ইফতেখার মাহমুদ
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ফেসবুকের যুগে জন্মাননি। তাই তিনি ‘আকাশের ঠিকানায়’ চিঠি লেখার কথা বলে গিয়েছেন। কিন্তু এই যুগে আমার মতো সাধারণ মানুষও জানে,তার মনের কথা বলার স্থান হলো সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুক।
যে দেশ আমাদের নিয়ে ভাবে না, সে দেশকে নিয়ে আমরাও আজ ভাবতে পারি না। সম্ভবত এমন দেশে ঘরে বসেই বাঁচা যায়। সরকারও তাই ভাবে বোধ হয়! নতুবা স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেদের স্বাধীনতা খুঁজে পাই না কেন? আমাদের নাগরিক অধিকারে খোঁজ করা আর খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাই না আমি।
আমার মতো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ ঢাকা শহরের প্রতিদিন গড়ে ৫০ কিলোমিটার পথ পরিক্রম করতে হলে কী পরিমাণে দুর্ভোগ ও কষ্টে তাকে পড়তে হয়,তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানার কথা নয় (সাধারণত বাস ও পায়ে হাঁটা, নিতান্তই বাধ্য হলে রিকশা বা সিএনজি নেই)। আমার আবাস ঢাকা শহরের উত্তরে, বিমানবন্দরের উল্টো দিকে দক্ষিণখান নামক এক অজপাড়া গ্রামে। না,শুনে হাসবেন না। যদি বিশ্বাস না হয় একবার এসে সরেজমিনে দেখে যাবেন। প্রসূতি নারীর ডেলিভারি ডেট কাছে থাকলে আর হাসপাতাল যেতে হবে না, এ রাস্তাই যথেষ্ট। রাজপথ এয়ারপোর্ট রোডের কথা বলাই বাহুল্য। বিদেশিরা বেরিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে যান। তাই উত্তর দিকের রাস্তার অবস্থা গুরুতর হলেও অসুবিধা নেই। আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কারণ তিনি এমন গাড়িতে চড়েন যা ঝাঁকুনি প্রুফ, আবার সাইডগ্লাস রঙিন তাই তার দৃষ্টি কেবল নাক বরাবর যায়। নতুবা হয়তো দেশের উন্নয়নে অতিশয় ব্যস্ত থাকার কারণে গাড়িতে বসেও দু’দ- অবসর নেই নেত্রীর। তাই ব্যস্ততম সময় কাটানোর দরুন দেখতে পান না তিনি। অবশ্য এমনও হতে পারে, তিনি যে রাস্তা দিয়েই যান না কেন, রাতরাতি তা পরিষ্কার, ঝকঝকে ও নতুন হয়ে গেলেও পাশের গলিগুলো আগের মতোই থাকে। তাই এমন ভাবনা আমার।
আর বাসের কথা কী বলব। ঢাকা শহরের আপামর সাধারণ মানুষ মাত্রই জানেন আমরা যে কয়েকটি শ্রেণির পেশাজীবীদের কাছে জিম্মি, তার মধ্যে বাসমালিক ও শ্রমিক উল্লেখযোগ্য। আগে তো কিছু কাউন্টার সার্ভিস ছিল। টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেই চলত, অটোমেটিক্যালি বাসে চড়ে যেতাম। এখন উসাইন বোল্টের বাংলাদেশ সংস্করণ না হলে বাসে ওঠার শক্তিই পাবেন না আপনি। তার ওপর দৃশ্যমান প্রতিবন্ধী মানুষ হলে তো কথাই নেই। আমাকে দেখলেই বাস ড্রাইভারদের গাড়ি চালানোর জোশ বেড়ে যায়। আবার আমাকে রাস্তা পার হতে দেখলেই ট্রাফিক পুলিশরা সিগন্যাল ছেড়ে দিয়ে আমাকে ভিরমি খাইয়ে দিতে ভালোবাসেন। কারণ, আমি তাদের প্রিয় কুটুম্ব কিনা!
