২০০৯ সালের ঘটনা……। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম আমাদের কেরানীহাট শাখায় অডিট করতে। খুব সম্ভবত ফেব্র“য়ারী মাস। সেদিন পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছিল। বন্ধু মুকুল মুঠোফোনে জানাচ্ছিল বার বার। কী আতঙ্ক! অফিসে সবাই জিম্মি। ভয়ে শুকিয়ে আছে ধানমন্ডি শাখার কলিগদের চেহারা। দরবার হলের কাছাকাছি ধানমন্ডি শাখা। গভীর মনোযোগ সহকারে কাজ করছিলাম। আখতার ভাই, ইউনুছ ভাই ওরা বাকরুদ্ধ। সবাই চিন্তিত, কী হচ্ছে এসব? কাজে মন বসছিল না। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, গুনগুন করে গানের কলি ভেসে আসছে। কার এতো চমৎকার গানের কন্ঠ! মাহিন ভাইয়ের টেবিলে বসে গান করছিল এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। কাছে যাওয়া মাত্রই সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। জানলাম তার নাম শেখ সেলিম। বাড়ি লোহাগাড়া। অবহেলিত এই মানুষটার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। সুর্যটা তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছিল। সূর্যের লাল আভা কাঁচের ফটক দিয়ে উকি ঝুকি মারতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে মাগরিব হয়ে এল। শেখ সেলিমের কন্ঠে আজান শুনলাম। নামাজ শেষে গোধূলি বেলায় সেলিমকে নিয়ে আবারও বসলাম। সেলিম ভালোবেসে বিয়েও করেছে। সেলিমের বউ নাকি মিষ্টি সুরের গান শুনে ওর প্রেমে পড়েছিল। ওদের, অভাবে ডুবে থাকা সুখের সংসার! একটাই দুঃখ, বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা নেই। ধানের জমি, ক্ষেতের আইল কিংবা ছোট সরু বাঁধের উপর দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়। অনেক সময় পা পিছলে পানির মধ্যে পড়ে গিয়ে কাদা মেখে বাড়ি যেতে হয়। সেলিমের জীবনের রঙীন স্বপ্ন, একট রাস্তা তৈরী করা। যে রাস্তা দিয়ে গ্রামের মানুষ আসা যাওয়া করতে পারবে। গ্রামের কিশোর কিশোরীরা স্কুলে যেতে পারবে। লেখা-পড়া করার খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বে¡ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার কারনে শেষ করার সুযোগ হয় নি। শেখ সেলিমের প্রতি অনেকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক ব্যাংকাররা মিলে তাকে গরু কিনে দিয়েছে। টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে সাহায্য করেছে। সে অনেক খুশি। লোহাগড়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসা যাওয়া জন্য তাকে সাউদিয়া চেয়ার কোচে ফ্রি ব্যবস্থা করে দিয়েছে মালিক কর্তৃপক্ষ। সে সময় চট্টগ্রাম থেকে রশীদ মামুন সম্পাদিত ‘একটি সকালে’ ভবঘুরে ফিচার নিয়মিত লিখতাম। সেখানেই শেখ সেলিমের জীবনের কাহিনী নিয়ে “মেধা দিয়ে অন্ধত্ব জয়’ শিরোনামে একটা ফিচার করেছিলাম। লেখাটা ছাপার পর আমাকে অনেকে মুঠোফোনে ধন্যবাদ দিয়েছে। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ব্যাপারটা কী? আমি এমন কী লিখলাম, যেটা আমার ব্যাংকের পুরো চট্টগ্রাম জোনের সব শাখার কর্মকর্তারা জানে। সবাই ফোন করে। পরে জানলাম শেখ সেলিমকে, অনেক ব্যাংকাররাই পছন্দ করে। তার মেধা, সুন্দর কন্ঠ, মিষ্টভাষী শেখ সেলিম অনেকের মনে স্থান করে নিয়েছে। ২০০৯ সালের পর শেখ সেলিমের সাথে আর যোগাযোগ হয় নি। ২০১১ সালের দিকে আমি জুবলী রোড শাখায় অফিসায়াল কাজে গিয়েছিলাম। শেখ সেলিম খবর পেয়েছে, আমি চট্টগ্রামে এসেছি। সে লোহাগড়া থেকে চলে এসেছে আমার সাথে দেখা করতে, একটু কথা বলবে নাকি। ফোনে জানিয়েছে মাহিন ভাই। অদ্ভূত কান্ড। বিকেল বেলা সে এসে হাজির। আমাকে স্যার বলে জড়িয়ে ধরল। কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে আসল আমার জন্য। বলল, স্যার আপনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন। আমি যে কী খুশি হয়েছি। এই লেখা আমি ফটোকপি করে আপনার সব শাখায় বিলিয়েছি। সবাই তাঁর জীবনী পড়ে মুগ্ধ। অনেকে সাহায্য করেছে। স্যার আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি বললাম কৃতজ্ঞ হওয়ার মতো আমি কিছুই করি নি। কেন এসেছো এতো কষ্ট করে ? টাকা দিতে চাইলাম। নিলো না। শেখ সেলিমের চোখে মুখে যে অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখেছি, আমি সত্যি সেদিন অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। এতো ভালোবাসা এতো শ্রদ্ধা! শেখ সেলিমকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে সেটা বলো? সে জানাল খুব ভালো। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুখে আছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সেলিম, যে কিনা চোখে দেখে না। মাঝে মাঝে নুন আনতে পানতা ফুরায়, অভাব অনটনের সংসার। তার কথা শুনে মুগ্ধ হলাম। অনেকে আজ বড় বড় অট্টলিকায়, এসি গাড়ি, বাড়িতে বসবাস করছে। কিন্তু সুখ জিনিসটা তাদের নেই। শেখ সেলিম অনেক সুখী। সে চোখে দেখে না ঠিকই। কিন্তু তার তৃতীয় নয়ন দিয়ে সবকিছু দেখে, বোঝে এবং ভালো ভাবেই বুঝতে পারে সব। শেখ সেলিমের সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, ওরা ঠিকই তৃতীয় নয়ন দিয়ে সবকিছু দেখে বুঝে। ওদেরকে আমরা বুঝতে পারি না। সমাজে, তথা দেশে প্রতিনিয়ত কত না অবহেলার শিকার হয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। ওরা একটু ভালোবাসা পেলে সব কিছু জয় করতে পারে। যেমনি পেরেছে শেখ সেলিম। ওদেরকে সমাজের বোঝা না ভেবে সুযোগ দেয়া উচিৎ। ওদের মেধা আছে। ওরাও মানুষ। ওরা কারও না কারও ভাই কারও বোন কারও বা সন্তান। ওদের সুযোগ দেই স্কুল-কলেজে পড়ার জন্য। আসুন ওদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেই। জয়তু শেখ সেলিম।
রশীদ এনাম
ব্যাংকার।
সদস্য-বি-স্ক্যান।