সাবরিনা সুলতানা
পঞ্চম শ্রেণির দ্বিবার্ষিক পরীক্ষার শেষ দিন! পরীক্ষা শেষে স্কুল-বারান্দায় রোকসানা আর রেজিনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে জন্মের শত্রু খুরশীদকে নাস্তানাবুদ করার পরিকল্পনা আঁটছি। কত্ত বড় সাহস তার, ব্ল্যাকবোর্ডে আমার নামের পাশে শুঁটকিমন্ত্রী লিখে রাখে! এইবার তাকে আমি সামনের পুকুরটায় নির্ঘাত ফেলে দেব। অবশ্য রোকসানা খুব চিন্তিত, যদি সে সাঁতার পারে!
এ সময় মাসি এসে জানালেন, হেড স্যার ডাকছে। রোকসানার চিন্তিত মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। রেজিয়া আমার হাত ধরল। গতবার হেড স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে কড়া রোদে এক ঘণ্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল আমাকে। এইবার না জানি কী শাস্তি আছে কপালে! তাই ভেবে দুজনেই দিশেহারা। অবশ্যি এসব শাস্তি-টাস্তি নিয়ে আমার কোনোকালেই মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তাদের চিন্তার শেষ নেই। এক গাল হেসে তাদের আশ্বস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা শেষে ধীর পায়ে রওনা দিলাম স্যারের রুমের দিকে। বুঝি না ক্যান জানি এই মেয়ে দুইটা এই বয়সেই আমার জন্য ‘আম্মা টাইপ’ চিন্তাভাবনা করা শুরু করেছে!!
হেড স্যারের রুম সামনের তিনতলা ভবনে। এই ভবনের ডান দিকে এল শেপের একতলা সেমিপাকা একটি আলাদা ঘর তুলে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নেয়া হয় সেখানে। সামনে লম্বা বারান্দা। পরীক্ষা শেষে আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে খুরশীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলাম। সামনের ওই তিনতলা ভবনের সামনেও লম্বা আরেকখানা বারান্দা আছে। দোতলা-তিনতলায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস হয় সেখানে। আর নিচতলায় হেড স্যারের একটি রুম। পাশে অন্যান্য শিক্ষকের রুম। তার পাশেই পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের কোচিং ক্লাস। ওই ভবনে ওঠার পথে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। রোকসানা, রেজিয়াই সব সময় আমাকে সাহায্য করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়।
বরাবরের মতোই অযাচিত ভিড়। আমার আঁকাবাঁকা পায়ে ধীরগতিতে হেঁটে সিঁড়ির ধাপ পেরোনো সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদের দু-একজন বাবা-মায়ের ঘেন্নার দৃষ্টি আমার দিকে। যেন শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলাফেরা আমার চরম অপরাধ! এখন আর এসব গায়ে লাগে না তেমন। তাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। স্যারের মুড দেখি বেশ ভালো আজ। পানের পিক ফেলতে ফেলতে হাসিমুখে ডাকলেন তিনি।
– আয়। এখানে বোস, তোর সাথে একটু কথা বলি!
স্যারের হাসিমুখের মিষ্টি কথায় আমার চোখ কপালে ওঠার দশা! যা হোক, বসলাম চেয়ারে। এরপরে স্যার যে শাস্তি আমায় শোনালেন, এমন শাস্তির কথা বোধ হয় স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি আমি!
– তুই এখন ক্লাস ক্যাপ্টেন না!
– ইয়ে… না স্যার। সেকেন্ড ক্যাপ্টেন।
– হু… শুনলাম, অঙ্কে নাকি খুব ভালো করেছিস। ভর্তির সময় তো এক শত পাঁচপান্নো নাকি যেন একটা বলে আমারে ভড়কায়ে দিছিলি! দেখি এখন বল তো!
– ইয়ে… মানে… স্যার…
– হু…আচ্ছা, থাক। অঙ্কে আগ্রহ থাকা অতি ভালো বিষয়। কিন্তু শরীর তো শুনলাম আরও খারাপ হইছে তোর?
মোটা কালো ফ্রেমের স্বচ্ছ গ্লাসের আড়ালে চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন তিনি। তার চাউনিতে আমি পারলে চেয়ারের নিচেই ঢুকে যাই। বলার মতো কিছু খুঁজেও পেলাম না।
– রমিজ বলতেছিল, কালকেও নাকি পড়ে ব্যথা পাইছিস!
– হু…না মানে, জি স্যার… [ কথাবার্তা এইদিকে গতি পেলে আমি অসহায়ের মতো ঘামতে থাকি। ঠিক কী বলা যায়, আসলেই বুঝতে পারি না। এদিকে স্যার বলেই চলেছেন… ]
– রোজই নাকি এখানে-সেখানে পড়ে গিয়ে হাঁটুর চামড়া ছিলেটিলে একাকার। শোন মা, [এই পর্যায়ে স্যারের গলা আরও নরম হয়ে এলো] তুই এক কাজ কর, এখন থেকে আর স্কুলে আসার দরকার নাই। যদ্দুর পারিস, ঘরে বসেই পড়ালেখা করবি আরকি। আল্লাহ এই অবস্থায় দিয়েছেন, কী আর করবি!
