অপরাজেয় ডেস্ক
স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পরেও প্রতিবন্ধী মানুষের উপযোগী প্রবেশগম্য গণপরিবহন ও ফুটপাত নেই। সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। এ নিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজমান।
অন্যদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) ও ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এ বিষয়ে নিজেদের অপারগতা জানিয়ে ভবিষ্যতে নতুন করে বাস আমদানির উদ্যোগ নেওয়া এবং সড়ক ব্যবস্থাপনা মানুষের উপযোগী করে তোলার আশ্বাস দেন।
বিশ্ব প্রবেশগম্যতা সচেতনতা দিবস ২০১৯ উপলক্ষে গত ১৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে এই গণশুনানির আয়োজন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্স প্রকল্পের অর্থায়নে গণপরিবহনে প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থান শীর্ষক এই গণশুনানিতে উপস্থিত প্রতিবন্ধী মানুষ বিশেষত প্রতিবন্ধী নারীরা স্বাধীন চলাচল ও যাতায়াতের প্রেক্ষাপট এবং সরকারি বেসরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে প্রবেশগম্য যানবাহন এবং সচেতনতার অভাবে গণপরিবহনে তাদের ভোগান্তি এবং সাধ্যের অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয় তুলে ধরেন। এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিসি এর ব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য উপযোগী বাস নতুন করে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে আরও চারটি বৃদ্ধি করে তেরোটি আসন করা হয়েছে। এ সময় তিনি জানান, বিআরটিসি এবং বিআরটিএ এর নতুন চালক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সচেতন হবার বিষয়টি উল্লেখ আছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) প্রকল্প পরিচালক (ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং) নাসিরুদ্দিন তরফদার (উপসচিব) বলেন, বিআরটি ও এমআরটিকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে প্রতিবন্ধী মানুষদের উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় অযান্ত্রিক বাহন ( রিক্সা) সংরক্ষিত করার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত বিবেচনা করা হবে। বাসে প্রতিবন্ধী যাত্রীরা রেয়াতি ভাড়ায় ছাড় পায় না। এ বিষয়ে সমাজসেবায় অভিযোগ করলে তারা পরিবহন মালিকদের জানাতে বলে, অন্যদিকে পরিবহন মালিকেরা দায় এড়িয়ে যায়। এ বিষয়ে করণীয় জানতে চাইলে জনাব মোস্তাফিজুর রহমান বিআরটিসির হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করতে বলেন।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর দপ্তর সম্পাদক ফিরোজ আলম, প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিসচার একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ যাতায়াতব্যবস্থার দাবিকে সংহতি জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার প্রতিবন্ধী মানুষের উপযোগী গণপরিবহন ও যাতায়াতব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার তাগিদ দিয়ে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এআরআই এ বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী।
সমাপনী বক্তব্যে বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘বাদ যাবে না একজনও’ এ বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১১.২ এ অরক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী মানুষ এবং বয়োবৃদ্ধ মানুষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যানবাহনব্যবস্থার সম্প্রসারণের মাধ্যমে সবার নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সুলভ এবং টেকসই পরিবহনব্যবস্থায় সবার অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অথচ প্রায় আট বছর ধরে বিআরটিসির সঙ্গে জনওকালতির পর আজও এ সমস্যা সমাধানে বিআরটিসি এবং সরকারের পদক্ষেপসমূহ দুর্বল। সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রবেশগম্য বাস আমদানিতেও বাসমালিকদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা নেই।
উপস্থিত প্রতিবন্ধী মানুষদের আরও অভিযোগ ছিল পরিবহন শ্রমিকদের অসচেতনতা ও অসহযোগিতার কারণে গণপরিবহনে যাতায়াতে বিপত্তি এবং সংরক্ষিত নারী আসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, বাসগুলো সঠিক জায়গায় দাঁড়ায় না। প্রায়ই চলন্ত বাসে ওঠানামা করতে হয়। অনেকেই এভাবে বাসে উঠতে না পারায় রিকশা বা সিএনজিতে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করে চলাফেরা করেন। প্রতিবন্ধী নারীরা গণপরিবহনে যৌন সহিংসতা বন্ধ করতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে আরও বলেন, সব বাসই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের উপযোগী করা দরকার।
এদিন গণশুনানিতে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে অংশ নেন উইমেন উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউডিডিএফ) নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্দীন হলের হল সাংসদ শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নাঈম মোল্লা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী রেবেকা মুন্সি সীমা, কর্মজীবী শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী সানজিদা আক্তার, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সগীর হোসাইন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারী হাওয়া আক্তার, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী তনিমা প্রমুখ।