শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারী, বাক প্রতিবন্ধী নারী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী। হুইলচেয়ার কিংবা ক্রাচ ব্যবহারকারী শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী… কেউবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এবং অটিস্টিক নারী ও মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারী। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী নারীদের এমন একটি বিষয় আলোচনায় নিয়ে আসতে চাই আমরা, যা ইতোপূর্বে জনসম্মুখে আলোচনাতেই আসেনি কখনো।
যারা সবাই এ দেশে নির্মম এক বাস্তবতায় দিন কাটাচ্ছেন। আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী নারীগোষ্ঠীর মাসিককালীন পরিচর্যা, তাদের বিয়ে, পরিবার গঠন, সংসারের স্বপ্ন দেখা, কিংবা মা হতে পারার আনন্দ অথবা তার প্রজনন স্থ্যসেবার বিষয়টিও এ দেশের অধিকাংশ পরিবারের কাছে অপ্রয়োজনীয়, অবাস্তব ও বিলাসিতা মাত্র।
আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে চাই। আমরা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য তথা পরিবার গঠনের অধিকার বিষয়ে সবাইকে জানাতে চাই। কিছু বদ্ধ দুয়ারে টোকা দিতে চাই আমরা এবং সেই দরজাগুলো খোলার উপায় নিয়ে ভাবাতে চাই সবাইকে। সবার সহযোগিতায় খুঁজে বের করতে চাই বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী নারীদের চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী আমাদের দেশে কী আছে, বা কী নেই অথচ যা থাকতে পারে। যদিও আমাদের দেশে সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংস্থা অ-প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। যা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই কার্যক্রমে আমরা প্রতিবন্ধী নারীরা অবহেলিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১১ সালের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষ ১৫ শতাংশ। অপরদিকে ২০১১-এর জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয় ব্যয় জরিপ ২০১০’ অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী ১ দশমিক ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪-১৫ অনুযায়ী, দীর্ঘ দুই বছর ধরে পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ হয়েছে ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৯০৫ জনের এবং শনাক্ত হয়েছেন ১২ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫৬ জন। অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরযোগ্য একটি পরিসংখ্যান নেই আজ অবধি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা, সম্মেলন ও সনদ
বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১০ (গ্লোবাল পপুলেশন রিপোর্ট) এর পরিসংখ্যান মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশ প্রজননসক্ষম নারী, যাদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে মনোসামাজিক, শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীদের খুব সংগত কারণেই প্রয়োজন বিশেষ ধরনের মাসিক ও প্রজনন স¦াস্থ্যসেবার। এর মধ্যে মাসিককালীন পরিচর্যা, জন্ম প্রতিরোধ বা বিরতিকরণ পরামর্শ ও সেবা, নিরাপদ গর্ভপাত, গর্ভপাতোত্তর সেবা, বন্ধ্যাত্বকালীন, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা, যৌন রোগসহ প্রজননতন্ত্রের যেকোনো প্রদাহ ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত (সূত্র: আইসিপিডি)।
বিশ্বে কবে, কখন প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়, সঠিক জানা নেই, তবে ২০১৫ সালের আমেরিকার কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্র থেকে ধারণা পাওয়া যায়, প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবামূলক আলোচনার শুরুটা হয় সত্তর দশকের দিকে। সমাজে প্রচলিত একটি ধারণার ওপর গবেষণায় আলোকপাত করে সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী নারীদের কোনো যৌন চাহিদা রয়েছে, এমনটা ভাবতে পারে না সমাজ। সত্তর দশকের প্রাপ্ত সেই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সেখানকার আশি শতাংশের বেশি অভিভাবক এবং সাহায্যকারী সেবাকর্মী স্টেরিলাইজেশন বা অপারেশনের মাধ্যমে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ উপযোগী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। বিশেষত বুদ্ধি ও মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি করা হতো। একই গবেষণাপত্রে আরও বলা হচ্ছে, ২০০২ সালে এসেও অভিভাবক ও শিক্ষকেরা স্টেরিলাইজেশনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, কোনো নারীর পূর্ণ সম্মতি ব্যতিরেকে অপারেশনের মাধ্যমে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ তার প্রজনন অধিকারকে ক্ষুণœ করে, যা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন’ (আইসিপিডি) এর ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবা প্রত্যেক নারীর আইনগত ও মানবিক অধিকার; এটি কোনো সুবিধা অথবা দয়া নয়।’ এই ঘোষণা নিশ্চয়ই নারীকে অনেকখানি শক্তিশালী করে তুলেছিল। তবে আমাদের দেশে আশির দশকের নারী উন্নয়নের সোপানে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার সিডও। যেখানে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের কথা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার জীবনধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা। রয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা অধিকার। কিন্তু নতুন করে ভাবাচ্ছে যে বিষয়টি, তা হলো প্রতিবন্ধী নারীরা এর কতটা জুড়ে রয়েছে।
২০০৬-এ জাতিসংঘ আয়োজিত ‘প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারবিষয়ক সম্মেলন’-এর ঘোষণাপত্রের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী মানুষেরও রয়েছে অ-প্রতিবন্ধী মানুষের মতোই একই রকম যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার। বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদে অনুসমর্থন করে।
এই সনদের নারীসংক্রান্ত ধারায় প্রতিবন্ধী নারীদের মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই সনদের গৃহ ও পরিবারসংক্রান্ত ধারা ২৩-এ বিয়ে, পরিবার, পিতৃত্ব, মাতৃত্ব বিষয়ে জোর দিয়ে তাদের পরিবার গঠনের অধিকারকে স¦ীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সন্তান সংখ্যা ও জন্মবিরতি নির্ধারণ, বয়স অনুযায়ী প্রজনন ও পরিবার পরিকল্পনাসংক্রান্ত তথ্য ও শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজনন উর্বরতা বজায় রাখা নিশ্চিত করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সিআরপিডির স¦াস্থ্যসংক্রান্ত ধারা ২৫-এর উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য কর্মসূচি গ্রহণ করার তাগিদ দিয়ে বলা হচ্ছে, প্রতিবন্ধী নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যএবং জনস্বাস্থ্য এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গ্রামীণ এলাকাসহ সেবাগ্রহীতার নিজ এলাকাতেই এই স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ব্যবস্থাসহ পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে হবে। এতে সহযোগিতা করবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহ।
নীতিমালা বন্দী লাল ফিতায়
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৫-এর একটি ডিসঅ্যাবিলিটি ইন বাংলাদেশ; প্রিভিল্যান্স এন্ড প্যাটার্ন শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের পরিবার গঠন প্রক্রিয়া দুভাবে নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। এক. প্রতিবন্ধী মানুষের বিয়ের চেয়ে বিচ্ছেদের হার বেশি। দুই. সমাজের ধারণা প্রতিবন্ধী মানুষের বিয়ের প্রয়োজনীয়তা নেই। একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী নারীদের তুলনায় প্রতিবন্ধী পুরুষেরা বৈবাহিক জীবনে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন কম হয়। আবার তুলনামূলক প্রতিবন্ধী নারীদের বিয়ের হার কম হলেও প্রতিবন্ধী পুরুষদের তুলনায় তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি।
বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১১-এর ৩৯ নম্বর ধারায় প্রতিবন্ধী নারীদের একীভূত হবার বিষয়ে খানিকটা উল্লেখ থাকলেও, কোথাও নেই তাদের পরিবার গঠনসহ প্রজনন স¦াস্থ্য অধিকারের বিষয়টি।
স্বাস্থ্য নীতিমালা, ২০১১তেও প্রতিবন্ধী নারীদের এ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়নি। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারসংক্রান্ত ধারা ১৬ তে প্রতিবন্ধী মানুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠনসহ সন্তান বা পরিবারের সঙ্গে সমাজে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। যদিও প্রতিবন্ধী নারীর মাসিককালীন পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্যঅধিকার এখানেও উপেক্ষিত। এমনকি জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য খাত বঞ্চিত। ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ের (আইসিডিডিআরবি, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ, পলিসি সাপোর্ট ইউনিট) পরিচালিত হাইজিন বেজলাইন সার্ভেতেও প্রতিবন্ধী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অনেক কিছু রয়েছে না থাকার সমানই। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও প্রতিবন্ধী নারীদের স¦াস্থ্যবিধি নিয়ে দারুণ কাজ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি কত দূর এগিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তবতা হলো প্রতিবন্ধী নারীরা আমাদের দেশে উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত!
প্রতিবন্ধী নারীর মাসিক ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক কুসংস্কার
অ-প্রতিবন্ধী কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন নানা রকমের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় কৌতূহল মেটাতে পরিবার তথা মা, বোন, বান্ধবী বা শিক্ষিকার সাহায্য পেলেও প্রতিবন্ধী কিশোরীরা এ ধরনের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়। পরিবার কর্তৃক মৌখিক দুর্ব্যবহার, শারীরিক আঘাত এমনকি যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাও তুলনামূলক অনেক বেশি ঘটে প্রতিবন্ধী কিশোরীদের সঙ্গে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতিবন্ধী কিশোরী বা নারীদের এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেশির ভাগই নথিভুক্ত হয় না। ফলে নারী-নির্যাতন বিষয়ে যে তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই, সহজেই অনুমেয় প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীদের সংখ্যা সেখানে অধিকাংশই অনুপস্থিত।
প্রথমত প্রতিবন্ধী নারীর মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের দেশে রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা। উদাহরণস্বারূপ, প্রতিবন্ধী নারীর নিয়মিত মাসিক নিয়ে সমাজে যেমন রয়েছে অপার বিস্ময়, তেমনি তারা মাসিককালীন নিজের পরিচর্যা নিজে করতে সক্ষম, তা বিশ্বাস করতে পারে না অনেকেই। তার চেয়েও ভয়ংকর যে ধারণা পরিবার তথা সমাজ প্রতিবন্ধী কন্যাশিশুর মনে ছোটবেলাতেই গেঁথে দেয় তা হলো, তার কখনো বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী নারীদের নারী বা মানুষ বলেই গণ্য করে না কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের একটি অংশ। কন্যা যদি হয় গুরুতর মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাহলে তারা হয়ে ওঠে আরও নির্মম। তার সামনেই আলোচনা চলে, স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা স্টেরিলাইজেশন করে মাসিক নিয়ন্ত্রণের জন্য। গুরুতর প্রতিবন্ধী নারীরা যাদেরকে নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো নিজে করতে অপরের সহযোগিতা নিতে হয় বা যাদের দুহাত নেই তাদের অনেক সময় তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। অভিভাবকের বিরক্তি বা অনেক সময় সাহায্যকারী পাশে না থাকলে, নিয়ম অনুযায়ী ছয় ঘণ্টা পরপর ন্যাপকিন পরিবর্তন করা হয়ে ওঠে না তাদের। ফলে ঘা, ইনফেকশন, অ্যালার্জি ইত্যাদি তাদের নৈমিত্তিক একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
অথচ নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সঠিক মাসিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক পদ্ধতি মেনে না চলা, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির ফলে ইনফেকশেন জটিলতা এবং পরবর্তীকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ততার মুখেও পড়তে পারে। এ বিষয়ে প্রতিবন্ধী নারীদের পরিবারে সচেতনতা এবং গুরুত্ব কোনোটিই নেই। নির্মম হলেও সত্য, এ দেশের অধিকাংশ পরিবারের প্রতিবন্ধী নারীরা এই বাস্তবতায় মুখ বুজে দিন কাটাচ্ছেন।
এখনো ভুক্তভোগী প্রতিবন্ধী নারী যারা নিয়মিত কর্মস্থলে যান বা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন:
- বস্তুগত যানবাহন, সিঁড়ি, সরু করিডোর, রোগীদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ার, শারীরিক পরীক্ষার উঁচু বিছানা, প্রবেশগম্য টয়লেটের অপ্রতুলতা ইত্যাদি।
- মানসিকতা প্রতিবন্ধী নারী রোগীর কাছে তার জীবনটাই গুরুত্বহীন, এমন নেতিবাচক ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক চিকিৎসক রোগের মূল কারণ নির্ণয় বা পূর্ণ চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেমন মনোযোগী বা যতœবান হন না। প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবাদানকারী অনেকেরই এমন মন্তব্য থাকে, ‘প্রতিবন্ধী নারীর আবার প্রজনন স্বাস্থ্য কী!’
- নীতিগত: প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সহায়ক চিকিৎসা নীতিমালার অভাব চিকিৎসাসেবীদের অমনোযোগিতা বা নেতিবাচক মনোভাবের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ বলে মনে করা হয়। একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা বস্তুগত সমস্যার বিষয়েও আলোকপাত করে বা সমাধানের প্রস্তাব দেয়।
সচেতনতা ও করণীয়
প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী তাদের চাহিদাও ভিন্ন। কিন্তু এ কথা সত্য যে, একজন অ-প্রতিবন্ধী নারীর জন্য এই সময়টিতে যা যা করণীয়; স্যানিটারি ন্যাপকিন বা কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করলে, নির্দিষ্ট সময় পরপর তা বদলানো ও পরিষ্কার করা, শুকানো বা ডিসপোজ করা ইত্যাদি প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। আবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী বা অটিস্টিক নারীদের জন্য এ ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মাবলি শেখাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আবার হতে পারে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারীসহ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী, অটিস্টিক নারী এবং পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিককালীন পরিচর্যায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের চেয়ে টেম্পুন বা কাপ হতে পারে সহজ পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের দেশে এসব এখনো সহজলভ্য হয়নি। অল্প কিছু জায়গায় পাওয়া গেলেও উচ্চ মূল্যের কারণে বেশির ভাগের নাগালের বাইরে থেকে যায় এসব পণ্য। এমন আরও নানা পদ্ধতি রয়েছে, যা প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য দেশে সহজলভ্য ও হাতের নাগালে আনা দরকার।
চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী মাসিককালীন পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় করণীয় পদ্ধতিগুলো আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গবেষণার দাবি রাখে। এ নিয়ে যেমন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ দরকার, তেমনি প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষাতেও সচেতনতা বৃদ্ধিসহ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধী নারীদের, বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে প্রজনন এবং মাসিকসংক্রান্ত সেবা দেওয়া এবং মাসিকের জন্য স্যানিটারি প্যাড ত্রাণ হিসেবে সরবরাহ করা যেতে পারে। সরকারের স্বাস্থ্য নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ছয় হাজার জনের জন্য সারা দেশে অসংখ্য স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই প্রতিবন্ধী মানুষের বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে নয়।
যদিও সর্বশেষ ২০১১ সালে প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির ১৫টির মধ্যে ১৩তম উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা’ হবে কিন্তু এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা প্রদান করা হয়নি। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী নারী-সহায়ক সেবার কোনো ব্যবস্থাও নেই। এই নীতিমালার কর্মকৌশলে ৩১ নম্বর অনুযায়ী মনোসামাজিকসহ অন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি সাধনে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলা হয়েছে; এমন উদ্যোগ আলোর মুখ দেখুক এটাই প্রত্যাশা।
আমরা এমনটি বলতে চাই না যে প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা কেবল সরকারেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের সকলকে; আপনাকে, আমাকেও এগিয়ে আসতে হবে।
প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুধী সমাজের কাছে আমাদের কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি:
১. বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী নারীদের চাহিদার ভিত্তিতে তাদের মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জাতীয় পর্যায়ে জরিপ পরিচালনাসহ গবেষণা কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া
২. প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সংবেদনশীল বিষয়গুলো স¦াস্থ্য নীতি’র অন্তর্ভুক্তি ও তার বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করা; নির্দিষ্ট সময় পরপর সেবার মান পর্যালোচনা করা
৩. জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধী নারীর হাইজিন ও প্রজনন স¦াস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা
৪. নারী উন্নয়ন নীতিমালার অধীনে তৈরি কর্মপরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনকে সম্পৃক্ত করে কাজ করা
৫. অ-প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রস্তাবিত প্রকল্প বা কর্মসূচি প্রতিবন্ধী নারীবান্ধব করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা
৬. অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী এবং মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ
৭. ভবঘুরে বা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য করণীয় নির্ধারণ
৮. উপজেলা, জেলা সদর, মাতৃসদন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ‘স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা’ বিভাগে প্রতিবন্ধী নারী ও কিশোরীদের জন্য প্রতিবন্ধী নারী সহায়ক কর্নার রাখা এবং প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া
৯. দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী নারীর হাইজিন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্তত একজন করে কর্মী নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ এবং তাদের কাজ সুষ্ঠুভাবে পর্যবেক্ষণ করা (এ ক্ষেত্রে শুধু ডাক্তার বা নার্স নয়, বরং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বস্তরের কর্মচারীদের এমনকি হুইলচেয়ার বা স্ট্রেচার বহনকারী, ল্যাব টেকনিশিয়ান ইত্যাদি প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে)
১০. ধর্ষণ-পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধী নারীদের সেবা ও তাদের প্রতি হয়ে যাওয়া বৈষম্য রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ
১১. প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য, প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজে গণমাধ্যমের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
১২. তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিবন্ধী নারী’র ‘সাহায্যকারী’ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অধিগ্রহণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা
১৩. প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো যতখানি সম্ভব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করে তোলা এবং প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য উপযোগী যানবাহনের ব্যবস্থা করা।
২৮ মে, ২০১৬ বিশ্ব মাসিক পরিচর্যা দিবস উপলক্ষ্যে বি-স্ক্যান আয়োজিত ‘প্রতিবন্ধী নারীর মাসিককালীন পরিচর্যা এবং প্রজনন স¦াস্থ্য; ব্যবস্থা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় পঠিত মূল প্রবন্ধ। কৃতজ্ঞতা স্বীকার ডা. সেলিনা ফেরদৌস ও রোকেয়া সামিয়া এবং কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি ডেভেলপমেন্ট (সিডব্লিউএফডি), প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, সাজিদা ফাউন্ডেশন, ওয়াটারএইড এবং ওয়াশ অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ।