সরকারের দাবি, প্রতিবন্ধী মানুষেরা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে অক্ষম
প্রতিবন্ধী মানুষদের ওপর উপুর্যপরি বিষাক্ত গ্যাস আর জলকামান। রায়ট পুলিশের ব্যর্থ চেষ্টা। প্রতিবন্ধী মানুষেরা বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে। কোনো কিছুই আজ তাদের থামাতে পারবে না। এদিকে পুলিশ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষদের। ক্রাচ কেড়ে নিচ্ছে। টেনেহিঁচড়ে হুইলচেয়ার থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। তবু থামছে না প্রতিবন্ধী মানুষেরা। এগিয়ে চলেছে তারা হামাগুড়ি দিয়ে। রাস্তায় গড়িয়ে। শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে। যেভাবেই হোক পৌঁছাতে হবে প্রেসিডেন্ট অবধি। জানাতে হবে আরজি। বৈষম্যের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে পেতে হবে সামাজিক স্বীকৃতি ।
সামাজিক মর্যাদা এবং ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে চলতি বছরের শুরুতেই বলিভিয়ায় প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনে আন্দোলনের ঐতিহাসিক সময়গুলো ছবিসহ তুলে ধরা হলো অপরাজেয় পাঠকদের জন্য। লিখেছেন – জাহেদ খান
দাবি তাদের সামান্যই। ভাতা বৃদ্ধি করে দেওয়া হোক। নইলে আর যে চলছে না। বর্ধিত সরকারি ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে বলিভিয়ায় অতি সাম্প্রতিক সময়ে লাগাতার ছয় মাস ধরে আন্দোলন চালিয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষেরা। প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে বলিভিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো। শুধু ডায়াপার পরে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে তারা। শরীরে বিভিন্ন দাবি লিখে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে তাদের থামাতে দাঙ্গা পুলিশ নামানো হয়। নিক্ষেপ করা হয় ক্ষতিকর একধরনের বিষাক্ত গ্যাস। জলকামানের তীব্রতায় ছিটকে যায় শত শত প্রতিবন্ধী মানুষের দল। পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে তবু তারা নানা দিক থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চালায় প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য। এতে প্রতিবন্ধী মানুষেরা গুরুতর আহত হয়। কিছু পুলিশও আহত হয়।
বিক্ষোভকারী প্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৫০০ বলিভিয়ানোস (প্রায় ৯৭ ডলার) করে ভাতা বৃদ্ধির দাবি করে, যা বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ দেওয়া হয়। ২০১১ সালের আন্দোলন-পরবর্তী সরকারের মেনে নেওয়া দাবির বাস্তবায়ন না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রতিবন্ধী মানুষের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সংশ্লিষ্ট সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টির বাস্তবায়ন চান বলিভিয়ান প্রতিবন্ধী মানুষেরা। তাদের ন্যায্য দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বৈষম্যের প্রতিবাদে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বিক্ষোভ করে আসছে তারা। মাত্র ১৫০ জন প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে আন্দোলনের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে আরও অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কোচাবাম্বাতে অভিনব উপায়ে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করে তারা।
বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন ওভারব্রিজ থেকে দড়ি দিয়ে হুইলচেয়ার বেঁধে নিজেদের দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখে সবার নজর কাড়তে। যারা গুরুতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রতি বছর ১০০০ বলিভিয়ানোস করে পাবার যোগ্য, তারা বলেন, মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যা খুব অপর্যাপ্ত; যেমন খাবার ও ডায়াপার। তাই আমরা অনেক বিক্ষোভকারী প্রতীকি হিসেবে ডায়াপার পরে প্রতিবাদ জানিয়েছি। কেউ শরীরের পেছনে ক্রশ বেঁধে হেঁটে চলেছে, কেউ দেশের পতাকা এবং বিভিন্ন দাবিসংবলিত পোস্টার নিয়ে।
এরপর আন্দিজ পর্বতমালার মধ্য দিয়ে হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের রাজপ্রাসাদ অভিমুখে রওনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সরকারের মুখোমুখি হতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানী লা পাজ অভিমুখে হুইলচেয়ার এবং ক্রাচে ভর করে প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তাদের পৌঁছতে এক মাস লেগে যায়। কিন্তু রাজধানী লা পাজ পৌঁছার পর দাঙ্গা পুলিশ নামিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবন্ধী মানুষের বিরুদ্ধে। তাদের সামনে তিন মিটার উঁচু ব্যারিকেড তৈরি করা হয় এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ অভিমুখী সব রাস্তা ব্লক করে দেওয়া হয়।
তাদের সেই মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পেপার স্প্রে (গোলমরিচের গুঁড়া দিয়ে মিশ্রিত একধরনের বিষাক্ত গ্যাস, যা চোখে জ্বালা করে ও শ্বাসনালি দিয়ে ফুসফুসে পৌঁছে ক্ষতি করে।) জলকামান ব্যবহার করা হয় এবং ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। যখন প্রতিবন্ধী বিক্ষোভকারীদের পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছিল, তখন একজন প্রতিবন্ধী নারী বিক্ষোভকারী বলছিলেন, আমরা শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে ইভো মোরালেসের কাছে মর্যাদা চেয়েছিলাম এবং দেখুন তিনি কী করছেন… আমাদের আহত এবং দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। অপর এক নারী মারিকা, যিনি তিরিশ বছর ধরে হুইলচেয়ার ব্যবহার করছেন, তিনি বলেন, দীর্ঘ এই যাত্রায় পথিমধ্যে আমরা কখনো কফি ও রুটি খেয়েছি। কখনো পাস্তা। বিনা মূল্যে রাত কাটানোর জন্য মাথার ওপর ছাদ না পেলে, গাছের নিচে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছি। ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য এই আন্দোলনে সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে।
