কি না পারে সে! কোন কাজেই তার কোন অলসতা নেই। কাজ দিয়েই ক্রমাগত উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছে সে, বদলে দিচ্ছে আমাদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে।
এনামুল (৪৫) এর বাস বড়ভিটা ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়ায়। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এ পাড়ার প্রায় ৫২ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। কাকতালীয় হলেও এসব পরিবারের প্রতি ১০ বাড়ির মধ্যে গড়ে একজনের আছে কোন না কোন প্রতিবন্ধিতা। ওয়াটারএইডের সহায়তায় ২০০৭ এ আরডিআরএস তার এলাকায় পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যাভ্যাস উন্নয়ন মূলক প্রকল্প নিয়ে যখন এনামুলের এলাকায় কাজ শুরু করে, ঠিক তখন থেকেই এনামুল এর সাথে জড়িত হয়ে যায়। ঐ সময়ে মাত্র ২৬% পরিবার ল্যাট্রিন ব্যবহার করতো এবং মাত্র ১৩% মানুষের নিরাপদ পানির উৎস ছিল। আর স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কারো কোন ধারণাই ছিল না, আর সেগুলো মেনে চলা তো আরো পরের কথা। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের অবস্থার উন্নয়নের জন্য নেতৃত্ব আসে এনামুলের কাঁধে। অসম্ভব মনোবলের অধিকারী এনামুল দায়িত্ব হাতে নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ে কাজে। শুরু করে জনসংযোগ, দ্বারে দ্বারে ঘুরে সচেতন করা এবং এ কাজের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান দায়বদ্ধ তাদের সাথে দেনদরবার করা। স্থানীয় সরকার, এনজিও ও অন্যান্য সরকারি অফিসে ক্রমাগত যোগাযোগের ফলে এক পর্যায়ে তার পাড়ার ৬২টি পরিবারে ল্যাট্রিন স্থাপনের জন্য ঋণের ব্যবস্থা হয়ে যায়। একেবারে দরিদ্র খানার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের কাছ থেকে ৪টি ল্যাট্রিন ও টিউবওয়েলের গোড়া পাকার ব্যবস্থা করে সম্পূর্ণ বিনা খরচে। শুধু তাই নয়, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এলাকার একটি অংশ সবসময়ে জলাবদ্ধ ও নোংরা হয়ে থাকতো। সে স্থানীয় এমপিকে দিয়ে ওই পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনও তৈরি করিয়ে নিয়েছে। এনামূলের যোগ্য নেতৃত্বে এমন করে ১৫০টি পরিবারের মধ্যে ১৪০টি পরিবারেই এখন ল্যাট্রিন আছে। বাকিরা অন্যের ল্যাট্রিন ব্যবহার করছে; সুতরাং কেউ আর বাইরে পায়খানা করে না। এনামুলের নেতৃত্বে আজ প্রায় ১০০টি পরিবারে আছে হাত ধোয়ার প্রযুক্তি ও পাশেই একটি করে সাবান। প্রতিটি পায়খানা ঘরের সামনে থাকে একজোড়া করে স্যান্ডেল আর পানির বড় পাত্র। এসব পরিবারের সবাই এখন স্বাস্থ্যবিধি চর্চাও করছে। মানুষের আসল শক্তি তার মনে, শরীরে নয়। ব্যক্তি জীবনে তিন সন্তানের জনক এনামূল পেশায় দর্জি এবং দাখিল পাশ। অত্যন্ত ভদ্র, সৎ ও কর্মঠ মানুষ এনামুল এভাবেই প্রচলিত ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে প্রমান করছে অনেক সবল ও সক্ষম মানুষের চাইতেও সে অনেক বেশী সক্ষম।
আয়শা আকতার কণা
প্রোগ্রাম অফিসার, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ
কুষ্ঠরোগও দমাতে পারে নি যাকে
শারীরিক সুস্থতা মানুষের প্রথম চাওয়া। আর অসুস্থতাজনিত নির্ভরশীলতা যদি পরিবারের অসচ্ছলতার কারণ হয় তবে তা বেশি কষ্টের। আর এ জীবন যন্ত্রণায় ছিলেন চট্টগ্রাম শহরের পাকা র্যালি বস্তির ৫০ বছর বয়সী খোরশেদ আলম, যিনি গত ২০ বছর ধরে কুষ্ঠরোগে ভূগছেন। খোরশেদ আলমের স্ত্রী নেই, একটি মাত্র ছেলে- ক্লাস সেভেনে পড়ে; সংসার বলতে এটুকুই। বস্তির মোড়ে অল্প পুঁজির দোকানদারী থেকে অতোধিক অল্প আয় থেকে ঘর ভাড়া দিচ্ছেন, ছেলেকে পড়াচ্ছেন আর, শরীরটার মতই জীবনটাকে টেনে হিচড়ে বয়ে চলেছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলতে চান তিনি।
শারীরিক প্রতিবন্ধিতার দরুন দৈনন্দিন কাজে তার অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। উপায়ন্তর না থাকায় খোলা যায়গায় মল ত্যাগ করতে হতো তাকে। এ সময় নিজেকে বড় অসহায় আর মর্যাদাহীন মনে হয় তার। কিন্তু সামর্থ্য ছিল না যে তার উপযোগী ল্যাট্রিন বানাবেন। সংসারের অসচ্ছলতার বিবেচনায় এতো এক ধরনের বিলাসিতাও মনে হতো তার। এমনি এক সময় দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) ও ওয়াটারএইড এগিয়ে এসে এ বস্তির পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ শুরু করে। কম্যুনিটি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের পক্ষ থেকে খোরশেদ আলমকে স্থানীয় প্রযুক্তির বিশেষভাবে নির্মিত ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করে দেয়। এ ল্যাট্রিন আলমকে খোলা যায়গায় মল ত্যাগের অমর্যাদা থেকে মুক্তি দিয়েছে; জীবনকে করেছে সহজ ও নিরাপদ।
তিনি এখন ব্যক্তিগত স্বাস্থাভ্যাসগুলোও পালন করতে পারেন সহজে। ডিএসকে আলমকে একটি হুইলচেয়ারও দিয়েছে যা তার দৈনন্দিন জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে।
সৌজন্যেঃ দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে)