নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীর অনুপস্থিতি নিন্দনীয়। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে সরকার সাধারণ নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও প্রতিবন্ধী নারীদের ইতিবাচক উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং বৈশ্বিক সূচকে ৫ম অবস্থানে রয়েছে। এদিকে হাউস অব লর্ডসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি সার্কেল আয়োজিত এক বৈঠকে লেবার পার্টির জ্যেষ্ঠ সাংসদ জিম ফিটজপ্যাট্রিকস বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ইত্তেফাক, সমকাল, ঢাকা ট্রিবিউনসহ কিছু পত্রিকা এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাধীন, মর্যাদাকর জীবনযাপনসহ ক্ষমতায়নের বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচরে নেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা তৈরি, ঋণ প্রদান, প্রশিক্ষণ, নারী নির্যাতন বা যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ এসব ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ দৃঢ়ভাবে লক্ষণীয়। তবে একই প্রাসঙ্গিকতায় প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি গৌণ। বরং প্রতিবন্ধী নারীরা সাধারণ মৌলিক অধিকার থেকেও হচ্ছে বঞ্চিত। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাভিত্তিক তথ্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জরিপ প্রতিবেদনে নিয়মিত পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। উপরন্তু তথ্যের খোঁজ চাইলে সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা হিমশিম খেয়ে যান। স্থানীয় সরকারে সাধারণ নারীরা নির্বাচিত হলেও প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ-সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন বা স্থানীয় সরকার কারও কাছেই নেই। অর্থা্ৎ সরকারের তথ্যভান্ডারে প্রতিবন্ধী নারীরা অদৃশ্য।
সরকারের এ সংখ্যাতাত্তি¡ক অবহেলা সমাজের প্রচলিত সেবা বা কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। আবার গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতার অভাব। কারণ, সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবকাঠামোগত বাধা এ দুটি প্রতিবন্ধী নারীদের বৈষম্যপীড়িত অবস্থা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে তাদের। অনুৎসাহিত করছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সম-অংশগ্রহণে। ফলে প্রতিবন্ধী নারী হয়ে পড়ছে জনবিচ্ছিন্ন। ব্যতিক্রমী মুষ্টিমেয় প্রতিবন্ধী নারীকে সাধারণ জনজীবনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে দেখা গেলেও ‘উন্নতি হচ্ছে’ নামক স্বপ্নটি আশ^স্ততার চার দেয়ালের ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এসডিজি লক্ষ্য ৫ এবং লক্ষ্য ৮-এর ৮.৫ সূচকে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এসডিজি অর্জনে কাজ শুরু করার পর আমরা আশা করেছিলাম, সরকার প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তথ্য সংরক্ষণ, উপাত্ত বিনিময় এবং তা বিশ্লেষণ করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় ক্রমান্বয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতই হয়ে উঠছে প্রতিবন্ধী নারীদের শেষ গন্তব্য। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার বছর বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে এবং আওতা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন এসেই যায়, তাহলে কি এর মধ্য দিয়েই প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির সমাধান খোঁজা হচ্ছে! এ কারণেই কি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং প্রবেশগম্যতাসহ অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্ব, ক্ষমতায়নের মতো বিষয়সমূহে প্রতিবন্ধী নারীর বৈষম্যের প্রকটতা লক্ষণীয়!
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়ন বা অগ্রগতির অবস্থা পরিমাপের জন্য প্রচলিত সূচকসমূহে নারীর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নারীর সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন প্রয়োজন। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিবন্ধী নারীর জন্য নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকারকে আরও বেশি সাহায্য সহযোগিতা ও প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগে উদ্যোগী হতে পারে। নতুবা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষমতা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী নারীর বাধাহীন পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া চ‚ড়ান্ত বিশ্লেষণে ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে না।