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা, পূর্বনির্ধারিত মনোচিন্তা এবং তারই উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা অবকাঠামো ও সামাজিক বিভক্তি। যা শুধুমাত্র তথাকথিত সক্ষম মানুষদের কর্মতৎপরতার সহায়ক। যেমন, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এ্যাপার্টমেন্ট, অথবা পাবলিক প্রতিষ্ঠানে তাদের সহায়ক প্রবেশগম্যতা তৈরিতে খুব বেশী জায়গা বা অর্থের প্রয়োজন হওয়ার কথা তো নয়! তা সত্ত্বেও এই সামান্য সুবিধাটুকু সুযোগ করে দেয়ার সমস্যা কোথায়! তার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন, যারা ভবন নির্মাণ করছেন তাদের হয়তো মনেই থাকে না সিঁড়ির পাশে ছোট্ট একটি র‌্যা¤প প্রতি তলায় অন্তত একটি প্রবেশগম্য টয়লেট বা অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থাগুলোর কথা। মানসিক ও শারীরিকভাবে ভিন্ন মানুষদের প্রয়োজনের কথাটা। দেশে প্রবেশগম্যতা আইনও আছে। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেয়া হলেও সংশ্লিষ্টরা তেমন গুরুত্ব দেন না বিষয়টির। হয়তো তারা মনে করেন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। কদাচিৎ, যদি কোন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর সাহয্যের প্রয়োজন হয় তখন না হয় কোন একটা ব্যবস্থা করা যাবে। এরজন্য, নকশা পরিবর্তন ও সামান্য অর্থ খরচ করে নতুন কোন অবকাঠামো স্থাপন করার মানেই হয় না। এতটাই অবজ্ঞা অবহেলা!!

 

ইমারত আইন ভঙ্গের শাস্তি জরিমানা থাকার পরেও দিব্যি তাকে বুড়ো অঙ্গুলী  প্রদর্শন করে চলেছেন ইমারত মালিকগণ। তবু আইন থাকার প্রয়োজন আছে, তাতে করে তার প্রয়োগেরও সুযোগ থাকে। না থাকলে সে সুযোগটাও কিন্তু থাকে না। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ন হলো, সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে সচেতন করে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে প্রভাবিত করা। যা আইনের পরিপূরক হয়ে পরবর্তীতে মানুষকে স্বপ্রনোদিত হয়ে প্রবেশগম্য অবকাঠামো নির্মানে উৎসাহিত করবে বলে আমি মনে করি। সচেতনতা এবং সর্বত্র প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হলে তারাও শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বিনোদন তথা স্বাভাবিক জীবন যাপনের পরিপূর্ণ পরিবেশ পাবে।

বর্তমানে এই প্রতিকূল পরিবেশেও ভিন্নতা নিয়ে মানুষগুলো বেঁচে আছেন, সংগ্রাম করে যাচ্ছেন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। প্রতিবন্ধিতা স্বত্তেও নিজেদের অধিকারের লড়াইয়ে সোচ্চার তারা। সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন সমাজ সচেতনতার জন্যে। দৃঢ় মনোবল দিয়ে সামাজিক কুপোমন্ডুকতাগুলোকে হটিয়ে দিয়ে এগিয়েও চলছেন ধীরে ধীরে।

যেখানে অনুকূল পরিবেশেও সুস্থ জীবনযাপনে একজন তথাকথিত অপ্রতিবন্ধী মানুষ হিমসিম খেয়ে যান, সেখানে প্রতিকূল পরিবেশে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতা নিয়েও যারা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নেয়া আমাদের কর্তব্য। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের সহায়ক ব্যবস্থা সম্বোলিত বাংলাদেশ গড়ে তুলবোই আমরা একদিন।

 

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ক্যারোলিনা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি

এবং বি-স্ক্যান উপদেষ্টা। 

 

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