ইফতু আহমেদ
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অস্তিত্বের রেকর্ড পাওয়া যায় পিনি দি এল্ডার (২৭-৭৯) লিখিত “ন্যাশনাল হিস্ট্রি” নামক গ্রন্থে। ৭৭ সালে তিনি তাঁর গ্রন্থে কুইন্টাস পেডিয়াস নামক এক রোমান শ্রবণ প্রতিবন্ধী পেইন্টারের নাম উল্লেখ করেছিলেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যুগে যুগে প্রতিভাবান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অস্তিত্ব ছিল। তবে তাদের নানান চড়াই-উৎরাই উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল। আধুনিককালে বহু প্রতিভাবান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিস্ময়কর সাফল্যের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় “Focus on ability, not on disability” অর্থাৎ একে বাংলা ভাষায় শোভন করে বলা যায় “সামর্থের উপর গুরত্ব, প্রতিবন্ধিতায় নয়।”
জন মিল্টন (১৬০৮-১৬৭৮)
১৬০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ইংরেজ কবি ও রাজনৈতিক বিষয়ক লেখক জন মিল্টন লন্ডনে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৬৩২ সালে ক্যাম্বব্রিজ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন এবং ধর্ম, প্রেম ও রাজনীতি সম্পর্কে লিখতেন।
১৬৫২ সালে মিল্টন সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। ১৬৬৭ সালে তার মহাকাব্য “প্যারাডাইস লস্ট” প্রকাশিত হয়। ১৬৭১ সালে “প্যারাডাইস রিগেইন্ড” ও “স্যামসন এগোনিস্ট” নামক তাঁর দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। মিল্টনের তিনটি অবদান তাঁকে ইংল্যান্ডের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিগনিত করে। মিল্টন রাতের বেলায় মনে মনে রচনা করতেন পঙক্তির পর পঙক্তি এবং সকালে তাঁর স্মৃতি থেকে সাহায্যকারীদের লিখে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন। ১৬৭৪ সালের ৮ই নভেম্বর ৬৫ বছর বয়সে তিনি পরলোকে গমন করেন।
লুডউয়িগ ভ্যান বিটোফেন (১৭৭০-১৮২৭)
১৭৭০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর লুডউয়িগ ভ্যান বিটোফেন জার্মানীর বনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ স্বরলিপি রচয়িতা এবং তাঁর কর্মসমূহ তাঁকে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ক্ষেত্রে অমরত্ব দান করেছে। জীবনের প্রারম্ভেই বিটোফেনের সঙ্গীতজ্ঞ প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে এবং তা তিনি তাঁর ভায়োলিন ও পিয়ানো বাজানোর পারদর্শী গায়ক পিতার কাছ থেকে শিখেছিলেন।
১৭৯০ সালে বিটোফেন তাঁর শ্রবণশক্তি হারাতে থাকেন এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তাঁর শ্রবণশক্তি না থাকা গান রচনার কাজে বাধা হয়ে উঠে নি, বরঞ্চ তাঁর অধিকাংশ সুন্দরতম গানগুলি রচনা হয়েছিল তিনি শ্রবণ প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হবার পরে। বিটোফেন সুর সাগরে জননন্দিত হয়ে উঠেন এবং তাঁকে মিউজিক্যাল রোমান্টিজমের একজন অন্যতম স্থপতি হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৮৩২ সালের ২৬শে মার্চ ৫৭ বছর বয়সে ভিয়েনায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
হেলেন অ্যাডামস কেলার (১৮৮০-১৯৬৮)
১৮৮০ সালের ২৭শে জুনে হেলেন অ্যাডামস কেলার আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম আলাবামার টুস্কাম্বিয়া নামক একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তিনি ১৮ মাসের শিশু, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টি এবং শ্রবণ শক্তিহীন হয়ে পড়েন। ৭ বছর বয়সে তাঁর পিতা-মাতা এনি সুলিভানকে তাঁর গৃহশিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করেন। সুলিভানের সেবা-যতœ, শিক্ষা, ধৈর্য ও উৎসর্গীতায় হেলেনের জীবন পরিবর্তিত হয়। দশ বছর বয়সে তিনি পড়া, লেখা এবং কথা বলতে শুরু করেন।
১৯০৪ সালের ২৮শে জুনে হেলেন প্রথম ডেফ এবং ব্লাইন্ড ব্যক্তি হিসাবে হারভার্ড অধীনস্ত রাডক্লিফি কলেজ থেকে “ব্যাচেলর অব আর্টস” ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বহুসংখ্যক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন এবং তন্মধ্যে আমেরিকার সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান এওয়ার্ড দ্যা প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রীডম এ সম্মানিত হন। এছাড়াও, ১৯৯৯ সালে হেলেন গ্যালুপের বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের মাঝে একজন অন্যতম ব্যক্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তাঁর গ্রন্থসমূহ ৫০টির উপর ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
হেলেন মিল্টন ও বিটোফেনের ভক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর কবিতায় লিখেন:
“They took away what should have been my eyes
But I remember Milton’s Paradise
They took away what should have been my ears
Beethoven came and wiped away my tears
They took away what should have been in my tongue
But I had talked with God when I was young
He would not let them take away my soul
Possessing that I still possess the whole.”
ভাষান্তর:
“আমার দৃষ্টিদ্বয় তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল
কিন্তু আমি স্মরণ করি মিল্টনের স্বর্গখনি,
আমার শ্রবণদ্বয় তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল
বিটোফেন এসে মুছালো আমার চোখের পানি।
আমার জিহ্বা তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল
যখন আমি ছোট ছিলাম
ঈশ্বরের সাথে কত কথা,
সম্পূর্ণ পোষণ করি
তিনি তাদের অনুমতি দিবেন না
সরিয়ে নিতে আমার আত্মা।”
১৯৬৮ সালের ১ জুনে হেলেন ৮৭ বছর বয়সে আমেরিকার কনেক্টিকাটের ওয়েস্টপোর্টের সন্নিকটে তাঁর বাসভবন আর্কানরিজে ঘুমের ঘোরে পরলোক গমন করেন।
ফ্রাঙ্কলিন ডেলানোর রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫)
১৮৮২ সালের ৩০শে জানুয়ারী ফ্রাঙ্কলিন ডেলানোর রুজভেল্ট আমেরিকার নিউইয়র্কের হাইড পার্ক নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৩ সালে রুজভেল্ট হারভার্ড থেকে ইতিহাসে গ্র্যাজুয়েট হন। ১৯০৪ সালে তিনি প্রবেশ করেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’স্কুলে এবং ১৯০৭ সালে তিনি বার পরীক্ষায় পাশ করেন।
১৯২১ সালে রুজভেল্ট ৩৯ বছর বয়সে উভয় পদদ্বয়ে পোলিও আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। বাস্তবিকই এটা তাঁকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে তুলেছিল, কিন্তু তাঁর চেতনাকে যেনো আরো সমৃদ্ধ করেছে। তিনিই একমাত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যিনি চার ধারাবাহিক স্থিতিকাল (১৯৩৩-১৯৪৫) ধরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। হুইলচেয়ারে বসেই তিনি আমেরিকার চরম অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি একজন বিরাট সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর জীবনের বৃহত্তম বাধাগুলিকে বৃহত্তম সুযোগ-সুবিধাদিতে পরিণত করেছিলেন এবং সফলকামও হয়েছিলেন। তিনি বলতেন: “Handicaps exist only in the mind” অর্থাৎ “প্রতিবন্ধিতার অস্তিত্ত্ব শুধু মনেই।”
অন্যান্য
অপর আরো তিনজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা যায় যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁরা হলেন চার্লস জুলস হেনরি নিকোল ১৯২৮ সালে মেডিসিনে, স্যার চার্লস স্কট শেরিংটন ১৯৩২ সালে মেডিসিনে, এবং স্যার জন ওয়ারকাপ কর্নফোর্থ ১৯৭৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত হন।
বিশ্ব অলিম্পিকের একটি মাত্র মেডেল যেখানে পৃথিবীর অনেক দেশের কাছে স্বপ্নময়, সেখানে প্রতিবন্ধী এথলেটরা অলিম্পিকের বহু স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ মেডেল ছিনিয়ে এনে ঘোষণা করেছেন প্রতিবন্ধীরা ব্যক্তিরাও খেলাধূলার ক্ষেত্রে শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকাতে নেই। তাই আধুনিক বিশ্বে দেখতে পাই ভূমন্ডল জুড়ে নানান প্রতিবন্ধকতার মাঝেও প্রতিবন্ধী মানুষের আপোষহীন নিরলস সংগ্রাম।
লেখকঃ অরোরা, ইলিনয়, ইউএসএ থেকে।