অপরাজেয় প্রতিবেদক
নির্বাচন কমিশন সহ সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রতিবন্ধী মানুষের ভোট দানসহ রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে দেশের বেশ কিছু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন।
সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের বিশেষ চাহিদা বিবেচনায় রেখে নির্বাচনী আচরণ ও পরিচালনা বিধি সংশোধন করাসহ, ভোট কেন্দ্রে প্রবেশগম্যতা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে স্বাধীন পদ্ধতিতে ভোটদানের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবার আহ্বান জানান তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে।
সেই সাথে প্রতিবন্ধী নাগরিকের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সকল পর্যায়ের কমিটিতে তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ এবং আগামীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর গুরত্বারোপ করেন তারা।
উল্লেখ্য, গত ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোর সমন্বয়কারী জাতীয় নেটওর্য়াক প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) এর ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব রকিবউদ্দিন আহমদ এর সাথে সাক্ষাৎ করে লিখিতভাবে ১৩ দফা সুপারিশমালা পেশ করেন।
ঘন্টাকাল ব্যাপী এই সাক্ষাতের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুপারিশসমূহ ধৈর্য্যসহকারে শোনেন এবং একমত পোষণ করে পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। এ সময়ে পিএনএসপি’র প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যে ধরনের সামাজিক, দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার সম্মূখীন হয়ে আসছে তা তুলে ধরেন।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বুদ্ধি ও মনো সামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পক্ষে পিএনএসপি’র প্রতিনিধিদল কর্তৃক তুলে ধরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাসমূহ-
১. সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের বিশেষ চাহিদা বিবেচনা রেখে নির্বাচনী আচরণ ও পরিচালনা বিধি সংশোধন করা এবং বিশেষ করে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশগম্যতা ও ভোটদানে গোপনীয়তা ও তার স্বাধীন পদ্ধতিতে ভোটদানের ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ধরনের ওপর সহায়তাকারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
২. জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ভান্ডারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুসারে ব্যক্তি সকল ধরনের প্রতিবন্ধিতার তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা
৩. প্রতিবন্ধী নাগরিকের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সকল পর্যায়ে কমিটিতে তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা।
৪. আগামীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষত সদস্য পদে কোটা সংরক্ষণ করা।
৫. নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সংবেদনশীল হতে এবং তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণ করতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। ভোটকেন্দ্রের পোলিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্তকরণ ও গাইডলাইন সম্বলিত তথ্যপত্র প্রকাশ করা।
৬. নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক ফোকাল কর্মকর্তার কার্যাবলি ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্টকরণ ।
৭. নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটা বাস্তবায়ন করা।
৮. ভোটার রেজিস্ট্রেশন ফর্মে ২১ নং পয়েন্টে প্রতিবন্ধিতাকে অসমর্থ্যতার সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যা সংশোধন করা। ফর্ম অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষের তালিকা আলাদা সংরক্ষণ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটদানের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে কেন্দ্রভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করা।
৯. ভোটকেন্দ্রসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী করা; যেমন- নীচতলায় হতে হবে, ভোটদানের গোপন কক্ষটি প্রশস্ত করতে হবে এবং স্বল্প দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
১০. নির্বাচন কমিশন থেকে প্রচারিত জনসচেতনতামূলক প্রচারণা ও নির্দেশনা শ্রবণ ও বাক, দৃষ্টি এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ভোটারসহ সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উপযোগী (অডিও, ভিডিও, ব্রেইল ও ইশারা ভাষা) করা।
১১. নির্বাচনের দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত গাড়িকে চলাচলের জন্য অনুমতি দেয়া।
১২. প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে তাদের সংগঠনসমূহকে পর্যবেক্ষনের কাজে সম্পৃক্ত করা।
১৩. Electronic Voting Machine (EVM) পদ্ধতিতে টকিং, অডিও ও হেডফোনের মাধ্যমে পরিচালনার সুযোগ রাখা।
১৪. ফোরাম অব ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বডিজ অব সাউথ এশিয়া (FEMBoSA) এর সভায় সম্মিলিতভাবে সকল দেশের নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিবৃন্দ একটি কমন মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড তৈরির বিষয়ে একমত হয়েছিলেন, সেই বিষয় উদ্যোগ নেয়া।
১৫. বাংলাদেশের লুনাসি আইন ২০১২ অনুযায়ী মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষের ভোটাধিকার নেই। যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার বা পারসোনালিটি ডিজওর্ডার ইত্যাদি অবস্থার সম্মুখিন মানুষেরাও স্বাভাবিক সকল কার্যকর্ম করতে পারেন। তাই তাদের প্রতিবন্ধিতার কারণে যেন ভোটাধিকার বা রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিতন করা না হয় সেক্ষেত্রে তাদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার নিশ্চিতকল্পে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া।
এখানে উল্লেখ্য, গত ১-৩ অক্টোবর, ২০১৫ শ্রীলংকার কলোম্ব ফেম্বোসা এর ৬ষ্ঠ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন অব ইলেক্টোরাল সিস্টেম (আইএফইএস) আয়োজিত এই সভায় প্রতিবন্ধী মানুষের রাজনৈতিক অধিকার বিষয় এবং নির্বাচন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে জোর দেয়া হয়। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলো অংশ নিয়েছিলো এখানে। বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশনারবৃন্দের সম্মুখে সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিবন্ধী মানুষের পক্ষ থেকে ৯টি সুপারিশ পেশ করা হয়। সুপারিশগুলো সভায় উপস্থিত সকল দেশ সর্বসম্মতভাবে মেনে নেন এবং নিজ নিজ দেশে নির্বাচন প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে একমত হন। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে পিএনএসপি অংশ নিয়েছিলো।