নিজের দুর্বিষহ জীবনের কথা ঠিক কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। মায়ের কাছে শুনেছি, তিন বছর বয়সে আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেতে থাকে। স্কুলে যাই, খেলাধুলা করি। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাই, তবুও উঠে দাঁড়াই। আবার হাঁটি। কৃষক বাবার পক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন বা আমাকে একটু ভালো জীবন দেয়া ছিল অসম্ভব। তবু নিজেকে প্রতিবন্ধী ভাবিনি। আর সব কিশোরের মতই সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীর শেষ দিকে সম্পূর্ণ চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়লে আমার চারপাশের জগত ছোট হয়ে আসতে থাকে। কিছুদিন রিকশায় স্কুলে গেলাম। বাবার পক্ষে রিকশা ভাড়া দিয়ে পড়ালেখার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ায় সপ্তম শ্রেণীতে উঠে আমার ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
শুরু হয় চারদেয়ালে বন্দী জীবন। বাড়ির পাশেই রাস্তা দিয়ে বন্ধুরা হেঁটে যায় কিন্তু কেউ কখনো জানার চেষ্টা করে নি কেমন আছি, কিভাবে বেঁচে আছি! অথচ যখন হাঁটতে পারতাম সবাই বাড়িতে এসে আড্ডা দিত। বেশি খারাপ লাগত ঈদ বা পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে। একা হয়ে পড়তে লাগলাম ধীরে ধীরে। চারপাশে সবকিছুর উন্নতি হয়, কেবল আমি পিছিয়ে। এতদিনে বুঝেছি, আমাদের নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই আমরা অবহেলিত। নতুবা বাইশ বছরের যুবক হয়েও আমাকে বাড়িতে বন্দী জীবন কাটাতে নিশ্চয় হত না! সহপাঠীরা কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, কেউ চাকরিরত, কেউ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত হবার পথে। তাদের এগিয়ে যাওয়ায় আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমাদের পিছিয়ে রেখে কেন?
কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অধিকার আমারও আছে। হয়তো শরীরে শক্তি কম তাই পরিশ্রমের কাজ পারব না, কিন্তু আমার মেধা কাজে লাগাতে পারব। আমি কম্পিউটারে কাজ শিখতে পারি, কিন্তু সেটি ক্রয়ের সামর্থ্য আমার বাবার নেই। আউটসোর্সিং এর কাজ শেখার খুব ইচ্ছা। এই কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে পাশাপাশি ইজিলোডের দোকান দেয়ারও ইচ্ছা। নিজে প্রতিষ্ঠিত হলে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারব। কিন্তু তেমন সুযোগ পাচ্ছি না। প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কেউ বিনিয়োগও করতে আগ্রহী নয়।
জীবনে যত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি তার মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। এমনও সময় গেছে টাকার জন্য বাবা বাজার করতে পারেনি। বাবা-মার বড় সন্তান হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছি কেবল। আমিও চাই পরিবারের বড় ছেলের দায়িত্ব পালন করতে। ইচ্ছে করে দেশের উন্নয়নে সামান্য হলেও অবদান রাখতে। যে যে ধরনের কাজে পারদর্শী তাকে সেই কাজের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিনা সুদে ঋণ দেয়া উচিত। এ কথা সত্য যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ঋণ দেয়া হয়, কিন্তু কজন তা পায়? আমিতো কোনো রকম সহযোগিতা পাই নি! আমার মত আরো অনেকেই আছেন যারা অধিকার বঞ্চিত। সরকার সহযোগিতা করছে, তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ঋণ দেয়ার পরিধি বাড়িয়ে, ঋণ নেয়ার পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে। এছাড়া সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে কাজ শুরু করতে হবে আমাদের পরিবার ও বিদ্যালয়গুলো থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশগম্য করতে হবে। দেশের সকল স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
সকলে দোয়া করবেন, যেন একটা কাজ পেয়ে যাই। এখনও শেষ হয় নি আমার বাঁচার লড়াই।
মোঃ শাহিনুর ইসলাম,
কালামপুর, ধামরাই, ঢাকা।