পোলিও হলে হাত ও পা অসাড় হয়ে যায় মানুষের। বিশেষ করে শৈশবেই দেখা দেয় রোগটি। বড় হতে হতে ভালোও হয়ে যায় অনেকের। তবে অনেক বছর পর আবার দেখা দিলে একে বলা হয় পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোম।
পোলিও এমন একটি অসুখ, যাতে কিছু স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে হাত ও পায়ে অসাড়তা দেখা দেয়। এই অবস্থায় অন্যান্য স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুর কাজটি হাতে নেয়। এর ফলে বেশ অনেক বছর ভালোই কাটতে পারে। কিন্তু কোন এক সময় অতিরিক্ত চাপ পড়ে যেতে পারে বলেন কোবলেনৎস শহরের পোলিও সেন্টারের ড. আক্সেল রুয়েটৎস। তার ভাষায়, ‘‘নতুন করে আবার অসাড়তা দেখা দেয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে যারা তাদের রোগটিকে অনেকটা আয়ত্তে আনতে পেরেছিলেন, তারা ৩০/৪০ বছর পর হঠাৎ লক্ষ্য করেন অসুখটি আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে, যাকে পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোম বলা হয়।”
দায়ী পোলিও ভাইরাসঃপোলিও ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় অসুখটি। মুখ ও নাকের মাধ্যমে বিস্তৃত হয় এটি। ছোট্ট এক ফোঁটা থুথুই বিস্তার লাভ করার জন্য যথেষ্ট। এছাড়া ছোয়াছুয়ির মাধ্যমেও সংক্রমিত হতে পারে অসুখটি। মুখ থেকে জীবাণুটি অন্ত্রে চলে আসে। পরে রক্তনালীতে ঢোকে। সাধারণত অসাড়তা দেখা দেয় আড়াআড়িভাবে। ডান পা বাম দিকের বাহু অথবা বাম পা ডান বাহু আক্রান্ত হয়।
বিশ্বের অনেক দেশে এখনও পোলিও থাবা বিস্তার করে চলেছে। পোলিও ভাইরাসে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষেরই তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এমনটি হয়ে থাকে। বলা যায় তাদের দেহে পোলিও ভাইরাস প্রতিরোধী শক্তি রয়েছে। তবে এই ভাইরাসেরও আবার নানা প্রকার রয়েছে। যেগুলো শক্তিশালী। তাই পোলিও ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হলো টিকা দেওয়া। ১৯৬০ সালের প্রথম দিক থেকে বাচ্চাদের এই টিকা দেওয়া হচ্ছে। জার্মানি ১৯৯৮ সাল থেকে পোলিও মুক্ত। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পোলিও নির্মূল হয়েছে। তবে বিশ্বের অনেক দেশে এখনও পোলিও থাবা বিস্তার করে চলেছে। যেমন আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে। এর মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের নাম করা যায়।
আবার ফিরে আসে রোগটিঃপোলিওতে আক্রান্তদের মধ্যে যারা আরোগ্য লাভ করেছেন বলে ধরে নিয়েছিলেন, বছরের পর বছর পোলিওর কোনো লক্ষণই যাদের মধ্যে দেখা যায়নি, তাদের অনেকেই হঠাৎ করে পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোমে আক্রান্ত হন। যেমনটি দেখা যায় হান্স ইওয়াখিম ভ্যোবেকিং-এর ক্ষেত্রে। তার বয়স তখন তিন যখন রোগটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ঘটনা এটি, সম্পূর্ণ শরীর আসাড় হয়ে পড়ে তার। এমনকি নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও নিতে হতো যন্ত্রের সাহায্যে। বছর দেড়েক পর আবার কিছুটা সুস্থ বোধ করতে শুরু করেন ইওয়াখিড়। স্কুলে ভর্তি হন। তবে বাচ্চাদের ঠাট্টা বিদ্রুপের শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। ল্যাংড়া, খোঁড়া এসব বলা হতো তাঁর উদ্দেশ্যে।
অতিরিক্ত চাপ অনেকাংশে দায়ীঃআজ এটা জানা গেছে অতিরিক্ত চাপের ফলে পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোম দেখা দেয়। ভুক্তভোগীরা নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যখন কিছুটা সুস্থ বোধ করেন, তখন রোগটি আবার ফিরে আসে। ইওয়াখিমের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হয়েছিল ডান পা। সুস্থ বা পা-টি প্রায় দশ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে অর্থপেডিক জুতা দিয়ে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮০ সালে অপারেশন করে বা পা-টি ছোট করা হর। ‘‘এই প্রথম দোকানে গিয়ে সাধারণ জুতা কেনার সুযোগ হয় আমার। অপূর্ব এক অনুভূতি।” জানান ইওয়াখিম। কয়লা খনির ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে অনেক বছর খনির ভেতরেও কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। হাতুড়ি বাটালি নিয়ে কাজ করতে না হলেও পর্যবেক্ষেণের কাজ করেছেন তিনি। হামাগুড়ি দেওয়া, মই বেয়ে ওঠা নামা করা এসব বাদ যায়। তবে শেষ দিকে কষ্টকর হয়ে ওঠে কাজটি। বেশ কিছুদিন পর রোগটি শনাক্ত করা হয় পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোম। শ্বাসকষ্ট ও ঘুমের অসুবিধা দেখা দেয় তাঁর। প্রায়ই ক্লান্তি ঘিরে আসতো। আজ তিনি বুঝেছেন, কাজের ব্যাপারে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে হুইল চেয়ারে চলাচল করেন এই মানুষটি।
একটি বিরল ব্যাধিঃজার্মানিতে প্রায় ৭০০০০ মানুষ পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোমে আক্রান্ত। সংখ্যাটা তেমন বেশি নয় বলে বিরল অসুখের মধ্যে পড়ে এটি। আর এই কারণে রোগটি নিয়ে গবেষণাও তেমন হচ্ছে না। বিশেষ কোনো বইপত্রও নেই অসুখটি সম্পর্কে। মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নেই কোনো বিশেষ লেকচারের ব্যবস্থা।
২০০১ সালে ড. আক্সেল রুয়েটৎস কোবলেনৎস শহরে পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বহির্বিভাগে চিকিৎসা শুরু করেন। এই ধরনের ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র। গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার ফলে বছরে প্রায় ৫০০ রোগী যাচ্ছেন সেখানে। রোগীরা বিশেষ থেরাপি সম্পর্কে জানতে চান কিংবা জানতে চান শ্বাস নিতে কীভাবে সাহায্য পাওয়া যায়। তবে পোস্ট-পোলিও-সিনড্রোম রোগটিকে বিলম্বিত করে কিংবা থামাতে পারে এমন কোনো ওষুধ এখন পর্যন্ত বের হয়নি।
সূত্রঃ ডয়চে ভেলে।