প্রণব কুমার পাল
দেশে প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান মেলা আয়োজিত হয়। দুদিনব্যাপী চলমান এই মেলার প্রথম দিনে একমাত্র সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। যদিও ফেসবুকে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতির উল্লেখ ছিল। অবশ্য প্রায় ২৬টি বেসরকারি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
গত ২৩ ও ২৪ মে ২০১৬ প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এই মেলা আয়োজন করে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুল হাসান মেলা উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনকালে তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ তৈরির জন্য সরকারের পাশপাশি দেশের সব নাগরিককে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসরীন আরা সুরাত আমিনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক, গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবীর, পরিচালক একেএম খায়রুল আহমেদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমান উল্লাহ।
রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে পরপর দুদিন এই মেলায় আমার মতো অনেকেই অংশ নেয় একটি চাকরির আশায়। মেলায় আমার কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতেই এ লেখার সূত্রপাত।
গত জানুয়ারির কিছুদিন আগে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন সব শিক্ষিত কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করে এবং তা ই-মেইলের মাধ্যমে অথবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ জেলার প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে জমা দিতে বলা হয়। যদিও সব জীবনবৃত্তান্ত উক্ত কেন্দ্রগুলোতে জমা দেওয়ার পর তা যথাযথ স্থানে পৌঁছাল কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
অতি উৎসাহের সঙ্গে প্রথম দিন সকাল ১০টায় মেলায় উপস্থিত হই। মেলায় ঢোকামাত্র যে বিষয়টি চোখে পড়ে, তা হলো হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের জন্য র্যাম্পের ব্যবস্থা করা হলেও তা মোটেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়। র্যাম্প দিয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষেরা একা উঠতে পারলেও মেলার এই র্যাম্পটি দিয়ে উঠতে অন্য আরেকজন ব্যক্তির সহায়তার দরকার পড়ে। ভেতরের পরিবেশ কোনোভাবেই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীবান্ধব ছিল না। প্রয়োজন অনুপাতে (উপস্থিতি অনুযায়ী) আয়োজনের স্থানটি ছিল ছোট। মূল দরজায় প্রবেশের আগে আমাদের বাইরের দরজার সামনে খোলা আকাশের নিচে বিভাগ অনুযায়ী অপেক্ষা করতে হয়েছিল, যা আমাদের মতো অনেক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। এমন অনেকেই সেদিন ছিলেন যাদের পক্ষে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অনেক বড়, সুতরাং খোলা আকাশের নিচে এভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের বসিয়ে না রেখে ভেতরে অপেক্ষার জন্য একটি কক্ষ বা মিলনায়তনের ব্যবস্থা করা যেত।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অসংখ্য (আনুমানিক ২ হাজার ৫০০) প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন এখানে। তারা প্রত্যেকেই চাকরি নামের সোনার হরিণের প্রত্যাশায় ছুটে এসেছিলেন। বিষয়টি বেশ ভালো লাগার কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্য প্রদানকারীর দেখা মেলেনি। বিষয়টি দুঃখজনক। যেমন চাকরির আগে খুঁটিনাটি বিষয় থাকে, সেগুলো সঠিকভাবে জানানোর জন্য সরকারি বা জেপিইউএফের একজন প্রতিনিধি থাকা দরকার ছিল। কোনো বিষয়ে তথ্য জানতে গেলে কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের আচরণ সহযোগিতাপূর্ণ ও আশানুরূপ ছিল না। মেলায় হুইলচেয়ার নিয়ে ঘুরতেও বেশ সমস্যা হয়েছিল সংকীর্ণ স্থানের কারণে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরও বেশ অসুবিধা হয়েছে। সে¦চ্ছাসেবকবৃন্দ থাকলেও যথাসময়ে তাদের দেখা পাওয়া যায়নি। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, বিজ্ঞপ্তিতে সব ধরনের শিক্ষিত কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী মানুষের কথা বলা হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণি পাস প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে এই মেলা নয়, তা আগেই উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল। কারণ, বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় আমি অনেককেই দেখেছি অনেক আশা নিয়ে এসে বিফল হয়ে ফিরে যেতে। আমি সিআরপির আমিন গ্রুপসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়ে প্রথম দিন ফিরে আসি।
দ্বিতীয় দিন মেলায় যাই কেয়া গ্রুপসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে। এদিন নরসিংদীর মো. আমিনুল ইসলাম নামের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তার হাত ছোট, তাই তিনি পা দিয়েই প্রায় সব কাজ করেন। পা দিয়ে লিখে তিনি ২০০৯ সালে এসএসসি এবং ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন, জীবনে অনেক সংগ্রাম করে এই পথ পাড়ি দিয়েছেন। বর্তমানে স¦-অর্থায়নে একটি ছোট কসমেটিকসের দোকান পরিচালনা করেন। তার অভিযোগ, সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো তাদের হাতে নাগালে পৌঁছায় না। তিনি মনে করেন, মাঠপর্যায়ে জরিপ চালিয়ে কর্মতৎপরতা বাড়ানো উচিত। চারপাশের পরিবেশসহ গণপরিবহনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও তার সঙ্গে আলাপ হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্য যানবাহন চালু করার গুরুত্ব সরকার কবে বুঝবে এমন আক্ষেপ অনেকের মধ্যেই দেখেছি কথা বলতে গিয়ে। অনেকেই আসতে পারেননি, তাই এ ধরনের কর্মসংস্থান মেলা দেশের বিভাগীয় পর্যায়েও করা উচিত বলে মত ব্যক্ত করেন কেউ কেউ।
সর্বশেষ আমার জানামতে, কেয়া গ্রুপে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। আয়োজনে অনেক ভুলত্রুটি থাকলেও প্রথমবারের মতো সরকারি এমন একটি উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রত্যাশা করি, ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও ভালো এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করা হবে।