এদিকে সরকার দাবি করছে, যেসব প্রতিবন্ধী মানুষ জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে না, তাদের জন্য রাষ্ট্রের যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদের অভাব রয়েছে এবং বিক্ষোভকারীরা বলভিয়াকে অস্থিতিশীল এবং সরকারকে নেতিবাচক হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য এডগার রোমেরো বলেন, যারা দেশের জন্য উৎপাদনশীল নয়, তাদের জন্য আমরা ভাতা বৃদ্ধি করতে পারি না এবং আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিবন্ধী মানুষেরা অযৌক্তিক ও অসমর্থনীয় দাবি করছে এবং যারা কাজ করে না, রাষ্ট্র তাদেরকে বেশি ভাতা দিতে পারবে না। যদিও কিছু রাজনীতিবিদ নিরস্ত্র নিরীহ প্রতিবন্ধী মানুষের দাবি মোকাবিলায় সরকারের এহেন কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা জানায়। তারা বলেন, বলিভিয়ার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নতুন নয় এবং তারা ক্ষমতাহীন বলে সরকারের দায়িত্বশীলেরা তাদের যথেষ্ট মূল্যায়ন করে না।
২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর ত্রিনিদাদ থেকে হাজার মাইল দূরে রাজধানী লা পাজ অভিমুখে প্রতিবন্ধী মানুষেরা অনুরূপ আন্দোলন করেছিল; যা ২০১২ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কিন্তু এখানেও দাঙ্গা পুলিশ তাদের ঘেরাও করে রাখে এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ অভিমুখী সব রাস্তায় ব্যারিকেড বসায়। এ বছরের মতোই তাদের ওপর জলকামান এবং পেপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। উপায় না দেখে প্রতিবাদকারীরা ফেব্রুয়ারি ২৪ তারিখ থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করে। টানা আট দিন অনশনের পর তারা প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। পরে সরকার কিছু দাবি মেনে নেয়। গুরুতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকার বছরে ১০০০ বলিভিয়ানোস (প্রায় ১৯৪ ডলার যা মাসে ১৬ ডলার) ভাতা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু অনেক প্রতিবাদকারী মনে করেন, তাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠ মৃদু মাত্রার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দাবির ব্যাপারে সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি।
বর্তমানে বলিভিয়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হিসেবে নিবন্ধিত। কিন্তু রাইটস গ্রুপ অব বলিভিয়া মনে করে, বর্তমানে বলিভিয়ায় প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা লক্ষাধিকের বেশি। যারা গুরুতর প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন, শুধু তাদেরকে সরকারি নিবন্ধনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা মনে করে, বলিভিয়ার জনসংখ্যার মোট ৬ শতাংশ (৬ লাখ) প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে।
মার্কিন তথ্যচিত্রনির্মাতা ভিওলেটা আয়ালা এবিসি নিউজকে এ বিষয়ে বলেন, ডাউন সিনড্রোমকে এখনো প্রতিবন্ধিতা হিসেবে সুবিধাপ্রাপ্তির যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। প্রবেশগম্যতা নেই। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। ভিওলেটা আয়ালা এবিসিকে বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শুধু রাষ্ট্রীয় সুবিধা পায় না, বরং তারা বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ বা ভালো একাডেমিক হবার সুযোগ পায় এবং সমাজে তাদের সব সময় সাদরে বরণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, বলিভিয়ার বিক্ষোভকারীদের দাবিকে আমি লোকাল ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করি না; বরং মানবাধিকারের জন্য এটি বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন বিষয়।
বিক্ষোভকারীদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণকারী জাতিসংঘের কো-ফাউন্ডার ড্যান ফলসো এবিসিকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যা বিরাজমান। এত দিন সুপ্ত অবস্থায় ছিল কিন্তু বর্তমানে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিক্ষোভকারীদের দাবি খুব ন্যূনতম। কিন্তু সরকার প্রকাশ্যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে বলছে, ইতোমধ্যে তাদের পর্যাপ্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা বলিভিয়ানদের দ্বিধাবিভক্ত করেছে। সরকারের দাবি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনা মূল্যে আবাসন, শিক্ষা ও হাসপাতালে সেবা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, এই আইন শুধু কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। জনাব ফলসো এর সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি আরও বলেন, আমি মানুষকে হাসপাতালে যেতে দেখেছি, কিন্তু কিছুই বিনা মূল্যে নেই, এমনকি ওষুধও নয়। ডাক্তাররা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করে দেন এবং ওয়েটিং রুমে বসতে নিষেধ করেন। তাদেরকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করা হয় না বলে দাবি প্রতিবন্ধী মানুষদের।
বিক্ষোভকারীদের মুখপাত্র ফেলিজা আলী বলেন, তাদের দাবি ন্যূনতম ছিল কিন্তু সরকার তাদের দাবি উপেক্ষা করেছে। কারণ, এই সুবিধাগুলো অপ্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে তাদের সমতা নিয়ে আসবে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তিনি আরও বলেন, বাসে যাতায়াত করার সময় পশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে নিজের সিটে পৌঁছানোর চেয়ে যদি আমার ৫০০ বলিভিয়ানোস থাকে, তাহলে সম্মানের সঙ্গে নিজের সিটে বসার জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করার জন্য খরচ করতে পারব। এটা একটা নিজস্ব চাহিদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের শুরু। যুগ যুগ ধরে পৃথকীকরণ এবং বিরাজমান জাতিবিদ্বেষ বন্ধ করার সময় এসে গেছে। তাই আমরা নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সোচ্চার হয়েছি।
প্রতিবন্ধী মানুষেরা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য পাজ মুরিলোতে বিক্ষোভ চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেছে, যতক্ষণ না সরকার তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে সংলাপ আয়োজনের নিশ্চয়তা দেয়।