আগে যখন দেখতাম বাসশ্রমিকদের কলেজ ছাত্ররা বেধড়ক পেটাচ্ছে,তখন খারাপ লাগত। কিন্তু এখন বুঝি তা আসলে জোটবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। আমরা বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষেরা কখনো রাস্তা অবরোধ করেছি কি না জানা নেই। ভাঙচুর দূরের কথা। এমনকি নিজের দাবি তুলে ধরতে দুই ঘণ্টার জন্য রোদে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করার প্রস্তুতি বা সাহস কোনোটা নেই আমাদের বেশির ভাগের। আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা অথর্ব,অসহায়; তাই বেশির ভাগ ঘরে বসে থাকি। যারা বের হই তারা মেরুদ-হীন নির্বোধ প্রাণীর মতো এই নিদারুণ যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করি। কারণ, পরিবর্তনের তাড়না আমাদের মাঝে নেই। অথবা নতুনকে স্বাগত জানাতে যে ত্যাগ স্বীকার বা পরিশ্রম করতে হবে, তা দেওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই। আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা অলস অথবা দেশকে,রাষ্ট্রকে ও সমাজকে আমাদের কথা ভাবাবার, আমাদের প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য করার মতো ক্ষমতা নেই আমাদের।
তাই আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা কেবল এনজিওবাজি করে মরি, দুই ধরনের পেট ভরে তো দশজনের মেরুদন্ড ভাঙে। কারণ এসি রুমে বসে আলোচনা,তারপর পেটপুরে খাওয়া আর গাড়িভাড়া নিয়ে বাড়ি ফেরাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। আবার কেউ কেউ খেলায় এমন মেতেছেন যেন এটিই প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনের একমাত্র মুক্তির পথ। তাই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছি খেলোয়াড়ের তালিকায় নাম লেখাতে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন দেখলেও প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার আন্দোলনে কোনো সামাজিক আন্দোলনের আভাস পর্যন্ত মেলেনি। ঘুমন্ত জাতিকে বঙ্গবন্ধু যেন জাদুর কাঠিতে ঢাল-তলোয়াড় ছাড়াই লড়াকু বানিয়ে ফেলেছিলেন, আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষদের মধ্যে এমন কেউ নেই। কারণ, আমাদের মাঝে বঙ্গবন্ধু বানাতে কোনো সোহরাওয়ার্দী বা শেরেবাংলা নেই।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ছায়ানট, কচি-কাঁচার আসর, খেলাঘর, উদীচী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নিজেরা করিসহ অনেক গণসংগঠনকে জানি যারা সাধারণ কোনো এনজিও নয়। তারা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন করে দেশের মনন-মেধা, চিন্তা-চেতনা, জাতি হিসেবে আমাদের পরিচিতি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সামনে এগিয়ে নিতে নিরলস ভূমিকা পালন করে চলেছে। তারা ফান্ডমুখী নয়। তাদের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য পূরণে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ একটু একটু কন্ট্রিবিউট করে এই সংগঠনগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে। তাই এগুলো সামাজিক সংগঠন। আর যারা বিদেশি দানের ওপর মুখাপেক্ষী তারা এনজিও।
এমন একটি সংগঠনের স্বপ্ন থেকেই পিএনএসপি চার বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে নতুন নতুন চিন্তার খোরাক পাই, পাই প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির দিশা, পাই স্বাধীনভাবে চলার অনুপ্রেরণা। এখানে চলে তর্কবিতর্ক, এখানে চলে আড্ডা, এখানে চলে প্রতিবন্ধী মানুষদের আদর্শ মডেল রূপে গড়ার নিরন্তর প্রয়াস। এখানে বসে মেলা- চিন্তার, প্রতিবন্ধী মানুষদের পণ্যের,গানের, সৃষ্টির। একে ঘিরে দেখি স্বপ্ন হাজার।
প্রতিবন্ধী মানুষেরা কমিউনিটি ফিলিংস নিয়ে এখানে তিল তিল করে গড়বে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির মন্ত্র। চার বছর ধরে এর খরচ চালাচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষ, তাদের অভিভাবক, প্রতিবন্ধী মানুষদের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে আগ্রহী সহযোদ্ধারা এবং আমার গুরু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আন্দোলনের নেতা রফিক জামান ভাই। এই নিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া। এই নিয়ে আমাদের স্বপ্ন বোনা।
আজ আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অধিকার সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু আমাদের মধ্যে এই সচেতনতা তৈরি করার মতো কঠিন কাজটি কিন্তু এখন আর করতে হয় না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টিকে একসময় মেডিকেল অ্যাপ্রোচ হিসেবে দেখা হতো কিন্তু আজ তা পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও তাদের অধিকার সহজেই পায়নি, আজও অপ্রতিবন্ধী মানুষদের অনেক জনগোষ্ঠী অবহেলিত এবং নিগৃহীত। গণতান্ত্রিক দেশ এটা। আর গণতন্ত্রের মূল কথা সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পেরেছি? মতামতের ঐক্য আমাদের মাঝে কতটুকু? শরীরের কোনো অংশে ঘা হলে আমরা কি সেই অংশ কেটে ফেলে দিই, নাকি ওষুধ প্রয়োগ করে তা নির্মূলের চেষ্টা করি?
রবিঠাকুরের ভাষায়, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ বলতে চাই না; বরং আমরা বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভাষায় বলতে চাই, ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরনী তল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল, চল রে চল রে চল’। তাই সবাইকে এই সামাজিক আন্দোলনের অংশীদার হতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।