নাজমা আরা বেগম পপি
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ একজন নারীকে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। একজন পুরুষ ব্যর্থ হলে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করা হয়, কিন্তু একজন নারী ব্যর্থ হলে তাকে শুনতে হয় সে নারী বলেই পারেনি।
নারীকে তাই কাজ করতে হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে সামাজিক চাপ মাথায় নিয়ে। তারপরেও আশাবাদী হয়ে বলতে চাই যে, অদৃশ্য এক চ্যালেঞ্জ নিয়েও আজ বহু নারী বিভিন্ন পেশায় কাজ করার সুযোগ তো পাচ্ছে! বেশি দিন আগে নয়, একটা সময় ছিল যখন পরিবার থেকেই নারীকে বাধার সম্মুখীন হতে হতো।
কিন্তু নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ক্ষেত্রে কথাটি সত্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ যা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। এ দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। সেই হিসাবে নারীদের ১৫ ভাগ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ। নারীকে যদি পুরুষের তুলনায় অযোগ্য মনে করা হয়, তাহলে প্রতিবন্ধী নারীকে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজের ক্ষুদ্রতম পরিমন্ডল, নিজ পরিবারের মধ্য থেকেই তার মধ্যে এমন ধারণা প্রোথিত হয়। জ্ঞান বুদ্ধি হওয়া মাত্রই সে বুঝতে পারে এ বিশাল ধরণিতে সম্পূর্ণ উপযোগিতাহীন একজন মানুষ হিসেবে সে আর্বিভূত হয়েছে। যে দেশে রাষ্ট্রপ্রধান একজন নারী, সেখানে আজও সর্বসাধারণের কাছে একজন নারীর সক্ষমতার চুড়ান্ত মানদন্ড হচ্ছে স্বামী, সংসার, সন্তান প্রসব, লালন পালন করতে পারা। এ ছাড়া বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিষয় তো রয়েছেই। পুঁজিবাদের বিজ্ঞাপন ও বিপণনের এই সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রিকা, বিলবোর্ডের আকর্ষণীয় নারীদের দেখে যেখানে একজন সাধারণ নারীই হীনমন্যতায় ভোগে, সেখানে একজন প্রতিবন্ধী নারীর মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
সংকীর্ণ এক গলিতে, সমাজের নির্বোধ মানুষের বিদ্রুপ এড়িয়ে, লোকচক্ষুর অন্তরালে বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকাই যার নিয়তি। তাঁর পরিচয়, সে প্রতিবন্ধী মানুষ তায় আবার নারী তাই পরিবারের বোঝা সে।
একজন পরিণত মানুষের পরিচয় কীভাবে নির্ধারিত হয়? তার পরিবার, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ইত্যাদি একজন ব্যক্তির পরিচয় বহন করে। আত্মবিশ্বাসী একজন ব্যক্তি নির্দ্বিধায় স্বীয় মতামত ব্যক্ত করতে পারেন এবং আত্মপরিচয়ে দীপ্ত একজন ব্যক্তি সঠিক মনে করলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে ব্রত হন। এ ক্ষেত্রে তিনি সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, নিজের মতাদর্শে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। এভাবেই আসে পরিবর্তন, এভাবেই সৃষ্টি হয় নেতৃত্ব।
বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সম-অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা যায় না। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা থাকলে একজন প্রতিবন্ধী নারীও যে নিজ সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে পারে, তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে সামগ্রিক বিচারে তা নগণ্য। প্রতিবন্ধী নারীকে আত্মপরিচয় লাভের সুযোগটুকু দেওয়া হোক। ফলাফলের চিন্তা না করে অন্তত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর আগেই আমরা তাদের ওপর ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ তকমা যেন না লাগাই, এটুকু আশা করা কি খুব বেশি?