অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল করিম সিদ্দিকী
আমরা সম্প্রতি দেখলাম নিজের সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর খবর জানতে গিয়ে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী নারী রেনু নিহত হলেন। প্রায় একই সময় মেয়েকে দেখতে গিয়ে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিহত হলেন তথাকথিত গণপিটুনিতে। কিশোরগঞ্জে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে হাত-পা বেঁধে উৎসবমুখর পরিবেশে মেরে মুমূর্ষু করার ঘটনাও ঘটল এ বছরেই!
প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানকে শুধু লালন-পালন করতে অসুবিধা হওয়ার কারণে ২০১৭ সালের শেষ দিকে গলা কেটে তাকে হত্যা করেছে পিতা! বুদ্ধি ও মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের ধর্ষণ করা হলে সেটাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্যই করা হয় না। পুলিশ প্রশাসন এ ধরনের প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও তারা ধর্ষণের মামলা নিতে চায় না।
আমরা চারপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অনুভব করি, যে মানুষ যত বেশি প্রান্তিক সে তত বেশি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে থাকে। এর কারণ হলো অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় থাকা মানুষটির চেয়ে সামান্য খারাপ অবস্থায় থাকা মানুষটির প্রতি বা তার পরিবারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে অভ্যস্ত নয়। মর্যাদা ও সম্মানের মানদন্ডে দুর্বল অবস্থায় থাকা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ন্যায়বিচার লাভের চিত্রও হতাশাজনক। প্রান্তিক গোষ্ঠী বিবিধ কারণে ন্যায়বিচার পায় না বিধায় নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্যক্তিরা হরহামেশাই নানা কায়দায় প্রান্তিক মানুষদের ওপর নির্যাতন চালায়। বৃহত্তম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ‘অধিক হারে’, ‘নিত্য নতুন কায়দায়’ ও ‘তীব্রতর মাত্রায়’ নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকি। অত্র প্রবন্ধে নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইনে ব্যবস্থা এবং তা বাস্তবায়নের পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে জাতিসংঘ The Convention against Torture and Other Cruel, Inhuman and Degrading Treatment and Punishment, 1984, ১৯৮৪ (সংক্ষেপে ক্যাট) নামক একটি আন্তর্জাতিক সনদ প্রণয়ন করে। এ সনদ অনুযায়ী সরকারি কর্মে নিয়োজিত কর্মী বা এরূপ ক্ষমতা ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তির দ্বারা বা তার সম্মতিতে বা জ্ঞাতসারে স্বীকারোক্তি বা তথ্য উদঘাটনের জন্য কিংবা শাস্তি, হুমকি বা ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বেদনা বা যন্ত্রণা দানের উদ্দেশ্যে কৃত কর্মই নিষ্ঠুরতা। এ সনদ মোতাবেক যেকোনো ধরনের নিষ্ঠুরতা নিষিদ্ধ। সনদের ২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে আইনি, বিচারিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য সব ব্যবস্থা গ্রহণে পক্ষরাষ্ট্র বাধ্য। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে এই সনদ অনুস্বাক্ষর করে। তাই বাংলাদেশও এ সনদ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। ক্যাট অনুযায়ী রাষ্ট্র চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায়/কারিকুলামে নিষ্ঠুরতা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে শিক্ষা ও তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য (অনু. ১০)। এতদসংক্রান্ত আইন, নীতি, বিধি ইত্যাদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে রিভিও করতেও রাষ্ট্র বাধ্য (অনু ১১)। এমনকি নিষ্ঠুরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা আইন দ্বারা নিশ্চিত করতেও পক্ষরাষ্ট্র বাধ্য (অনু. ১৪)।
একটু দেরিতে হলেও জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি পৃথক আন্তর্জাতিক সনদ সিআরপিডি প্রণয়ন করে। এ সনদের অনুচ্ছেদ ১৫ তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকেই নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা বা মর্যাদাহানিকর চিকিৎসা অথবা শাস্তি প্রদান করা যাবে না। কোনো ব্যক্তিকেই তার স্বেচ্ছাসম্মতি ছাড়া চিকিৎসার বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়বস্তু করা যাবে না। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের ওপর নির্যাতন, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর কোনো চিকিৎসা বা শাস্তি প্রতিরোধ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সব ধরনের কার্যকর আইনগত, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সিআরপিডির অনুচ্ছেদ ১৬ তে শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য করণীয় সম্পর্কে বেশ কিছু বাধ্যকতা আরোপ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণকে ঘরে-বাইরে লিঙ্গনির্বিশেষে সব ধরনের শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ যথাযথ আইনগত, প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক বা অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রপক্ষ সব ধরনের শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের সেবার জন্য পরিচালিত সকল সুবিধা ও কর্মসূচি স্বাধীন কর্তৃপক্ষের দ্বারা কার্যকরভাবে পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ওপর শোষণ, সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা শনাক্তকরণ, তদন্ত ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ নারী ও শিশুবান্ধব আইন ও নীতিমালাসহ কার্যকর আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
