বিশেষ প্রতিবেদন
বিশেষ শিক্ষা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একীভূত শিক্ষার উপযোগী করতে এবং সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই; বরং বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও ব্যবস্থাপক নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বঞ্চিত করছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এই অভিযোগ অভিভাবকদের। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর শিক্ষাবিষয়ক নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সাধারণ বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপযোগী করে তৈরি করবে বিশেষ শিক্ষা বিদ্যালয়। কিন্তু বিশেষ বিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে তেমন পদক্ষেপ নেয় না; বরং এই শিক্ষার্থীদের সাধারণ বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রচেষ্টাকেও ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয় না।
চট্টগ্রাম ওয়্যারলেস ঝাউতলা কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলামের জন্য ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। শহিদুল ইসলামের অভিভাবক জানান, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য সাধারণ বিদ্যালয়ের উপযোগী করে পরীক্ষা দেওয়ানো অতটা সহজ নয়। তবে চেষ্টা করলে অসম্ভব নয়। তবে সবার সহযোগিতা পাওয়া দুস্কর। বিশেষত বিশেষায়িত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যারা প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ের ধাপগুলোতে এই শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য তৈরি করবেন তাদের ইতিবাচক সহযোগিতা দরকার আমাদের।
অপরাজেয়র সঙ্গে আলাপচারিতায় সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তির্ণ হওয়ার পেছনের সত্যকথন জানালেন আরেক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবক। এই অভিভাবক জানান প্রথমবারের মতো কোন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়ের সাধারণ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথের শুরুটা একপ্রকার অসম্ভবই ছিলো।
চন্দনাইশ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সেলিনা আক্তার রওশন চৌধুরী জানান, তার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে দিলরুবা চৌধুরী পাহাড়তলী টিকিট প্রিন্টিং প্রেস কলোনি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে মাধ্যমিকের মানবিক বিভাগের পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে ৩.৭৫ ফল লাভ করে।
তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে সুইড বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিদ্যালয়ে পড়ত দিলরুবা। প্রথম দিকে তার মেয়ের থেরাপি ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিকাশে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল এই বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় থেকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের থেরাপি ও প্রাক-প্রাথমিক শেষে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর বুদ্ধির স্তর অনুযায়ী নানা ধরনের কারিগরি শিক্ষা এবং সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুত করার কথা রয়েছে বলে দিলরুবার মা জানান। এদিকে তার মেয়ের শিক্ষার বিকাশ ও পড়ালেখার প্রতি অদম্য আগ্রহ ও মেধা লক্ষ করে ২০০৮ সালে তিনি দিলরুবাকে সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই আগ্রহ প্রকাশের পর থেকেই এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীম আহমেদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন তিনি।
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পক্ষে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ সম্ভব নয় এই বলে শামীম আহমেদ তাকে বাধা দেন। শামীম আহমেদ সে সময় মন্তব্য করেছিলেন, দিলরুবার বুদ্ধির বিকাশ ঠিকভাবে হয়নি। তার পক্ষে সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়া এবং একা কোনো কিছুই করা অসম্ভব। কিন্তু এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য দিলরুবার একেবারেই পছন্দ ছিল না বলে জানান তার মা। সে প্রায়ই বিদ্যালয় থেকে ফিরে অভিযোগ করত, এখানে সে পড়বে না। মেয়ের জেদের কারণেই তাকে বিশেষ বিদ্যালয়ের পরিবর্তে সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তির সিদ্ধান্তে অটল থাকেন সেলিনা আক্তার। কিন্তু এরপর থেকে শামীম আহমেদ নানাভাবে তাকে ও তার মেয়েকে হেয় করতে শুরু করলেন। ছোটখাটো কারণে দিলরুবাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এ প্রসঙ্গে সেলিনা আক্তার বলেন, এত কিছু ঘটেছে সে সময়, তা ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না। সে সময় শামীম আহমেদ তার নিজস¦ তালিকাভুক্ত একই শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতে পাঠাতেন। এ নিয়ে কয়েকজন অভিভাবক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া আয়োজনগুলোতে এই বিদ্যালয়ের অন্যান্য বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার অনুরোধ জানালে তিনি রেগে যান। অভিভাবকেরা এর প্রতিবাদ করলে দিলরুবাসহ তৌহিদুল হাসান তুষার, দিলশাদ, দীপন, রুবেল নামের পাঁচজন শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেন শামীম আহমেদ। এই প্রতিবেদকের সামনে পাঁচ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর অভিভাবক আক্ষেপের সুরে বলে ওঠেন, তাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এই শিশুরা কোনো অন্যায় করেনি, তাহলে তাদের কেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলো? তারা দুঃখ করে বলেন, শামীম আহমেদের এই সেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আড়ালে অন্য অভিভাবকেরা অনেক মন্তব্যই করে, কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সবাই ভয় পায়।
সেলিনা আক্তার বলেন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো এত সহজ কাজ নয়। সুইড থেকে বহিষ্কৃত অপর চার শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা তাদের সস্তানদের আর কোথায় ভর্তি করাতে পারেননি। আমি দিলরুবাকে নিয়ে বিভিন্ন সাধারণ বিদ্যালয়গুলোতে অনেক ঘুরেছি। প্রতি পদক্ষেপে নানা বাধা ডিঙিয়ে ২০০৯ সালে সাধারণ বিদ্যালয়ে মেয়েকে ভর্তি করানোর পর যেন এক যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হলাম আমি। কারও সহযোগিতা পাচ্ছিলাম না। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, বেশ কয়েকজন অভিভাবককে অনুরোধ করেছিলাম সম্মিলিতভাবে নিজেদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানদের সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য। কিন্তু প্রথাগত নিয়মের বাইরে পা ফেলতে কেউ সাহস করেননি।
একপর্যায়ে সেলিনা আক্তার তৃপ্তির সঙ্গেই বলে ওঠেন, সংগ্রাম দীর্ঘ হলেও আমার বড় প্রাপ্তি হলো দিলরুবার একাগ্র প্রচেষ্টা প্রমাণ করেছে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা-পরবর্তী সুযোগ ও পরিবেশ পেলে সবার সঙ্গেই সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তবে এও সত্য, ক্ষমতাসীনদের নিয়মের বিরুদ্ধে একাকী এ ধরনের লড়াই বাস্তবে অনেক যন্ত্রণাদায়ক। আবার সম্মিলিত শক্তি হলে কোনো বাধাই অসম্ভব নয়।
এদিকে সুইড বাংলাদেশের মহাসচিব জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন একীভূত শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক, ডাউনসিনড্রোম বা স্নায়বিক সমস্যাজনিত শিশুরা অন্যদের মতো দ্রুত শিখতে পারে না। সে ক্ষেত্রে সাধারণ বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের অধীনে অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের আমাদের নেই। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এই পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও বলেন, সরকারের পিইডিপি-২ ও পিইডিপি-৩ প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এই চাহিদা পূরণ হতে পারে। তা ছাড়া জেলা ও উপজেলা বিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত পদ্ধতির মতো রিসোর্স শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে পাইলট প্রকল্প চালু করার পরামর্শও দেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের বিষয়ে কর্মরত একজন উন্নয়নকর্মীর মতে, জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার প্রণীত সনদ সিআরপিডি মানলে বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনই থাকে না। যা দরকার তা হচ্ছে প্রাক-শিক্ষা এবং এটিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হওয়া উচিত। তিনি প্রশ্ন রাখেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যদি অটিস্টিক শিশুদের জন্য বড় আকারের প্রকল্প হাতে নিয়ে তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষা কেন বিশেষ ব্যবস্থার নামে আলাদা থাকবে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে, অন্যদিকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। অন্যদিকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সমন্বিত বিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস তৈরি হলেও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এ ক্ষেত্রে একেবারেই বঞ্চিত।
উল্লেখ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অটিস্টিক শিশুদের জন্য ন্যাশনাল একাডেমি অব অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছে। উচ্চমাধ্যমিক অধিদফতরের এই কার্যক্রম প্রকল্পের আওতায় উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ এবং টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকদের মধ্য থেকে মাস্টার ট্রেইনার এবং ট্রেইনার নিয়োগের জন্য প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে এম জাকির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূল নির্দেশনা আসতে হবে মন্ত্রী এবং সচিব পর্যায় থেকে।’
এদিকে তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশজুড়ে বিশেষায়িত শিক্ষা কার্যক্রমের নামে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোর কোনোটি চলছে শিক্ষকবিহীন। কোনোটিতে গুটিকয়েক শিক্ষক নিয়োগ থাকলেও শিক্ষার্থীদের প্রতি তারা যত্নশীল নন। আবার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। এসব অভিযোগ উক্ত বিদ্যালয়গুলোর অভিভাবকদের। তাদের বেশির ভাগেরই মন্তব্য, সিআরপিডির আলোকে প্রণীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩তেও একীভূত শিক্ষা অধিকার বিষয়ে একইভাবে জোর দেওয়া হলেও দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত আইন এবং আন্তর্জাতিক সনদ ও নির্দেশনাসমূহ।