আমরা সাধারণ মানুষেরা অনেক সময় অনেক কাজই করে যাই, কিন্তু সেসবের মৌলিক বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিতে পারি না বা সঠিক পথের দিশা পাই না। যা আবার রাজনীতিবিদরা দারুণ ভালোভাবেই বোঝেন। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক গ্রহণযোগ্যতা ও দিকনির্দেশনা দিতে তারা যেমন কুণ্ঠাবোধ করেন না, ঠিক তেমনি সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা সব সময়েই তাদের পেছনে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করেন না। যেমন একসময়ে বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন দেশের অগুনতি বাঙালি জনতা। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার বক্তব্য সেই কথাই মনে করিয়ে দেয় আমাদের। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে নেমে পড়ার উদ্দীপনা জোগায়। তিনি তার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবেই প্রতিবন্ধী মানুষের প্রাণের দাবির পক্ষে মত দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়নের গড়িমসির জন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ফলক উন্মোচনের তিন বছর পরেও কেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আজও অধিদফতরে রূপান্তর হয়নি’ এমন প্রশ্ন রেখে ডেপুটি স্পিকার তার বক্তব্যে আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও এর অগ্রগতি না হওয়ার কারণ আমার বোধগম্য নয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, তাহলে কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে গেছে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিদফতর? আমরা কি পাকিস্তানি আমলের আমলাতান্ত্রিক সেই ভূতের মধ্যে রয়েছি? (২০১৬ সালের দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে রবীন্দ্রসরোবরে জাতীয় ডিপিও নেটওয়ার্ক পিএনএসপির উদ্যোগে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষমতায়নে চাই প্রতিনিধিত্ব’ শীর্ষক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। খবরটি অপরাজেয়-এর ডিসেম্বর, ২০১৬ সংখ্যাসহ দেশের জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়।)
এ দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনযাত্রা কতটা অপ্রতিবন্ধী মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা ডেপুটি স্পিকারের বক্তব্যে বোঝা যায়। আমরা যদি আজ প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে উন্নয়নকে পরিমাপ করতে বসি, তাহলে প্রকটভাবেই চোখে পড়বে এই খাতে সব কলকাঠি নাড়ছে অপ্রতিবন্ধী মানুষ। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কর্মরত এনজিও নামধারী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্ষমতার বলয়ে থেকে প্রতিবন্ধী মানুষের সব সুযোগসুবিধা তারাই ভোগ করছে। দীর্ঘকাল অবধি এ-ই চলছে প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে। আর ক্ষমতাহীন প্রতিবন্ধী মানুষেরা এবং তাদের সংগঠন (ডিপিও) সমূহ এর মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে বারেবারে।
আমরা যদি নারী আন্দোলনের সফলতার দিকে আলোকপাত করি, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর যেমন শুধু নারী সংগঠনগুলো এবং নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে, তেমনি প্রতিবন্ধী মানুষের স্বতন্ত্র এই অধিদফতর হলে সরাসরি সব সুযোগ-সুবিধা পাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহ। নারীদের মতোই আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করে মূল স্রোতোধারায় সম্পৃক্ত করবে এই অধিদফতর।
এই অবস্থায় আমাদের করণীয় নির্ধারণে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসে গেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলো কি এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নিয়ন্ত্রণ নেবে না? দীর্ঘকাল তো অপ্রতিবন্ধী মানুষের হাত ধরে চলা হলো, এবার সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়াবার। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অধিদফতর উদ্বোধনের তিন বছর পেরিয়ে এসে অবিলম্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়ন এবং এর কার্যক্রম শুরু করার দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের আন্দোলনে নামা দরকার। প্রতিবন্ধী মানুষের কণ্ঠস্বর অপরাজেয় আহ্বান জানাচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলো এবং প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি, আসুন আমরা প্রতিবন্ধী মানুষের স্বার্থ সুরক্ষার এই দাবিতে একাত্ম হই।
‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’-এর পরিবর্তে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস’
আমাদের সমাজে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ ও সম-অধিকারের লক্ষ্যে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবস। জাতিসংঘ প্রতিবছর এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯২ সালে। এর আগে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ সাল অবধি প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদার দশক পালন করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯২-এর ১৪ অক্টোবর এটি শেষ হয়ে এলে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ৩ ডিসেম্বরকে ইন্টারন্যাশনাল ডিসঅ্যাবিলিটি ডে বা ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ ঘোষণা দেওয়া হয় এবং একই বছর থেকে প্রতিবছর এ দিবস পালন শুরু হয়।
জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদের চেতনাকে ধারণ এবং এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদা রক্ষায় ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের অপর এক অধিবেশনে ইন্টারন্যাশনাল ডে অব পারসনস উইথ ডিসঅ্যাবিলিটিজ এই নতুন নামটি স্বীকৃতি পায়। যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস’। ৯ বছর ধরে (৩ ডিসেম্বর, ২০০৮) এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষকে মানুষের মর্যাদায় সম্মানিত করা হলেও আজও সরকারিভাবে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য মেলেনি ব্যক্তি মর্যাদার এই স্বীকৃতি। সেই পুরোনো ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ নামেই জাতীয় পর্যায়ে পালিত হয় দিনটি। সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ নামেই মহাসমারোহে দিনটি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পালিত হয়। ‘প্রতিবন্ধী দিবস’ কি মানুষের নাকি প্রতিবন্ধী পশুপাখিদের জন্য পালন করা হয়, তা আমাদের বোধগম্য নয়! এই দিবস উপলক্ষে সরকার সপ্তাহব্যাপী যে মেলার আয়োজন করে, তার নাম ‘প্রতিবন্ধিতা উত্তরণ মেলা’। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধিতা কীভাবে উত্তরণ করা হয়, তা-ও আমাদের জানা নেই!
প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে সোচ্চার হয়ে আমরা যদি ব্যক্তিকে বা মানুষটিকে প্রাধান্য দিতে না পারি, তাহলে সিআরপিডির মূলনীতি ও অভীষ্ট লক্ষ্য তাতে সরাসরি লঙ্ঘিত হয়। দুটি বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যাচ্ছে; প্রথমত সিআরপিডিতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিবন্ধী মানুষকে মানববৈচিত্র্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত ব্যক্তির প্রতি চিরন্তন মর্যাদা, সম-অধিকার, স্বীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণসহ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সিআরপিডিতে।
যদিও এ দেশে এখনো আমাদের অসুস্থ, রোগী এবং অক্ষম মনে করে, কীভাবে কল্যাণ করা যায় সে উপায় ভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং এর ফলে আমাদের মানববৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি স¤পূর্ণ অস্বীকার করে চলেছে প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ক্ষমতাধর সরকারি ও বেসরকারি কাঠামোগুলো। সিআরপিডির চেতনা ও মর্যাদার বিষয়ে আমাদের আইনে উল্লেখ থাকলেও দিবসের নাম পরিবর্তনে নেতাদের ভূমিকা দেখা যায়নি তেমন। এ দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদার বিষয়ে ভাববার অবসর নেতাদের রয়েছে কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তবু প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, আগামী দিবস পালনের আগে প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস’ এই নামকরণে দিবস পালনের উদ্যোগ নেবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।