মনির হুসাইন নিলয়
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিচরণ ও পাঠ্যক্রমে অবস্থান সুদৃঢ় হলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীবান্ধব নয় প্রশাসনিক ও অন্যান্য নানাবিধ ব্যবস্থা।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শ্র“তি লেখক সমস্যা দীর্ঘদিনের। অপরদিকে অভিযোগ রয়েছে অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার অভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী বিশেষত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি ইচ্ছে সত্ত্বেও তা সম্ভব হয় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর রেজিস্ট্রিকৃত তথ্যমতে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে মোট ৭১ জন শারীরিক ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত আছেন। তন্মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ৬১ জন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ১০ জন এবং চলতি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে কলা অনুষদে ৫ জন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ৭ জন এবং আইন অনুষদে ২ জন সহ মোট ১৪ জন ভর্তি হয়েছেন।
প্রথম দিকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৬টি আসন বরাদ্ধ ছিল প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যে। এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের খ্যাতিমান প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে এখানে আসন কম ছিল। তবে যা ছিল তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমি ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠায় আসন বৃদ্ধি করেছি এবং উক্ত অনুষদের প্রতিটি বিভাগে যেন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি। এত সংখ্যক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করলেও এখনো পর্যন্ত পূর্ণ সুযোগ সুবিধা ভোগ করার মত কিংবা সম্পুর্ণরূপে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব শিক্ষাঙ্গন হিসেবে গড়ে উঠতে পারে নি চবি।
সংখ্যা গরিষ্ঠ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শ্রুতিলেখক সমস্যাই অন্যতম প্রধান সমস্যা তাদের কাছে। শ্রুতিলেখক এর জন্যে আবেদন করে রাখলেও অনেক সময় দেখা যায় পরীক্ষার দিন বা পরীক্ষার ঘন্টা খানেক আগেও শ্রুতিলেখক অনিহা দেখায় বা হাজির না হলে বিপাকে পড়েন সেই শিক্ষার্থী। এদিকে তাৎক্ষনিকভাবে শ্রুতিলেখক পাওয়া না গেলে প্রশাসনিক জটিলতার অযুহাতে তা মানতে চান না বেশিরভাগ বিভাগের চেয়ারম্যান। ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের। তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার জন্য শ্র“তিলেখককে উৎসাহিত করতে বিশেষ সম্মাননা বা দায়িত্বকালীন বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করলে এ নিয়ে গাফেলতি অনেকাংশে কমে আসবে।
আইন বিভাগে অধ্যায়নরত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী খোরশেদ জানান, পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থীরা এখন ভর্তি হচ্ছে চবিতে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থী বা অনেক শিক্ষকের মাঝে আমাদের উপস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে না নেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। সেকেলে বা আনাড়ি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এমনটা হতে পারে। এ বিষয়ে ইতিবাচক ভুমিকা পালনসহ শ্রুতিলেখক সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রশাসনসহ সকলের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যা¤পাসের ভবনগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব প্রবেশগম্যতা প্রসঙ্গে অপরাজেয়কে জানান, র্যা¤প বা অন্যান্য প্রবেশগম্যতা নিয়ে সেভাবে ভাবে নি কেউ এবং এ নিয়ে সোচ্চার হতেও দেখা যায় নি কাউকে তাই হয়তো উদ্যোগ নেয়া হয় নি। তবে আমরা প্রতিটি ভবনে লিফটের ব্যবস্থা রেখেছি বিশেষ প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। তিনি আরও জানান, প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারগুলোকে প্রাধান্য দিয়েই তারা কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষত প্রতিটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হলের আসন নিশ্চিত করা এবং তাদের উন্নয়নকল্পে বেশ কিছু কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এদিকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সমস্যা দূরীকরণে বাস মিনিবাসগুলোতে ন্যূনতম ২টি আসন রাখতে বলা হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তরী বা মিনিবাসগুলোতে ২টি আসনের কথা লেখা থাকলেও কোন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এলেও তারা দাঁড়িয়েই থাকেন। নারী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ফলে যাতায়াত সমস্যা মিটছেই না।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দাবি বাসে এবং ট্রেনের প্রতিটি বগিতে ন্যুনতম ২টি আসনের যথাযথ ব্যবস্থা করা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ড্রেনগুলো খোলা থাকার কারনে অনেক সময় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা ড্রেনে পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হন। এই সমস্যা লাঘবে নাট্যকলা অনুষদের চেয়ারম্যান কুন্তল বড়ুয়া দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন কিন্তু প্রশাসন আশ্বাস দিয়েও ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেন নি। প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য কিছু ড্রেনের উপরে ¯¬্যাব দেয়া হয়েছে মাত্র। চবির সমস্ত ড্রেনগুলো ¯¬্যাব দিয়ে ঢেকে দেয়ার দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার দাবী জানান আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত দাস। এছাড়া প্রতিটি হলের গার্ড বা কর্মচারিকে রাস্তা পারাপারের জন্যে বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদানে এ সমস্যা দূরীভূত হতে পারে বলে মনে করেন অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যে যে বিশেষ ভাতা প্রদান করা হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প উল্লেখ করে তার পরিমান আরও বাড়ানো উচিৎ বলে করেন তারা।
চবি এর প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের একমাত্র সংগঠন ডিজেবল্ড স্টুডেন্ট সোসাইটি অব সিইউ (ডিসকো) বিভিন্ন সময়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এইসব ন্যায্য এবং যৌক্তিক ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে। ডিসকো এর সভাপতি মোঃ সোলায়মান বাদশা অপরাজেয়কে জানান, পূর্বের তুলনায় অবস্থান কিছুটা ভাল হলেও আমাদের ন্যায্য অধিকার সবটুকু এখনও পাই নি। একটি লাইব্রেরিতে প্রতিবন্ধী কর্ণার করা হলেও সেখানে পর্যাপ্ত বই নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি অফিস করে দিয়েছেন তবে যে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে তা নষ্ট। দ্রুত এ সমস্যাটি সমাধানের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
সমাজতত্ত্ব বিভাগের মাস্টার্স এ পড়ুয়া হুমায়ুন কবির বলেন আমরা আমাদের যোগ্যতা বলেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছি তাই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে এবং বিশেষ প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।