অপরাজেয় প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) সহকারী জজ পরীক্ষায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুদীপ দাসকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। বিজেএসসির দাবি, কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জুডিশিয়াল পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম নেই।
সুদীপ দাসের শ্রুতলেখকের আবেদন নাকচ করে দেয় বিজেএসসি কর্তৃপক্ষ। ফলে গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সহকারী জজ নিয়োগের নির্ধারিত পরীক্ষায় তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১ মার্চ ১৪৩টি পদের জন্য ১১তম বিজেএসসি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে সুদীপ অনলাইনে আবেদন করে পরীক্ষার প্রবেশপত্র হাতে পেলেও শ্রুতলেখকের আবেদন নাকচ করা হয় তার প্রতিবন্ধিতার অজুহাতে। এ নিয়ে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোতে সমালোচনার ঝড় উঠলেও আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন সুদীপ। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিচারিক কার্যক্রম চালাতে পারলে তার সঙ্গে কেন বৈষম্য করা হবে। তিনি আরও বলেন, আইন অনুসারে প্রতিবন্ধিতা আমার চলার পথে বাধা হতে পারে না। কারণ কর্মক্ষেত্রে কোনো রূপ বৈষম্য না করে আমাদের জন্য ‘সংগতিপূর্ণ বন্দোবস্ত’ বা Reasonable Accommodation নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে ২০১৪ সালে এলএলবি এবং ২০১৫ সালে এলএলএম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সুদীপ দাস। নিয়ম অনুযায়ী, গত ১৫ এপ্রিল বিজেএসসি পরীক্ষার জন্য অনলাইনে ফরম পূরণ করেন তিনি। এরপর সঠিক পদ্ধতিতে সামগ্রিক কাগজপত্র জমা দিয়ে শ্রুতলেখকের অনুমতির জন্য আবেদন করেন। প্রবেশপত্রও সংগ্রহ করেন তিনি। কিন্তু তার দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতার বিষয়ে জানতে পেরে বিজেএসসি জানায়, এ পরীক্ষায় সুদীপের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে।
এদিকে সুদীপ গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় এসে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করলেও কোনো লাভ হয়নি। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারভিত্তিক আইন এবং বিশ্বের অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিচারকদের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেন সুদীপ। এ সময় তাকে ২০০৭ সালের নিয়োগসংক্রান্ত বিধির ৩য় তফসিলের উদাহরণ এনে বলা হয়, বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিজেএসসি পরীক্ষা প্রদানে বিবেচ্য নয়। কয়েক বছর পূর্বে সোহেল নামের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আবেদন করলে তাকেও জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় অংশ নিতে অনুমতি দেওয়া হয়নি বলেও জানানো হয় সুদীপকে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস প্রবেশ পদে নিয়োগবিষয়ক আদেশের ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর কৃতকার্যদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে। সেখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যদি কাউকে শারীরিক বৈকল্য বলে প্রতিবেদন দেন, তবে তিনি নিয়োগের যোগ্য হবেন না।
বিষয়টি জানতে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ আশফাকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কমিশনের সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। সচিব পরেশ চন্দ্র শর্মা কমিশনের মুখপাত্র মোহাম্মদ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এই তিন কর্মকর্তাই বলেন, আইন অনুযায়ী তারা বিষয়টি দেখবেন। বিধির বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে বলা হয়, ‘একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কীভাবে বিচারক হবেন? বিচারকার্য পরিচালনা ও রায় লেখা এবং জমিসংক্রান্ত মামলায় দলিলাদি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সমর্থ হবেন না।’
সুদীপ এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এ আমাদের সরকারের অজ্ঞতা বা অবহেলা প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতি। কারণ, পাশের দেশ ভারতের তামিলনাড়– প্রদেশেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিচারিক কাজ করছেন। যদিও তাকেও নিজ অধিকারের জন্য লড়তে হয়েছে। আমিও লড়ব।’
অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবির বলেন, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষকে কোনো ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। আর শ্রুতলেখক পাওয়া তাদের অধিকার।
সুদীপ জানান, তিনি শিগগিরই তার এ বৈষম্যের বিচার চেয়ে মামলা করবেন। এ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, সোসাইটি অব দ্য ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজারস্ (এসডিএসএল) তাকে আইনি সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে।
এ বিষয়ে তিনি আরও জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি), চট্টগ্রামের ডিপিও নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে লেডিস ক্লাবে মতবিনিময়কালে বিজেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি বিরাজমান বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা তুলে ধরে। এ অবস্থায় বিজেএসসি কর্তৃপক্ষ তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধা দিলে প্রয়োজনে আইনি লড়াইয়ে যাবেন, তাই এ বিষয়ে পরামর্শ চান। এ সময় পিএনএসপির পরিচালক ও এসডিএসএলের কোষাধ্যক্ষ রফিক জামান এসডিএসএলের পক্ষ থেকে আইনগত সহায়তাসহ সব ধরনের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এই ধারাবাহিকতায় রফিক জামানের নির্দেশনায় সুদীপ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন করেন। পরে সুদীপ বিজেএসসি কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হলে তাকে ঢাকায় এনে শ্রুতলেখকের আবেদন করাসহ প্রধান প্রধান গণমাধ্যমের বিভিন্ন সংবাদকর্মীদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণ করে এসডিএসএল। শীর্ষ গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরও বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় বর্তমানে সুদীপের পক্ষে উচ্চ আদালতে মামলা করার জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনাসহ এ-সংক্রান্ত গবেষণা ও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের কাজ করছে এসডিএসএল।