শারাবান তোহরা সেঁজুতি
যখন সাফল্যের পথে কোন বাধা সৃষ্টি হয় তখন কিছু মানুষ থেমে যায়, হয়তো হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৫০ সালের এক প্রতিবন্ধী তরুণী যাকে কোন রোগ, দুর্ঘটনা এমনকি পারিবারিক বিয়োগান্তক ঘটনাও রুখতে পারে নি। সেই দশকেই তিনি হয়ে ওঠেন অদম্য একজন সফল বিজ্ঞানী।
ড. ফ্লোরা মজিদ, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা বাংলাদেশ কাউন্সিল এর সাবেক চেয়ারম্যান যিনি মাত্র নয় মাস বয়সেই পোলিও এর সম্মুখীন হন। ফ্লোরা মজিদের জন্ম ১৯৩৯ সালে। প্রথমে ডাক্তাররা বুঝতে পারেন নি। পরে ধরে নেন টাইফয়েডের কারণে তার শারীরিক এই সীমাবদ্ধতা। পায়ে স্ট্রেট ব্রেস লাগিয়ে দেয়া হয়। পায়ে ফোসকা পড়ে যেতো তবু এটি পড়ে থাকতো হতো তাকে। কারণ এর সাহায্যেই চলাফেরা করতে পারতেন তিনি। নিদারুণ কষ্টে কাটিয়েছেন তিনি সে সময়। পিএইচডি করার সময় ফ্লোরা পোস্ট-পোলিও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রথম নিজের প্রতিবন্ধিতার নাম জানতে পারলেন। আফসোস করে তিনি বলছিলেন, “সারাজীবন আমি ভুল ব্রেস পরে কাটালাম এবং কষ্ট পেলাম।”
তবে ফ্লোরার জীবনের লক্ষ্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি কোন বাধাই। একজন সফল ছাত্রী, নারী এবং সফল বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন তিনি। বিনয়ী স্বভাব ও সফল কর্মজীবনের পিছনে ছিল পরিবারের সহযোগিতা। ফ্লোরার বাবা এম এ মজিদ ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি সবসময় বলতেন, অ্যা রোলিং স্টোন গেদারস নো মস’। ফ্লোরাকেও এই বলে সতর্ক করতেন তিনি। জীবনে উন্নতির মন্ত্র শেখাতেন। এই উদ্দীপনা থেকেই ফ্লোরা মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি’র জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়েছেন। অন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাথে মেশার সুযোগ পেলেন তখন বাবা উৎসাহ যুগিয়েছিলেন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। শৈশবে ফ্লোরার বড় বোন রুবিও অনুপ্রেরণার বড় উৎস ছিলেন। তিনি ফ্লোরাকে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন এক বক্স ø্যাক ম্যাজিক চকলেটের লোভ দেখিয়ে। যদিও ভাল ফলাফল করলেও রুবি কথা রাখতে পারেন নি। বিয়ে করে করাচীতে চলে যান তিনি। ফ্লোরা হেসে বললেন, ‘এটা তার দোষ ছিল না। কিন্তু আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।”
পরবর্তীতে ফ্লোরা ক্রমাগত ক্লাসে প্রথম হতে থাকেন। কামরুন্নেসা স্কুলে মেট্রিক ও ইডেন মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে মেজর ছিল বোটানী এবং মাইনর ছিল কেমেষ্ট্রি এবং জিওলজি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বোটানী এবং জিওলজিকে জীবনের সাথে বেশি সম্পর্কিত খুঁজে পেলাম। গণিতে দুর্বল ছিলাম তাই ফিজিক্স ভয় পেতাম।” সে সময় কেউ বোটানীতে ফার্স্ট ক্লাস পায় নি। স্কুলে ভালো ফলাফলের কারণে সবাই বেশ আশাবাদী ছিলেন এখানে তিনি ভালো করবেন। কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলো অনার্স শেষ বর্ষে এসে হুমকির মুখে পড়ে। সেসময় তিনি তার বাবার সাথে দেখা করতে করাচী যান। সেখানেই নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হাত এবং পায়ের হাড়ে ফাটল ধরে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, আমার মনে আছে, জ্ঞান হারাবার আগে ভাবছিলাম কাঠের সিড়ি ভেঙ্গে ফেলেছি দেখে মন খারাপ করবে আমার বাবা। অথচ ঘন্টাখানেক পর জ্ঞান ফিরলে শুনতে পাই বাবা ডাক্তারের কাছে আফসোস করে বলছেন আমি কত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলাম!” তার ক্ষত এবং পড়াশোনা থেকে বেশ কিছুদিন দূরে থাকার পরও ফ্লোরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন। অনার্সে বোটানীতে প্রথমবারের মত ফার্স্ট ক্লাস পেলেন ১৯৬০ সালে।
ফ্লোরার মা নাজমুন্নেসা মজিদ হলেন সেই ব্যক্তি যাকে ছাড়া তিনি কখনো সফল হতে পারতেন না। “আমার মা একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে মাঠ পর্যায়ের কাজে সব সময় সাহায্য করেছেন। এমনকি বিসিএসআইআর এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও মায়ের ভূমিকার কথা জানতেন। মা আমাকে নিতে অফিসে এলে চেয়ারম্যান স্যার মিটিং থামিয়ে বলতেন, “তোমার মা চলে এসেছেন, তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার দরকার নেই!” ফ্লোরা উচ্ছ্বলতার সাথে অতীতের এই সমস্ত স্মৃতিচারণ করছিলেন।
