অপরাজেয় প্রতিবেদক
পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, সঠিক রঙের ব্যবহার, সহায়ক উপকরণ, ইন্ডিকেটর বা সঠিক দিকনির্দেশনা এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণে সহায়ক সফটওয়্যার ও অডিও বইয়ের অভাবসহ নানামুখী সমস্যার কারণে সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হতে পারছে না দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।
বাংলা ইশারা ভাষার প্রচলনের অভাব ও যোগাযোগের বাধার কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও সাধারণ বিদ্যালয় থেকে দূরে থাকছে।
এর বাইরে আছে গণপরিবহনে সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব।
মোটাদাগে এ কয়েকটি কারণেই আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ বিদ্যালয় ছেড়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ছুটতে হচ্ছে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে। এসব বিদ্যালয়ে নিজেদের গন্ডির মধ্যেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বেশ কিছু শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তারা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না সন্তানদের নিয়ে। প্রতিযোগী মনোভাব, নিয়মিত পাঠ্যসূচিবহির্ভূত কার্যক্রমসহ প্রচুর মেলামেশার ফলে সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যতটা বিকাশ হয়, বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসবের অভাবে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। অভিভাবকেরা চান না তাদের প্রতিবন্ধী সন্তান সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় বেড়ে উঠুক।
জানা যায়, পড়াশোনার জন্য বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এসব বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকেন; ছেলেদের জন্য এটি তুলনামূলক স্বচ্ছন্দের হলেও নারী শিক্ষার্থীরা এসব হোস্টেলে নিরাপদ বোধ করেন না। নিজেদের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকা এবং একা চলাফেরার কারণে এসব শিক্ষার্থীর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে।
রাজধানীর বিভিন্ন বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কিশোরী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দলগত আলোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের দুটি বিদ্যালয় এবং ব্যাপ্টিস্ট মিশন বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন বি-স্ক্যান।
ব্যাপ্টিস্ট মিশন বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, বিশেষায়িত বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা ও উপকরণ থাকে, শিক্ষকেরাও বাড়তি যত্ন নেন, যা সাধারণ স্কুলগুলোতে মেলে না।
‘শিক্ষকদের অতিরিক্ত যত্ন, আবাসিক ব্যবস্থা, ব্রেইল বই এসব আমরা এখানে পাই, যা অন্য বিদ্যালয়ে নেই। তা ছাড়া এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা আমাদের সুবিধা-অসুবিধা, ভালো-মন্দ চাহিদা বোঝেন। স্বাধীন চলাচল শেখাতে মোবিলিটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যা আমরা সাধারণ বিদ্যালয়গুলোতে পেতাম না,’ বলেন ওই শিক্ষার্থী।
সাধারণ বিদ্যালয়ে অন্যরা যেখানে শ্রেণিকক্ষের বোর্ড থেকে সহজেই শিক্ষকদের লেখা টুকে নিতে পারে, সেখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নির্ভর করতে হয় কেবল শিক্ষকের মুখে বলা লেকচারে।
বিশেষায়িত বিদ্যালয়গুলোতে এ সমস্যা নেই। সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীরা ইশারা ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় সেখানে নির্দ্বিধায় যেতে পারছেন না শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও।
পরিবারের সদস্যরা ইশারা ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় অনেকে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, যে কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অনেকে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের হোস্টেল ছেড়ে বাড়িতেও যেতে চায় না বলে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত এক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানিয়েছেন।
সাধারণ বিদ্যালয়ে দরকারি সুযোগ-সুবিধার অভাবের পাশাপাশি যাতায়াত সমস্যাও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বিশেষায়িত বিদ্যালয়মুখী করছে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, রাজধানীর গণপরিবহনগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বয়স্ক ব্যক্তিদের ওঠানামার জন্য বিভিন্ন বাসে ও পরিবহনে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, সেগুলো নেই।
বাসচালক ও সহযোগীরা এমনকি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গাড়িতে তুলতেও অনাগ্রহী থাকেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওঠানামায় যে অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন, তা করতেও নারাজ থাকেন তারা।
যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের নানান ঘাটতি অভিভাবকেরা সাধারণ না বিশেষায়িত বিদ্যালয় এ নিয়ে ভোগেন দ্বন্দ্বে। বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। হোস্টেলগুলোতে চিকিৎসাসেবাও অপ্রতুল। কোথাও কোথাও এমনকি ফার্স্ট এইড বক্সও নেই। অসুস্থ হলে হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে হয়।
হোস্টেলগুলোতে আছে আলোর অভাব, নেই পর্যাপ্ত লাইট-ফ্যানও। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত এক বিদ্যালয়ের হোস্টেলে পানির সংকটও বিদ্যমান। পর্যাপ্ত কম্পিউটার না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিশিক্ষা থেকেও বঞ্চিত থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা এবং তাদের জন্য দরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও উপকরণ নিশ্চিত করা উচিত।
এ ছাড়া বিশেষায়িত বিদ্যালয়কে প্রাক্ প্রাথমিকের আওতায় রেখে সাধারণ বিদ্যালয়কে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তোলা এবং গণপরিবহনে যাতায়াত নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়াও অতীব জরুরি।