প্রধান প্রতিবেদন
প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের এক বছরের বেশি সময় গড়ালেও আজ অবধি আলোর মুখ দেখেনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর। লাল ফিতেয় বাঁধা পড়েছে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত এনজিও নেতাদের এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আমলাদের চাপে স্থবির হয়ে পড়েছে অধিদফতর গঠনের বিগত পাঁচ বছরের কার্যক্রম।
জানা যায়, ২০১০ সালে আগষ্ট মাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশাসনিক কাঠামো সংস্থাপন মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। বিগত ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য জাতীয় দিবস উদযাপন কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের উদ্বোধন করেন। এ সময়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন বিলুপ্তি করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর গঠিত হবে। তবে শুরু থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে আসছে কিছু এনজিও নেতারা এবং সমাজকল্যাণ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন আমলা।
অধিদফতর বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সচিব জনাব তারিক-উল-ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়ে গেছে এবং উক্ত বৈঠকে আমাদের কিছু দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। তবে কী সেই নির্দেশনা বা কবে নাগাদ প্রতিবন্ধী মানুষরা অধিদফতরের দেখা পাবে তা সঠিকভাবে বলতে চাননি তিনি।
এ প্রসঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব নাসরিন আরা সুরাত আমিনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এই প্রতিবেদককে অধিদফতর বিষয়ক কোন ধরনের মন্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, যেহেতু অধিদফতর বিষয়টি সচিব পর্যায়ে রয়েছে তাই এই মূহুর্তে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না।
সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী নুরুল কবির জানান, ফাউন্ডেশনকে আরো বেগবান, শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ করণের ওপর গুরত্ব¡ারোপ করা হয়েছে। যাতে প্রতিবন্ধী মানুষের সেবা সহজীকরণ ও একেবারে তাদের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায়। তিনি এই মূহুর্তে ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে নেই উল্লেখ পূর্বক অধিদফতর প্রসঙ্গে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বিগত অর্থ বছরগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হতে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের নামে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় হতে এমন নির্দেশনাই ছিল যে, দেশব্যাপী এই কেন্দ্র সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের আওতায় আত্তীকরণের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্প্রসারিত হবে। এই কারণেই জেলা পর্যায়ের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে জেলা প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা নামে একটি পদ সৃজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় এবং ইতিমধ্যেই ১০৩ টি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এ সময় ফাউন্ডেশন বিলুপ্তি করেই অধিদফতর গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সরকারি উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে।
এদিকে সম্প্রতি অধিদফতর গঠন বিষয়ে আশ্চর্যজনক বক্তব্য দিয়েছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি প্রাক বাজেট আলোচনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের সাথে অর্থমন্ত্রীর এক বৈঠকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন (ডিপিও) সমূহের নেটওয়ার্ক প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) এর সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব এর অধিদফতর বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত বিস্মিত হয়ে বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আবার আলাদা অধিদফতর!!”
সালমা মাহবুব জানালেন, অর্থমন্ত্রীর কথায় ফুটে উঠেছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অধিদফতর গঠন ঘোষণা এবং মাত্র এক বছর আগেই ২০১৪ সালের অটিজম সচেতনতা দিবসে অধিদফতর উদ্বোধনের বিষয়টি বেমালুম ভুলে গেছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডার প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা জানান, প্রতিবন্ধী জনগণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হওয়ার পরও অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধির নামে অধিদফতর গঠনের বিরোধিতা করছে। এটা নতুন কিছু নয়, নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে একইভাবে যুক্তিহীনভাবে শিশু অধিদফতরেরও বিরোধিতা করছে তারা।
অধিদফতর গঠনের বিষয়কে সামনে রেখে সমাজকল্যাণ ও অর্থ মন্ত্রণালয় ফাউন্ডেশনের লোকবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল এবং অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি ইতোমধ্যে স্থায়ী করা হয়। কিন্তু এখন আবার শোনা যাচ্ছে, সরকারের উচ্চ মহলে ফাউন্ডেশন বিলুপ্তির বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মূলত অধিদফতর গঠনের কোন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ফাউন্ডেশন বিলুপ্তি না হলেও অধিদফতর চালু হতে আরও দীর্ঘ সময় গড়াতে পারে। এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব তারিক-উল-ইসলাম স্বীকার করেন যে, অধিদফতর হবে, তবে কোন কিছুই বিলুপ্ত হবে না। ফাউন্ডেশন ও অধিদফতর আলাদাভাবে থাকবে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি) এর ৮ম অনুসমর্থনকারি দেশ হিসেবে এই সনদের ৩৩ নং ধারা দুই এর আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে বাস্তবায়নকারী, তদারকি এবং আন্ত-অধিদফতর সমন্বয়কারী সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই অধিদফতরটি। সিআরপিডি বাস্তবায়নে একই ধারার আলোকে পাশের দেশ ভারত সরকারও ২০১২ সালের মে মাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিদফতর চালু করেছে।
জানা যায়, বাংলাদেশে অধিদফতর বাস্তবায়নের দাবীতে সম্প্রতি ডিপিও নেটওয়ার্ক প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) এর উদ্যোগে সারা দেশের সকল ডিপিওগুলোর স্বাক্ষর গ্রহণ চলছে। স্বাক্ষর সংগ্রহ শেষে সকল ডিপিও এর সমন্বয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে উক্ত স্মারকলিপিটি শীঘ্রই জমা দেবে পিএনএসপি।
এদিকে এতদিনেও অধিদফতর বাস্তবায়ন না হওয়ায় জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম এর মহাসচিব মিজানুর রহমানের কন্ঠে হতাশার সুর ফুটে উঠে। তিনি অনেকটা নিরাশ কন্ঠেই বলে উঠেন, আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও উদ্বোধনের পরও যদি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিদফতর বাস্তবায়ন না হয় সেক্ষেত্রে আমি আর কি বলব!
এদিকে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সংগঠন অধিদফতর চাইলেও কেউ কেউ এ নিয়ে এখনও কিছুটা দ্বিমত পোষণ করছেন। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সাবেক সভাপতি ও সিএসআইডি এর নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহরুল আলম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, আমি চাই না অধিদফতর হোক। কারণ এতে সরকার এবং বাইরে থেকে আসা সাহায্য, যেমন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমি চাই একীভূত সমাজ হোক, যেখানে সব মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করবে যেমনটি অ-প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য করে।
তিনি প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনেরও প্রয়োজন ছিল না উল্লেখ করে বলেন, অযথা বাসা ভাড়া করে সরকার ফিজিও থেরাপিষ্ট আর কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে (যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নেই) অর্থ অপচয়ের মানেই হয় না। সারা দেশে যে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র গুলো রয়েছে সেগুলোতে থেরাপিষ্ট এবং সহায়ক উপকরণ রাখার জন্য আলাদা একটা রুমের বরাদ্দ সরকার দিতে পারতেন। ফলে অনেক টাকা বেঁচে যেতো যা দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো।
অপরদিকে ভিজ্যুয়ালি ইমপেয়ার্ড পিপলস সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক মুহাম্মদ ইফতেখার মাহমুদ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর গঠনের গুরুত্ব স¤পর্কে জোরালো তাগিদ দিয়ে বলেন, নারী উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে মহিলা অধিদফতর গঠন হয়েছিল এবং এর বাস্তবায়নের কারণে সকল মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট বন্ধ হয়নি বরঞ্চ নারীদের সমাজের মূলধারার উন্নয়নের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নেই এই বাজেট আরও গতি পেয়েছে। এবং মহিলা অধিদফতর এই সকল কার্যক্রম সমন্বয় ও পরিচালনাতে জোরালো ভূমিকা পালন করছে। আর তাই প্রতিবন্ধী মানুষের অধিদফতরও একীভূত সমাজ বিনিমার্ণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারায় অংশগ্রহণে ইতিবাচক ভূমিকাই রাখবে।
একদিকে ফাউন্ডেশন বিলুপ্ত হচ্ছে না এবং ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। অন্যদিকে অধিদফতর তৈরিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা হচ্ছে না। তাহলে সরকারি আমলাদের এই দ্বৈত অবস্থান কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়নকে তা নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে প্রতিবন্ধী জনগণের মাঝে।