১৯৬৫ সালে আমেরিকায় পিএইচডি করা কালীন এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। পরীক্ষার মধ্যে একদিন ঢাকা থেকে একটি চিঠি আসে, তার বোন রুবি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ফ্লোরা অস্থির হয়ে অধ্যাপককে জানালেন বাড়ি ফিরে যেতে চান। অধ্যাপক রাজী হলেও পরীক্ষা শেষ না করে বাড়ি ফেরার পক্ষে ছিলেন না বাবা। ফোনে মা, বাবা এবং দুলাভাই তিনজনেই পড়াশোনা শেষ করার বিষয়ে জোর দেন।
বাংলাদেশে ফেরার পর ডঃ ফ্লোরা মজিদ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা শুরু করলেও বাবা তাগিদ দেন স্থির হয়ে কিছু শুরু করতে। এরপরেই বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা কাজ শুরু করেন। বিসিএসআইআর এ কাজ করা শুরু করার পর তার বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। চাকরির ২০ বছরে ‘স্পিরুলিনা এরুজ’ নিয়ে কাজ করার সুযোগ এল। এটি অপুষ্টি এবং রাতকানা রোগের জন্যে খুবই ভাল, এখন ৬টি কোম্পানীর অধীনে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত হয় এবং প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এবং বেটা-কেরাটিন এর জন্যে প্রসিদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘আমি মাশরুম এবং অন্যান্য এল্গে নিয়ে কাজ করছিলাম। একজন ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী এসে এবং আমাদের (বিসিএসআইআর)কে বাংলাদেশে স্পিরুলিনা চাষের প্রকল্প দিলেন। তিনি স্পিরুলিনা চাষের বেসিক প্রযুক্তি শিক্ষা দিলেন। কিন্তু আমরা আবিষ্কার করলাম এটা মাইক্রোএল্গে যা গরম প্রকৃতির দেশে জন্মায় কিন্তু মৌসুমী ঋতুর দেশে হয় না। প্রকল্পটি অসফল হলে ঐ ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী চলে যান। কিন্তু আমরা হাল ছাড়লাম না। অনেক চেষ্টা এবং ভুলের মধ্য দিয়ে আমরা উৎপাদনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলাম এবং ইনফেকশন ছাড়াই স্পিরুলিনা উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলাম। বাংলাদেশ প্রথম মৌসুমী জলবায়ুর দেশ যেখানে স্পিরুলিনা সফলভাবে উৎপাদিত হয়। আর আমরাই প্রথম বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে মাইক্রোএল্গে তৈরী করি।”
ফ্লোরা আন্তর্জাতিকভাবে তার গবেষণা কাজের জন্য বিভিন্ন স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ একাডেমী অব সাইন্স থেকে পাওয়া স্বর্ণ পদকটিকে অস্কারের সাথে তুলনা করেন ফ্লোরা। বাংলাদেশ ওম্যান সায়েনটিস্টস অ্যাসোসিয়েশন তাকে দুবার স্বর্ণ পদক দ্বারা সম্মানিত করে। এছাড়া ২০০৫ সালে অবসর নেবার সময় কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিসিএসআইআর থেকে সম্মানিত হন।
প্রথম নারী বিজ্ঞানী হিসেবে বিসিএসআইআর এর চেয়ারম্যান ড.ফ্লোরা স্বীকার করলেন, “আমি জীবন নিয়ে ভীত ছিলাম শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে। গণিতে দুর্বলতার কারণে ভেবেছিলাম আমি হয়ত বিজ্ঞানী হিসেবে সাফল্য লাভ করব না। তাই যেটুকুই এসেছি আমি সেজন্যে আনন্দিত”।
ব্যক্তি জীবনে অবিবাহিত ফ্লোরা গান পছন্দ করেন। তার ভালো লাগে উত্তম কুমার, ক্লার্ক গেবেল, গ্রেগরী পিক এবং হেমন্ত কুমারকে। ১৯৯৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ঢাকায় নিরিবিলি জীবন যাপন করছেন তিনি। এই পর্যায়ে বলে উঠলেন, ‘মা মারা যাবার পর একবার স্বপ্নে দেখলাম আমি একটা রিক্সাতে উঠতে চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিলেন এবং চলতে শুরু হল রিকশাটি। একে আমার জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখি আমি। মায়ের নিরন্তর ধাক্কা আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।’
বাধ ভাঙ্গার ক্ষমতা এবং নিজেকে সর্বোত্তম স্থানে পৌছে দেয়ার সংকল্পে দৃঢ় থাকার চেতনা যার শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকেও পার করেছিলো একদা, সেই তিনি বর্তমানে বেশ অসুস্থ। আগের সেই প্রাণ চঞ্চলতা বয়সের ভারে ন্যুজ প্রায়। ঢাকায় মগবাজারের একটি বাসায় তবে কী একাকী মৃত্যুর প্রতীক্ষায় রয়েছেন ৭৬ বছর বয়সী সফল এই বিজ্ঞানী!