খুজিস্তা নুর ই নাহারীন
সময়টা ২০০৫ সালের। জামালপুর থেকে ঢাকা আসার পথে আমাদের গাড়িটি বড় ধরনের দুর্ঘটনায় সম্মুখীন হয়। আর আমি মারাত্মক চোটে জখম হই। সেই সময় কয়েকদিন কালো গ্লাসে চোখ ঢেকে রাখা আর হুইলচেয়ার- নির্ভর দিন আমার জন্য ছিল অসহনীয়। কিন্তু তখনো জানা ছিল না এর চেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দুঃস্বপ্নের চেয়ে নির্মম সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে ২০১১ সালে। আমার অকাল প্রয়াত স্বামী ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এক পর্যায়ে হুইলচেয়ার নির্ভর হয়ে পড়ল। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর কর্মদ্যোগী টগবগে ৪৭ বছর বয়সের একজন মানুষ নিয়তির বিধানে মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে হুইলচেয়ারে বসল। সদা ছুটে চলা তরুণ প্রাণটি হুইলচেয়ারে বসেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। আমার ভিতরে তখনকার অবস্থা বুঝানোর মতো নয়। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে রক্ত ঝরছে। বাইরে নিজেকে শক্ত রেখে তাকে অভয় দিই। পরম ভালোবাসা ও স্নেহে একাত্ম হয়ে বলি, আমি তো আছি। সারাক্ষণ তোমার পাশেই থাকব। কোথাও যেতে হলে নিয়ে যাব। একদন্ডও কাছ ছাড়া করব না। শিশুর মতো যে পুরুষ কাঁদছিল সে কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু তাকে নিয়ে যখনই সামনে পা বাড়ালাম সেই ইতিহাস আরও করুণ। আরও বেশি বেদনার হয়ে দেখা দিল।
চারতলা বাসায় কোনো লিফটের ব্যবস্থা ছিল না। পুরনো বাড়ি, উঁচু উঁচু সিঁড়ি। সব দরজা দিয়ে হুইলচেয়ার ঢুকানো এবং বের করাও কষ্টসাধ্য। বাসায় তড়িঘড়ি করে লিফটের ব্যবস্থা করা হল। কয়েকটি দরজা ভেঙে বড়সড় হল। কিন্তু তারপর? কোথায় নিয়ে যাব তাকে? একমাত্র রমনা পার্ক আর সংসদ ভবন এলাকা? সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, বাসস্থান, বেশির ভাগ জায়গায় হুইলচেয়ার উঠানো বা নামানোর ব্যবস্থা নেই। তার মানেটা কি দাঁড়ায়? হুইলচেয়ার- নির্ভর ব্যক্তিরা অচ্ছুত, তারা এই সমাজের অংশ না? নাকি হুইলচেয়ার- নির্ভরতার অপরাধে তারা তাদের সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছে? এ কেমন জীবন? শুধু শ্বাস নেয়া আর ছাড়াকে কি কেউ জীবন বলে? কেন ওরা আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে না? কোন অভিশাপে? জন্মলগ্ন থেকে না হোক জীবনের যে কোনো পর্যায়ে আমরাও যে কোনো সময় তো হুইলচেয়ার- নির্ভর হতে পারি।
যে কোনো দুর্ঘটনায় চলে যেতে পারে আমাদের হাত-পা অথবা শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তখন কি হবে? এই মুহূর্তে আমাদের অনেকের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব স্ট্রোকের পর পঙ্গু জীবন-যাপন করছে। শুধু ঘর আর বাথরুম। এই তাদের বিচরণক্ষেত্র। আমরা ধরেই নেই, ওদের জীবন শেষ। মরার আগেই ঘোষণা করে দেই মৃত্যুদন্ড । শয্যায় ফেলে রাখি জিন্দা লাশের মতো! দোজখের আগুনে পোড়ার আগেই অভিশাপের আগুনে আমরা পুড়িয়ে মারতে বাধ্য হই আমাদের প্রিয়জনদের। আর আমাদের যাদের পরিবারে শারীরিক অথবা যে কোন ধরণের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন সন্তানের জন্ম হয় সেই পরিবারটি যেন সবার অগোচরে একঘরে হয়ে পড়ে প্রচণ্ড হতাশায়। শোক-বিহ্বলতা অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে, অনেকে পারে না। একটি শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো হয়ে যায় তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরও কয়েকটি জীবন। যে শিশুটির আনন্দের বার্তা নিয়ে আসার কথা ছিল, পরিবারে নতুন স্পন্দন জাগানোর কথা ছিল, সেই শিশুর আগমন তখন গোটা পরিবারটির কাছে অভিশপ্ত মনে হতে থাকে।
শিশু জন্মদানের যে গৌরব, যে আত্মতৃপ্তি, যে আনন্দ সবকিছু হারিয়ে নিজেদের অপরাধী ভাবতে শুরু করে। এ যেন প্রচণ্ড লজ্জার, ঘৃণার, অপারগতার, পরাজয়ের, কষ্টের। যে প্রতিবন্ধী শিশুটি আজ জন্ম নিল তার কি অপরাধ? তার তরুণ প্রাণ বাবা-মার কি অপরাধ? তবে কেন তাদের অলিখিতভাবে মানসিক নিগৃহীত হতে হবে? সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হবে অন্য মানুষের ধ্যান-ধারণাকে নিয়ে । শুধু বাবা-মার অলক্ষ্যে তাদের জিনগত দুর্বলতা অথবা ত্রুটির কারণে এমন শিশুর জন্ম হয়। তাহলে বাবা-মাকে কেন আগে থেকে সচেতন করা হয় না? যখন তারা বাবা-মা হবে তখন, অথবা তারও আগে যখন তারা বিয়ের প্রস্তুতি নেয় তখন থেকে। যদি বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনিটিক্যাল ত্রুটিগুলো আবিষ্কার করা যায় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সমাধান করা যায় সহসাই। কিন্তু বিজ্ঞানের এই যুগেও আমরা নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য ঈশ্বরকে দোষারোপ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হই না। একমাত্র ঈশ্বর যিনি তার ওপর বর্ষিত সব অপবাদ নির্বিবাদে সহ্য করেন। আমরা নিজেরা যে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করি না, তার পথে চলি না, তার ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা রাখি না- এ সবই যেন তার নিজেরই দোষ।
