মারুফা হোসেন

 

মানব জীবনের মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি শিশুই জন্মগতভাবে কিছু অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তার মাঝে শিক্ষা অন্যতম। তাদের উপযুক্ত ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে তৈরির দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের। তা যদি আমরা পালন করতে না পারি তাহলে মানব উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। সর্বোপরি স্থবির হয়ে যাবে। আর এ কারণেই ‘শিক্ষা’ আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, আমাদের দেশের জনসংখ্যার ১০-১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রতিবন্ধী মানুষ। জাতীয় সার্বিক উন্নয়নে এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ও বিকাশ লাভের পরিবেশ সবার জন্য সমান ভাবে উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। যার বাস্তবায়ন এখনও তেমন দৃশ্যত নয়। এ কারণে একদিন হয়তো এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের কার্যক্ষম আতœনির্ভরশীল নাগরিক না হয়ে, বোঝা হিসাবে প্রতীয়মান হতে পারে।

 

দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সকল শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুকেও ঘরের মাঝে লুকিয়ে না রেখে বিদ্যালয়ে পাঠানো অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে সচেতনতা পূর্বের তুলনায় বেশ অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। যা রাষ্ট্রের একটি ইতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। “প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩” সংসদে অনুমোদন পেয়েছে। যা ভূক্তভোগি মা বাবাদের জন্য নতুন আলোকবর্তিকা বয়ে নিয়ে এসেছে, অন্ততপক্ষে আমাদের সন্তানদের আর দয়ার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। সমাজে একজন অপ্রতিবন্ধী মানুষের মতই সমান অধিকার পাবে তারা সে বিষয়ে আমরা কিছুটা হলেও স্বস্তির জায়গায় আসতে পেরেছি। আমরা আশা করবো মানুষ হিসেবে তাদের মর্যাদা দেয়া এবং তাদের মৌলিক অধিকারগুলো বিবেচনা করা হবে।

 

বাংলাদেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন বা শিক্ষালয় দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রতিটি শিক্ষা ব্যবস্থাই পৃথকভাবে গড়ে উঠেছে। যেমন- বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম, সমন্বিত শিক্ষা কার্র্যক্রম, সমাজ ভিত্তিক পুনর্বাসন কার্যক্রম, গৃহ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম, দূর শিক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রম এবং একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম। তন্মধ্যে বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম ও একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করছি- বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের চাহিদা মেটানোর জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন সেটিই বিশেষ শিক্ষা। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন ধরণের শিক্ষা সরঞ্জাম অথবা উপকরণের প্রয়োজন হয়। উদাহরণ স্বরূপ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বড় অক্ষরে লেখা অথবা ব্রেইলের প্রয়োজন, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ইশারা ভাষা, শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হুইলচেয়ার প্রবেশগম্যতা ইত্যাদি। বিশেষ শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হলো এই শিশুদের স্বাধীন জীবন যাপনের জন্য প্রস্তুত করে মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা। বিশেষ শিক্ষার ক্ষেত্র বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্য প্রাথমিক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে শুরু করে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ তথা নির্দিষ্ট কোন পেশাতে সংস্থাপন পর্যন্ত বিস্তৃত। আবার “একীভূত শিক্ষা” বলতে বোঝায় সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই পদ্ধতির সার্বজনীন ও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিশেষ চাহিদা ও সম্ভাবনার ভিত্তিতে শিখন ও জ্ঞান অর্জনে প্রতিবন্ধকতা দূর করার পাশাপাশি সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নীত করা। একীভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় না এনে বরং এই পদ্ধতি তার বিশেষ শিখন চাহিদার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। একীভূত শিক্ষার মূল উপাত্ত হলো নমনীয়তা। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতা ভিন্ন। সে ক্ষেত্রে শিশুকে না বদলিয়ে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা শিশু কেন্দ্রিক হওয়া বাঞ্চনীয়।

 

তবে লক্ষ্য করা যায় আমাদের দেশে আইন হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কারোর যেন কোন মাথাব্যথা নেই। আমরা যারা ভুক্তভোগী মা বাবা তারা দিনের পর দিন তাদের সন্তানের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমার সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু। সে পুরোপুরি অন্যের উপর নির্ভরশীল, তাকে স্কুলে সাহায্যে করার জন্য আমরা নিজে থেকে একজন সাহায্যেকারি নিয়োগ দিয়েছি। তারপরও তাকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়। যার ফলে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করার পরিবর্তে যখন সেই প্রতিবন্ধী শিশুকেই স্কুল থেকে বের করে দিতে চাইছেন তখনই দেখা যাচ্ছে বিপত্তি। প্রতিদিনই কোন না কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেই প্রতিবন্ধী শিশুটিকে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব, প্রবেশগম্যহীন অবকাঠামো, টয়লেটে প্রবেশগম্যহীনতা, অনমনীয় কারিকুলামসহ শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নানান বিষয়ের অসঙ্গতির কারণে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী শিশু মূলধারার স্কুলে ভর্তি হলেও দেখা যায় কিছুদিন পরেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে তারা। আর একই সঙ্গে এই সমস্ত শিশুদের জীবন থেকে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 

আমার আজকের লেখার একটাই উদ্দেশ্য- আসলেই কি আমরা একীভূত সমাজ গড়তে পারছি বা গড়ার চেষ্টা করছি? আমরা সকলে মিলেই তো এই সমাজ। কিন্তু বিশেষ শিশুদের স্বস্তির জায়গায় নিয়ে যেতে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে ডিঙ্গিয়ে সর্বপ্রথম তাদের মা- বাবা সহ পরিবারের সকল সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে। দূর থেকে দেখে কেউই অনুভব করতে পারবে না এ শিশুরা, তাদের অভিভাবকবৃন্দ প্রতিটি মূহুর্তে কত রকম অবহেলা, বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। সকল রকম বাধা বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতাকে পেরোতে হলে প্রয়োজন প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবাদের মত সমাজের সকল জনগোষ্ঠির অংশগ্রহণ। এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে আতœনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে না পারলে তারা একদিন হয়ে উঠবে পরিবারের বোঝা, সমাজের বোঝা, সর্বোপরি রাষ্ট্রের বোঝা। একটি সুন্দর রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতাকে ভেঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি সকলে মিলে একটি একীভূত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।

 

পরিচালক, স্কুল ফর গিফটেড চিল্ড্রেন

(অটিস্টিক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন

শিশুদের একটি বিদ্যালয়)

তরী ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিষ্ঠান