রশীদ এনাম
ব্যাঁ এ্যাঁ করে কাঁদছে কুসুম। বয়স তখন পাঁচ কি ছয় হবে আর কি। সাত সকালে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম অঝোরে কাঁদছে ছোট একটি মেয়ে। মা মেরেছে। জন্ম থেকে বাক প্রতিবন্ধী কুসুম রহিমা বুবুর মেয়ে। তাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই বুবুর। দুঃশ্চিন্তা এবং আক্ষেপগুলো ঝারেন নিষ্পাপ এই মেয়েটির উপর। নিজেই মারেন। আবার নিজেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন। শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে চোখ মুছে কুসুমকে বুকে জড়িয়ে আদরও করেন। একদিন বকা দিলাম আমি, আপনি কেন কুসুমের গায়ে হাত তুলেন। ছোট মেয়ে। ওকে আপনি আর কখনও মারবেন না।
আহা রে ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। বলতে চাইলে গোঙ্গানোর মত কিছু শব্দ বেরুচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে খুব কষ্ট লাগে। সৃষ্টিকর্তার কি এমন অভিমান ছিল ফুলের মতো দেখতে মেয়েটির উপর!? আমাদের পাশের বাসায় ওদের নানা বাড়িতে ভাড়া থাকত ওরা। একমাত্র রহিমা বুবুই কুসুমের হাতের ইশারায় বলা মনোভাবের প্রকাশভঙ্গি বুঝতে পারত। মা বলে কথা। অন্য কেউ বুঝুক না বুঝুক, পৃথিবীতে সন্তানের কষ্ট একমাত্র বুঝতে পারে মায়েরাই।
পড়াশুনা আর চাকুরি এই দুই কারণে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি সেই কবে। মাঝে মাঝে যাওয়া হয় গ্রামে। এই তো সেদিন ব্রাহ্মণ পাড়ায় গিয়েছিলাম মটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত আনোয়ার ভাইকে দেখতে। গিয়ে দেখি অবাক কান্ড! ছোট একটা চাঁদের মতো শিশু রহিমা বুবুর কোলে। বলল তোর ভাগনি কুসুমের ছেলে। সেই ছোট কুসুম কতো বড় হয়ে গিয়েছে। তার বিয়ে হয়েছে। সংসার হয়েছে। সন্তানও হয়ে গিয়েছে। মাশা আল্লাহ্! দেখে খুশিতে মন ভরে গেল। কুসুম ভিতর থেকে দৌড়ে এল। দীর্ঘ পনেরো বছর পর দেখা। আমার স্ত্রী জেনীকে সে আগে দেখে নি। মাকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করছে, ওটা কি মামি। খুব হাঁসছে। জেনী জানত না সে বাক প্রতিবন্ধী। কুসুমের কাছে জেনি জিজ্ঞাস করছে ওটা কি তার বাচ্চা। সে কেমন আছে। কুসুম জবাব না দিয়ে হাতের ইশারায় বলাতে জেনী বেশ অবাক হল। আমি বললাম, সে জন্ম থেকে বাক প্রতিবন্ধী, তাই হাতের ইশারা কথা বলেছে।
কুসুমের বিয়ে সম্পর্কে রহিমা বুবুকে জিজ্ঞাসা করলাম। আপা জানাল, গ্রাজুয়েশন করা ছেলে ভালো চাকুরি করে। সব জেনেশুনে সে কুসুমকে বিয়ে করেছে। ছেলের মা বাবাও খুব ভালো। কুসুম কে ওরা অনেক দেখতে পারে। ওদের সুখের সংসার এর কথা শুনে খুশিতে বুকটা ভরে গেল। সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করি পৃথিবীর সকল প্রতিবন্ধী মানুষেরা যেন কুসুমের মতো চমৎকার স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবন যাপনের সুযোগ পায়।