বাড়ি9th Issue, December 2014প্রতিনিধিত্বের দাবীতে দেশ ব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনগুলোর মানববন্ধন

প্রতিনিধিত্বের দাবীতে দেশ ব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনগুলোর মানববন্ধন

মুয়ায বিন জাকারিয়া  

“আমরাই করব আমাদের প্রতিনিধিত্ব, মানবো না আর পরাধিনত্ব”

 

স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণী কমিটিগুলোর সকল পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবিতে রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে মানববন্ধন আয়োজনের উদ্যোগ নেয় “প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ(পিএনএসপি)”।

 


দেশের প্রতিটি এলাকাতেই বিভিন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের সংগঠন, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিভিন্ন পেশাজীবী ও এনজিও প্রতিনিধিগণ এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মানব বন্ধনে অংশ নেন। বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষের ঢল নামে এই আন্দোলনে।

 
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে ডিজেবল্ড পিপলস ইন্টারন্যাশনাল (ডিপিআই) এর সদস্যপদ লাভ করা এই সংস্থাটির উদ্যোগে সারা দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে এই কার্যক্রম শেষ হয় ২১ নভেম্বর, ২০১৪ রাজধানী ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনে। সুনির্দিষ্ট তিন দফা দাবি উত্থাপনকরেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠনগুলো।যা হলঃ

 
১. প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এ উল্লেখিত সকল কমিটিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।  
২. প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়ন, কমিটি ও তাদের অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন নীতি সংশ্লিষ্ট কমিটিসহ সকল স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব বা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নতুন আইনের বিধিতে বেসরকারি সদস্য হিসেবে উল্লেখিত পুরুষ ও নারী প্রতিনিধিদের কোটা প্রতিবন্ধী পুরুষ ও নারীর জন্য সংরক্ষণের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
উল্লেখিত দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব দেয়ার পক্ষে আন্দোলনের সাথে জড়িত টার্নিং পয়েন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জীবন উইলিয়াম গোমেজ বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কেন সব সময় উপকারভোগী হবে? কমিটিতে থাকলে তারা নিজেদের উন্নয়নে নিজেরাই ভালো বুঝে কাজ করতে পারবে, তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে যেটা অ-প্রতিবন্ধী মানুষের পক্ষে করা তো দূরের কথা অনেক সময় বোঝাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কমিটিতে দায়িত্ব দেয়া হলে তাদের নেতৃত্বের বিকাশও ঘটবে।”

 

 


এ বিষয়ে পিএনএসপি এর আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান) এর সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে আইন তৈরি হচ্ছে কিন্তু সেই আইনের আওতায় যে কমিটি হচ্ছে তার একটা দুটো ছাড়া বেশিরভাগই প্রতিবন্ধী মানুষকে প্রতিনিধিত্ব দেয়া হচ্ছে না। নারী অধিকার রক্ষার কমিটিতে নারীদের প্রতিনিধিত্ব না থাকা যেমন সমীচীন নয় তেমনি প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অধিকার রক্ষার্থে গঠিত কমিটিগুলোতে তাদের স্থান না হলে আসলে শেষমেশ প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেরাই কোনভাবেই উপকৃত হবেন না। একদিকে তারা তাদের নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার অর্জন করতে পারছে না। অন্যদিকে অ-প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্বে উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষেরা। তাই তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।” এই আন্দোলনে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কমিটিতে স্থান না দিলে কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে সালমা মাহবুব বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি সরকার অবশ্যই আমাদের কথা রাখবেন, কারণ যার ব্যাথা সেই সবচেয়ে বেশি বোঝেন”।

 
উল্লেখ্য, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠনসমূহের (ডিপিও) সমন্বয়ে পিএনএসপি গঠিত। পলিসি এ্যাডভোকেসি, গবেষণা এবং ডিপিওসমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে সরকারকে কৌশলগত সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে “প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি)।”

 
এদিকে পিএনএসপি-এর এই উদ্যোগ নিয়ে অনেকের মাঝে সংশয় দেখা দিয়েছে। অনেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান, অপরদিকে কেউ কেউ মনে করছেন এই আন্দোলনের ফলে তাদের উপকার না হয়ে ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে কর্মরত চট্টগ্রামের ভাস্কর ভট্টাচার্য অভিযোগের সুরে বলেন, “আসলে মানবন্ধন যারা করছেন (পিএনএসসি) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত পুরনো সংগঠনগুলোকে না জানিয়ে তাদের এসব করা ঠিক হচ্ছে না। এতে করে ব্যক্তি পর্যায়ে তারা লাভবান হলেও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের। তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্বের বিকাশ এমনিতেই হচ্ছে এর জন্য আলাদাভাবে কমিটিতে তাদের স্থান দরকার বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না।”
তাহলে আপনি বলছেন যে এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষতি হতে পারে বলে আপনি এই আন্দোলনের সাথে নেই, এমন প্রশ্নের জবাবে অপরাজেয়কে ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, “ভাল হলে অবশ্যই আমি আছি। কারণ আমি সব সময় চাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপকার হোক।” ভাল হলে আছেন না হলে কি তবে এই আন্দোলনের সাথে একাÍতা পোষণ করেন না, এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দেননি তিনি।

 
ভাস্কর ভট্টাচার্য-এর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন মানববন্ধনের সাথে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, “প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কর্মরত ডিপিও, এনজিওর পাশাপাশি সব ধরণের প্রতিবন্ধী মানুষকেই আগে জানানো হয়েছে এবং পরবর্তীতে মানববন্ধনের আগে আমন্ত্রণও দেয়া হয়েছে। এতসবের পরেও যদি কেউ অভিযোগ করে তাকে ডাকা হয়নি তাহলে আসলে কিছুই বলার থাকে না।”
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব অবশ্যই জরুরী। প্রতিবন্ধিতা আসলে এক ধরনের বৈচিত্রতা, আর বৈচিত্রতা কখনই অস্বাভাবিকতা কিংবা অক্ষমতা হতে পারে না। নিজেদের সক্ষম এবং বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী সব ধরনের অধিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাওনা উল্লেখ করে পিএনএসপি এর সমন্বয়ক ইফতেখার মাহমুদ অপরাজেয়কে বলেন, “সংবিধানে সকল পর্যায়ে সবার সমান অধিকারের কথা বলা আছে সেই হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিনিধিত্বের অধিকার পায়।”

 

 

 


প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার আইন প্রণয়নে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলো সংশ্লিষ্ট থাকলেও আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা তাদের সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার মাহমুদ বলেন, “তার মানে কি আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণকারীরা  প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বের অধিকার চান না?”
প্রতিনিধিত্বের অধিকার বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং করতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোকে কমিটিতে অবশ্যই রাখতে হবে এমন দাবি করে রাজধানীসহ সারাদেশে আয়োজিত এসব মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন পিএনএসপি-এর আহবায়ক সালমা মাহবুব, এসডিএসএল-এর সভাপতি ওসমান খালেদ, বি-স্ক্যান এর সভাপতি সাবরিনা সুলতানা, আরসিডি এর সভাপতি জনাব রাশেদুজ্জামান চৌধুরী, রংপুর বধির সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, জাতীয় প্রতিবন্ধী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাসুম খলিফা, প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি রেজাউল করিম রতন, কল্পনা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি সোহেল রানা, স্পন্দন জেলা প্রতিবন্ধী উন্নায়ন সংস্থার সভাপতি আল আমিন, এসইউসিসি-এর সভাপতি আশিকুর রহমান অমিত, পিএনএসপি সমন্বয়ক জনাব ইফতখার মাহমুদ, উৎস এর নির্বাহী পরিচালক জনাব মোস্তফা কামাল যাত্রা, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন পরিষদ এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব রিয়াজ হায়দার, রাজশাহী অন্ধ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জনাব হাবিবুর রহমান, বিজয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি জনাব শহিদুল ইসলাম, স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরিজস ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশেন (সিডাব) রাজশাহীর জনাব মাসুদুন্নবী মুরাদ।

 
এছাড়াও, বক্তব্য রাখেন রায়গঞ্জ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি হাফেজ রেজাউল করিম, বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মোঃ মহসিন, এসডিএসএল সমন্বয়ক আবু হানিফ মুহাম্মদ ফরহাদ প্রমুখ।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