আমি অবাক বিস্ময়ে তাকালাম। খানিকক্ষণ কী যেন চিন্তা করলেন তিনি। আবার বলে উঠলেন,
– না, মানে, এত যন্ত্রণা করে রোজ রোজ ক্লাসে আসবি না আরকি! পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষাগুলো দিয়ে যাস না হয়। কী দরকার এই শরীর নিয়ে এত সব ঝক্কি-ঝামেলা করে রোজ রোজ স্কুলে আসার!
মাথাটা কেমন শূন্য হয়ে আছে। হঠাৎ করেই এলেবেলে লাগছে সবকিছু। স্কুল-বারান্দা থেকে নামতেই খুরশীদ পাগলাটা বুড়ো আঙুল দেখাল। তাকে পাল্টা দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই এলো না আজ মনে। খুরশীদ! যার সঙ্গে কিনা কেবলই ঝগড়া করেছি দুটো বছর। আমাদের ভেতরে নিবিড় বন্ধুতার টান দুজনেই অনুভব করতাম। তবু ঝগড়া, খুনসুটি ছাড়া ভালো করে দুটি কথা কখনোই বলা হয়নি ওর সঙ্গে। আজ কি কিছু বলব তাকে!
নাহ্! থাক। রোকসানা রেজিয়াকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম। কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না কেন জানি। আজ আর রিকশায় ফিরব না। নার্স কলোনির শর্টকাট পথটা ধরব। ঝিম ধরা নীরবতার মাঝে নির্জন দুপুরের গা ছমছমে এবড়োখেবড়ো রাস্তাটায় একাকী নিজের মতো হেঁটে বেড়াব। রোদ্দুর মাথায় নিয়ে আজ হেঁটে বাড়ি ফিরব আমি।
খুরশীদের সঙ্গে সেই শেষ দেখা। মকবুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতিবিজড়িত সেই ভবনটিও…আর কখনোই সেদিকে যাওয়ার অবস্থা বা সুযোগ হয়ে ওঠে নি। আজও মনে আছে সেই দিনটি, বার্ষিক পরীক্ষার প্রথম দিনে আমাকে নিতে এলো রেজিনা, রোকসানা। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সহজ, স্বাভাবিকভাবেই তাদের বলে দিলাম, আর স্কুলে যাওয়া হবে না রে আমার! স্যার বাবা-মাকে মানা করেছেন। তাঁরাও ভাবছেন, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা…হরেক সমস্যা। এখন থেকে ঘরেই পড়ব। সেদিন যদি আমরা কেউ-ই ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম, কত্ত বড় ভুল করতে যাচ্ছি! হাহ্!
কত দিন-মাস-বছর পেরিয়ে গেল। লাগামহীন স্বপ্ন নিয়ে চার দেয়ালের আঁধার কোণেই বেড়ে ওঠা আমার। আমি স্বপ্নের মাঝে ইচ্ছেগুলো নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো উড়ে বেড়াতে ভালোবাসি। আর সপ্নপূরণের জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করা মোটেও দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার মনে হয় না আমার। ‘অসম্ভব’ শব্দটি নাড়া দেয় না বলেই সম্ভবত দিনের আলোয় জেগে জেগে সপ্ন ভেবে সেই নিয়ে প্রাণপনে ছোটার দুঃসাহসে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। পূরণ হবে কি আদৌ বাধা বা সমস্যার সম্মুখীনতা ইত্যাদি সব নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছেও জাগে না। হতে পারে মনের অব্যক্ত চাপা ক্ষোভ থেকেই হিজিবিজি অজস্র সপ্নের পাহাড় গড়ে ওঠে চিন্তা-চেতনায়। অদম্য এক জেদ কাজ করে সপ্ন বাস্তবায়নের। তেমনই এক সপ্নের নাম ‘আমাদের শিক্ষালয়’।
একীভূত শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয়ে গঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে সকলের জন্য উন্মুক্ত। সেই অনেক বছর আগের আমার সেই শিক্ষকের মত, প্রতিবন্ধিতার কারণে কাউকে স্কুল থেকে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হবে না। যেখানে অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে দস্যিপনায় মেতে উঠবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য প্রত্যেকের চাহিদা অনুযায়ী সহায়ক পরিবেশ থাকবে সেখানে।
আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাই ছোট ছোট কিছু দৃশ্য শ্রেণিকক্ষে অগুনতি শিক্ষার্থীর মাঝে কয়েকজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বইয়ের ওপর হাতের আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে ব্রেইল পদ্ধতিতে। কয়েকজন শ্রবণ ও বাক্ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক বাংলা ইশারা ভাষায় পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আর এক ঝাঁক অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সঙ্গে রয়েছে ক্রাচ ও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীরাও। সবাই একই শ্রেণিকক্ষে পড়ছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োজন হয় না, শুধু দরকার চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতা। অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভবনে প্রবেশের জন্য যেমন সিঁড়ি প্রয়োজন, তাদের দরকার র্যাম্প বা ঢালু পথ। অর্থ সমস্যায় বহুমূল্য লিফট বসানো সম্ভব না হলে সেই ভবনে থাকবে প্ল্যাটফর্ম লিফট, যা তাদের সহজেই ওপরতলায় নিয়ে যাবে। যদ্দিন তা সম্ভব হবে না, তদ্দিন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে না পারার অপরাধে কাউকেই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে না। কারণ, তাদের জন্য প্রয়োজনে শ্রেণিকক্ষ নিচতলায় নামিয়ে নেওয়া হবে এই প্রতিষ্ঠানে। প্রতি তলায় থাকবে প্রবেশগম্য টয়লেট। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়া ফাঁকি দিতে টয়লেটে যাওয়ার নাম করে একা একাই কারও সাহায্য ছাড়া ব্রেইল ব্লক অথবা টেকটাইল দিকনির্দেশনার ওপর হেঁটে হেঁটে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যাবে। চোখের আঁধার তাদের চলার পথের প্রতিবন্ধকতা হবে না কখনোই। পুরো স্কুলজুড়ে থাকা টেকটাইলের ওপর পা রেখে স্বাধীনভাবে নিজের পথ নিজে চিনেই গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়াবে তারা।
একেকটি শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষকের রুম খুঁজে নেবে তারা টেকটাইলে লেখা সাইন হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। স্বল্প দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিক রঙের ব্যবহার থাকবে, যেন তারা দরজা, দেয়াল ও আসবাব বুঝে পথ চলতে পারে। পুরো ভবনের অমসৃণ করোগেটেড টাইলসে পিছলে পড়ে ব্যথা পাবে না ক্রাচ ও ওয়াকার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীরা। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও একেবারেই সমস্যা হবে না। কারণ, শিক্ষা ভবনের প্রতি মোড়ে মোড়ে থাকবে দিকনির্দেশনা সাইন। থাকবে ব্রেইল ও বাংলা ইশারা ভাষার প্রশিক্ষিত শিক্ষক। যেহেতু এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে যাতায়াতব্যবস্থা অতটা সহায়ক নয়, তাই শিক্ষালয়ের নিজস¦ যানবাহন থাকবে, যেখানে বিনা বাধায় তরতরিয়ে সবাই উঠে যাবে। একটি হুইলচেয়ারও আবদ্ধ হবে না ঘরের কোণে। যাদের কেউ নেই বা আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের জন্য থাকবে আবাসিক ব্যবস্থা। শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও থাকবে সেখানে। শিক্ষার্থীর মেধা, আগ্রহ ইচ্ছে যে বিষয়ে, সে সেই বিষয় নিয়েই যেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারে, সমাজে এই হবে উদ্দেশ্য।
আমাদের দেশের একটি শিক্ষালয়কে দেখে ধীরে ধীরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবেই একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটাবে। একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা লাল ফিতার কাগুজে ফাইল থেকে বেরিয়ে উড়ে বেড়াবে লাল-সবুজের এই দেশজুড়ে। স্বপ্নের বাস্তবায়নে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি আমি এবং আমরা। কিন্তু প্রয়োজন সম্মিলিত শক্তির। যার প্রতীক্ষায় দিন গুনছি আর সপ্ন দেখছি, এক চিলতে বাগানে রংবেরঙের সব ফুল-ফলের গাছে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে দুষ্টু রঙিন প্রজাপতির দল। তার পিছু পিছু হুইলচেয়ার সমেতই ছুটে বেড়াচ্ছে কেউ। তার চেয়ারটির পাশে ছুটছে অপ্রতিবন্ধী আরেক শিশু। খেলার মাঠে জড়ো হয়েছে তারা কেউ ক্রাচ হাতে। কেউ স্টিক, ওয়াকার এসব নিয়ে। হুইলচেয়ারেও আছে বেশ কজন। অপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরাও সমান তালে হইহুল্লোড় করে খেলাধুলা করছে সবার সঙ্গেই।
অভিভাবকেরা খুশিমনে শিশুদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। বাহবা দিচ্ছে। আর ছোট ভাবনার বড় স¦প্নের বাস্তবায়নে দেশের কোনো এক প্রান্তে একটি বারান্দায় বসে গরম কফির মগ হাতে তৃপ্তির শ্বাস নিচ্ছি আমি।