আন্তর্জাতিক সনদগুলোর বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮; যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮; প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩; নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, ২০১৩; শিশু আইন, ২০১৩; নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯; আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০; ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮; সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; পুলিশ আইন, ১৮৬১; প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৮৬০ ও দন্ডবিধি, ১৮৬০সহ বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ১৬(১)(ট) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকার থাকবে। এই অধিকার যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লঙ্ঘন করবে, তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ব্যক্তি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটিতে ক্ষতিপূরণের আবেদন করতে পারবে। এই আইনের ৩৭(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো ব্যক্তিকে আইনের আশ্রয় লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করলে অভিযুক্ত ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে কিংবা পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে বা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। আইনের তফসিলের ১২ নম্বর দফায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নির্যাতন থেকে মুক্তি, বিচারগম্যতা ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ, সেফহোমে রাখবার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, যোগাযোগের সুবিধার জন্য বিশেষজ্ঞ (যেমন বাংলা ইশারা ভাষাবিদ)সহ কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে সুরক্ষার নিমিত্তে বিদ্যমান আইনি কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু এসব আইনি বিধানের বাস্তবায়ন খুবই হতাশাজনক।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বা পুনর্বাসনের নামে হাজার হাজার হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র বা আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এসব স্থানে আবদ্ধ রেখে চিকিৎসার নামে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়, রোগীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখা হয় বা তাদের অসম্মতিতে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ওষুধ খেতে না চাইলে বা নিয়মকানুন মেনে না চললে তাদের ওপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, নার্স, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নির্মম নির্যাতন চালায়। কখনো কখনো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এসব আচরণ ক্যাট, সিআরপিডি বা বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ক্যাট-এর অনুচ্ছেদ ২, ১০, ১১ ও ১৪ এবং সিআরপিডির অনুচ্ছেদ ১৫ ও ১৬ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর নিষ্ঠুরতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। সরকার আইন প্রণয়ন করেই দায়িত্ব সমাপ্ত করেছে। আইন বাস্তবায়নে তাই সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, মূল জনগোষ্ঠীও যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিজেদের সঙ্গে সমানতালে চলতে দিতে নারাজ! তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বললেও প্রায়ই প্রতিবন্ধী জনগণকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা আমরা তাদের মধ্যে দেখতে পাই। ক্যাট বাস্তবায়নের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাসমূহের পক্ষ থেকে এ বছরের জুন মাসে একটি বিকল্প প্রতিবেদন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটিতে প্রেরণ করা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর চিকিৎসার নামে চলমান প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতন যেমন শেল্টার হোম বা মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র অথবা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে যে সমস্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে সে বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কারণেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর নিষ্ঠুরতার বিষয়টি জাতিসংঘ অবগত হতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি যে কনক্লুডিং অবজারভেশন দিয়েছে, সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর চলমান নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
এমতাবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন বা ডিপিওসমূহকে নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি সুশীল সমাজসহ সমাজের মূলধারার জনগোষ্ঠীকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
ইন-কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, ব্লু ল ইন্টারন্যাশনালই-মেইল: advreja@gmail.com