১ জুন ২০২২ ছিল সেই ১৬ জন প্রতিবন্ধী মানুষের কাজে যোগদানের দিন। বি-স্ক্যান থেকে প্রোগ্রাম অফিসার – মাহফুজুর রহমান রাকিব গিয়েছিলেন টিম গ্রুপে তাদের এই আনুষ্ঠানিক যাত্রার সঙ্গী হতে। এভাবেই প্রতিবন্ধী মানুষদের স্বাগত জানানো হয়েছে স্বনামধন্য একটি গ্রুপের গামেন্টস ফ্যাক্টরিতে সেখানে ১৬ জনের মধ্যে যোগ দিয়েছেন মোট ১১ জন, ৩ জন কিছু ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে যোগ দেন নি, তবে সুখবর হলো তাদেরকেও কাজে নিয়োগ দেয়া হবে। আর ২ জন কাজ পেয়েও কাজে যোগ দেন নি।
আমাদের কাছে প্রতিদিন অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ অনুনয়-বিনয় করেন একটি চাকরির জন্য। গত ২৬-২৭ জানুয়ারি ২০২২ বিবিডিএন আয়োজনে যে চাকরি মেলা হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে কিছু চাকরিদাতা আগ্রহী হয়েছেন প্রতিবন্ধী মানুষকে চাকরি দিতে। আমাদের বুঝতে হবে, এই চাকরিদাতাদের সাথে প্রতিবন্ধী মানুষের কোন উঠা বসা নেই, তাই তারা অবগত নন কোন ধরনের আর্থিক, সামাজিক ও শারীরিক সীমাবদ্ধতায় একজন প্রতিবন্ধী মানুষের কিভাবে তার জীবন ধারন করেন, দৈনন্দিন কাজকর্ম করেন। প্রতিবন্ধী মানুষকে বোঝা-পড়ার দায় কী তাদের আছে। যেখানে নিজেদের অনেক পরিবারই আমাদের বিষয়ে বুঝতে আগ্রহী হয়না। প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে উনারা শিখছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন আর অন্যান্য সংগঠনের মতোই আমরাও (বি-স্ক্যান) চেষ্টা করছি চাকরি দাতাদের ভুল ধারনাগুলো ভেঙ্গে দিতে। প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মদক্ষতাগুলো সম্পর্কে বুঝাতে।
আমরা প্রায় ৭৫০ চাকরি প্রার্থী প্রতিবন্ধী মানুষের ডাটাবেজ তৈরি করেছি। যেখানে ২৫টি চাকরি দাতা সংস্থা রয়েছে । তাদের মধ্য থেকে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান লোক চাওয়া শুরু করেছেন। তেমনি একটি আয়োজন ছিল গত ১৭ মে, ২০২২। একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কমশিক্ষিত (এসএসসি পাশ) প্রতিবন্ধী মানুষ চাওয়া হয়েছে। যারা চাকরির জন্য এসেছেন তারা সব কিছু জেনে বুঝেই এসেছেন কিন্তু ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার পর কেউ কেউ মামার বাড়ির আবদার শুরু করলেন। এই কাজ করবো না, সেই কাজ করবো না, এক মাস দেখবো ওখানে না দিলে চলে যাবো ইত্যাদি। আমরা পুরো আশ্চর্য হয়ে গেলাম তাদের আচরণে, কাজই শুরু করে নি, তার আগেই এসব কথা।
সারা দেশে অসংখ্য অপ্রতিবন্ধী মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু একটি চাকরির জন্য, আর উনারা এইসব এগিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতা করা তো দূরে থাক, পরিবেশটাই নষ্ট করে ফেলছেন। একবারও ভাবছেন না আমি আরও ১০ জন প্রতিবন্ধী মানুষের সুযোগ নষ্ট করছি। কেউ আপনাদের ধরে বেধে এই চাকরি করতে নিয়ে আসে নি। আপনারা স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়েছেন। তাহলে এসব কথা কেন? এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আমরাও তো ছোট হয়ে যাচ্ছি। ওরা তো ভাববে আমরা কি লোক দিলাম যারা কাজই করতে চায় না। আগামীতে আপনাদের জন্য আমরা কাজ করি সেটা আপনারা চান না? কিছুদিন আগে বি-স্ক্যান গ্রুপে একজনের পোস্ট দেখলাম উনি জানতে চেয়েছিলেন ১৭ তারিখের ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট কি? আর উনি নিজে ডাক পেয়েও যোগ দেন নি। কি হাস্যকর! যেখানে প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ নেয় না, সেখানে এই প্রতিষ্ঠান শুধু আপনাদের যোগ দিতে বলেছেন, প্রশিক্ষণ তারা দিয়ে নেবে, তারা কি কোন অপরাধ করেছে আপনাদের চাকরি দিতে চেয়ে?
এই ঘটনা শুধু এখানে নয়, আরও অনেক ঘটেছে, ঘটছে। যেমন – গতকাল (১ জুন) একটি কোম্পানি বেশ কয়েকজন প্রতিবন্ধী মানুষ চেয়েছেন। ডাটাবেজ থেকে চাকরিদাতাদের চাহিদা অনুযায়ি লোকের তালিকা দেয়াও কিন্তু অনেক কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ একটি কাজ। শুধু তালিকা তৈরিই নয়, এদের প্রত্যেককে আবার ফোন দিয়ে জানা হয়েছে তারা উক্ত পদে চাকরি করতে চান কিনা, যারা রাজি হয়েছিলেন, তাদেরটাই দেয়া হয়েছে। অথচ আজ যখন প্রতিষ্ঠান থেকে ৫/৬ জনকে ফোন দেয়া হয়েছে তারা কেউ বলেছেন করবেন না, কেউ বলেছেন ভেবে দেখি ইত্যাদি। বিরক্ত হয়ে ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে আর কাউকে ফোনই দেয় নি। আমরা ১৮ জনের তালিকা দিয়েছিলাম।
আপনারা কি বুঝতে পারছেন কি করছেন?
চাকরি কি শুয়ে বসে আরামে আয়েশে করার কোন কিছু মনে হয়?
আপনারা কি বুঝতে পারছেন এভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি বিরূপ ধারনা জন্ম নিচ্ছে?
প্রতিবন্ধী মানুষকে চাকরি দিতে চেয়ে এখন কি চাকরিদাতারাই অন্যায় করেছে?
চাকরি করার মানসিকতা যদি নাই থাকে, তবে কেন আর একজন প্রতিবন্ধী মানুষের সুযোগ নষ্ট করছেন?
দুনিয়ায় কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। যদি এটা মানতে না পারেন তবে দয়া করে দুদিনের সখের চাকরি করা থেকে বিরত থেকে যাদের সত্যিই সত্যিই চাকরির দরকার এমন প্রতিবন্ধী মানুষগুলোকে বাঁচতে দিন। আপনাদের মত কিছু প্রতিবন্ধী মানুষের আচরণ সহমর্মী চাকরিদাতা এবং যারা অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে তাদের নিরুৎসাহিত করছে।
সামনে যে আর্থ-সামাজিক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে সেখানে প্রচুর মানুষ চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুকিতে পড়বে, এরকম একটি সময়ে আপনারা চাকরির অফার পাচ্ছেন, এমন সুযোগ কতটা কষ্টের ফল সে বিষয়ে আপনাদের কোন ধারনাই নেই।
যাই হোক আশা করি আপনারা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবেন। সবশেষে যারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন তাদের সবাইকে বি-স্ক্যান’র পক্ষ থেকে অভিনন্দন।
– সালমা মাহবুব
সাধারণ সম্পাদক, বি-স্ক্যান