পৃথিবীর সব দেশেই তো এমন প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়, হুইলচেয়ার- নির্ভর করে মানুষ বেঁচে থাকে। ওরা তো এমন বিষণ্ণতায় ভুগে না। জীবনটাকে সহজভাবে নিতে জানে। তাহলে আমাদের দেশে আমরা পারি না কেন? তফাতটা কোথায়? সমস্যটা কি? সমস্যা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের শিক্ষা, আমাদের সচেতনতা। আর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। পশ্চিমাসহ দুনিয়ার দেশে দেশে প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ার- নির্ভর মানুষের জন্য সুযোগ-সুবিধা আরও বেশি বেশি নিশ্চিত করেছে রাষ্ট্র, সমাজ। কত মানবিক! আর আমরা? রাষ্ট্রও নিশ্চিত করে না, সামাজিকভাবেও দায় এড়িয়ে একটি অমানবিক হৃদয় নিয়ে এড়িয়ে চলি! কেন? উন্নত বিশ্বে যখন একটি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয় তখন পরিবারটিকে সাহায্য করার জন্য, তাদের মনে সাহস জোগানোর জন্য পুরো সমাজ সেই সন্তানের, সেই পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমরা কেন পারি না এতটা মানবিক হতে?
আমরা শুধু সমালোচনা করে পরিবারটির কষ্টকে আরও কিছুটা ত্বরান্বিত করি। একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে সাহায্য করা, তাকে পরিপূর্ণ মানুষের জীবন দেয়া একটি পারিবারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তার জন্য দেশ এবং দেশের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে প্রতিটি স্তরে স্তরে। শিশুদের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সরকারের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত। তাদের স্বাভাবিক জীবন দানের পূর্ব শর্ত হচ্ছে সহজ সার্বিক প্রবেশগম্যতা, সেই সঙ্গে টয়লেট। প্রয়োজনীয় শিক্ষা, চিকিৎসা, দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অনুসঙ্গগুলোকে তাদের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, মার্কেট দোকান-পাট, সিনেমা হল, (বিনোদনের) জায়গাগুলোতে র্যম্প নেই বলে ওরা যেতে পারে না। যাও বা আছে প্রয়োজনীয় টয়লেটের অভাব। রাস্তা পারাপারে ট্রাফিক সিগনালে তাদের কোনো অগ্রাধিকার নেই। কিন্তু উন্নত বিশ্বে প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের সব ব্যবস্থা করা আছে। রেল, বাস, অফিস-আদালত প্রতিটি বাসা, সিনেমা হল, ক্যাসিনো, এমিউসমেন্ট পার্ক প্রতিটি জায়গায় ঘুরে ঘুরে আনন্দ পেতে পারে। প্রতিটি জায়গায় শ্রদ্ধা এবং সম্মানের সঙ্গে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তাদের পক্ষে তাদের অধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্র প্রণয়ন করেছে জোরালো আইন। রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা আর সদিচ্ছা ছাড়া তাদের অধিকার সংরক্ষণ, তাদের জন্য স্বাভাবিক জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব নয়। এর মধ্যে আমাদের দেশে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে অল্পবিস্তর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। আমাদের দেশ যেহেতু উন্নয়নশীল একটি দেশ, আমাদের সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসতে হবে ওদের পাশে দাঁড়াতে। ওদের জন্য তো অবশ্যই কিন্তু কে জানে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের নিজেদেরই কাজে আসবে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমার স্বামীকে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। হয়তো আর কয়েক বছর পর আমাকেও যেতে হবে। কিন্তু তাই বলে পৃথিবী থেমে থাকবে না। পৃথিবী এবং মানুষেরা তাদের আপন গতিতেই ছুটে চলবে। কিন্তু তবুও একটি সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় দেশকে তথা পুরো পৃথিবীকে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সে ভবিষ্যতে আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবে। সবার থাকবে সমান অধিকার। মুক্তভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, শান্তি, সম্প্রীতি, ভালো লাগা, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হবে সবার জীবন। মনে রাখতে হবে হুইলচেয়ার- নির্ভর ব্যক্তিরাও মানুষ। পরিপূর্ণ বাঁচার জন্য তাদেরও দিতে হবে ন্যায্য অধিকার।
লেখক : পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।